আগুনে হাঁটা থেকে হিংস্র ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই, ভারতীয় প্রাণঘাতী খেলাগুলি স্তম্ভিত করবে

বৈচিত্রময় দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। একশো ত্রিশ কোটি মানুষ একই সূত্রে গাঁথা হলেও, উৎসবে, চেহারায়, ঐতিহ্যে এবং ভাষায় তাঁরা একে অপরের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। আজ এই দেশের কিছু উৎসবের কথা বলব যা হয়তো এই দেশের এক বসবাসকারী  হয়েও আপনার অজানা।  

 ধিংগা গাভার

এটি রাজস্থানের একটি ঐতিহ্যবাহী  উৎসব। এই উৎসবের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকেন মহিলারা। অনুষ্ঠানটি মূলত রাজস্থানের যোধপুরকে কেন্দ্র করেই উদযাপিত হতে দেখা যায়। এই উৎসবের যোধপুরবাসী মহিলারা বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণের মধ্যে দিয়ে, নাচগানে মেতে ওঠেন।     প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, এই উৎসবের প্রাককথা। ‘ধিংগা’ কথার অর্থ হল ভান করে রসিকতা করা এবং ‘গাভার’ শব্দের অর্থ হল গৌরী বা পার্বতী। শোনা যায়, ভগবান শিব তাঁর স্ত্রী পার্বতীর সঙ্গে খানিক রসিকতা করার উদ্দেশ্যে একদিন মুচির ছদ্মবেশে তাঁর সামনে হাজির হন। এই ঘটনার পরে দেবী পার্বতীও শিবকে চমকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক ভীল উপজাতির নারী সেজেছিলেন। এই গল্প থেকেই ‘ধিংগা গাভার’ উৎসবের সূচনা। দীর্ঘ ১৬ দিন বাবদ এই অনুষ্ঠান চলে । অনুষ্ঠানের একদম শেষ দিনে যোধপুরের বিবাহিত, অবিবাহিত মহিলারা বিভিন্ন দেব-দেবী কিম্বা রাক্ষসের বেশে যোধপুরের পথে পথে সারারাত ঘুরে বেড়ান। এই উৎসবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এই উৎসবে সধবা এবং বিধবা উভয়েই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এছাড়াও ‘ধিংগা গাভার’ এর একটি মূর্তিরও চল রয়েছে যা রাখা রয়েছে যোধপুরের এগারোটি স্থানে। অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে এই মূর্তিগুলিকে বলতে গেলে সোনার গহনায় মুড়ে দেওয়া হয়। আরও একটি মজার রীতি এই উৎসবে প্রচলিত রয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষ দিনে যদি কোন পুরুষ নারীদের বিব্রত করে, তাহলে তাঁকে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়ে থাকে, তাঁরা বিশ্বাস করেন এই আঘাতের কারণে পুরুষদের সৌভাগ্য প্রাপ্তি ঘটে এবং যদি সেই পুরুষ অবিবাহিত হয় তাহলে সেই বছরেই সে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘ধিংগা গাভার’ একটি আনন্দের উৎসব।

 

থিমিথি

এই উৎসবের সূচনা তামিলনাড়ুতে হলেও বর্তমানে তা এক আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। ভারতের বাইরেও ফিজি, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া এবং মরিশাসে অনুষ্ঠানটি পালিত হতে দেখা যাচ্ছে। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মূলত মহাভারতের দ্রৌপদীকে সম্মান জানানো হয়ে থাকে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে দ্রৌপদীকে তাঁর পঞ্চস্বামীর সম্মুখে পবিত্রতার প্রমাণস্বরূপ আগুনের উপর হাঁটতে হয়েছিল, সেই কথাই স্মরণে রেখে আজও দক্ষিণ ভারতের বহু মানুষ নিজেদেরকে পবিত্র প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে এই অনুষ্ঠানটি উদযাপন করে থাকেন। প্রতিবছর অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস নাগাদ তামিলনাড়ুতে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। তবে উৎসবের একমাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতিপর্ব । অংশগ্রহণকারী মানুষেরা গোটা একমাস ধরে নিরামিষ আহার করে থাকেন। থিমিথির আগের রাত্রে হাঁটার গর্তটি তৈরি করা হয়ে থাকে। ২.০৭ মিটার দৈর্ঘ্যের এই গর্তে, পরের দিন ভোর ৪টে থেকে সকাল ১১টা অবধি জ্বলতে থাকে কয়লা। প্রথমে মন্দিরের শীর্ষ পুরোহিত এই জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যান এবং তাঁর পথ অনুসরণ করেন ভক্তরা। তবে বর্তমান ভারতে অনেকেই মনে করেন, এই অনুষ্ঠান অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকবার আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নিজেদের ভারসাম্য হারিয়ে আহত হয়েছেন বহু মানুষ, বিশেষত শিশুরা। কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পর, অপর এক গর্তে রাখা দুধে পা ডুবিয়ে পোড়া স্থানের ব্যাথা নিবারণের ব্যবস্থা থাকে।

জাল্লিকাট্টু

কৃষি প্রধান ভারতের এই উৎসবের কথা শুনতে শুনতে আপনার মনে পরতেই পারে ‘জিন্দেগী না মিলেগি দোবারা’ সিনেমার শেষ দৃশ্যটি। যেখানে অসংখ্য মানুষ তাদের মৃত্যু ভয় কাটাতে এমন এক খেলায় মেতে উঠেছিলেন, যার প্রতি পদে পদেই রয়েছে মৃত্যুর হাতছানি। তবে জাল্লিকাট্টু স্পেনের সেই উৎসবের থেকে খানিক হলেও আলাদা। তামিলনাড়ুর একটি  ঐতিহ্যবাহী খেলা এই জাল্লিকাট্টু হল ষাঁড় এবং মানুষের এক মুখোমুখি সংঘাত। তবে এই ষাঁড় গুলি মূলত গৃহপালিত এবং সারা বছর তাদের বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এই লড়াইয়ের জন্য ষাঁড়গুলিকে প্রস্তুতও করা হয়। তামিলনাড়ুর কৃষকেরা মনে করেন, এই খেলা তাঁদের কর্মঠ জীবনে এক নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটায়। এই খেলাটি বহুবার ‘PETA’র দ্বারা সমালোচিত রয়েছে এবং অবশেষে ২০১৪ সালে, ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এই খেলাটিকে নিষিদ্ধ করে, যদিও এখনও কিছু কিছু গ্রামে সকলের নজর এগিয়ে এই খেলা উদযাপিত হয়ে থাকে।

 

অগ্নি কেলি

কর্ণাটকের মাঙ্গালোর শহর থেকে প্রায় ২৯ কিমি দূরে অবস্থিত কাটেল দুর্গা পরমেশ্বরী মন্দির। প্রতিবছর এই মন্দির চত্বরে আত্তুর এবং কোডেতুর গ্রামের পুরুষেরা এক আগুনের খেলায় মেতে ওঠেন। কাটেলের এই দুর্গা মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে নন্দিনী নদীর মাঝখানে অবস্থিত এক দ্বীপে। তাই এই মন্দিদের দুর্গা পরিচিত ‘জল দুর্গা’ নামেও। তবে জলে অবস্থানকারী দেবীর সঙ্গে আগুনের এই সাংঘাতিক খেলার কোন সম্পর্ক নেই। অনুমান করা হয় কয়েকশো বছর আগে আত্তুর এবং কোডেতুর গ্রামের মধ্যে এক লড়াই হয়েছিল, সেই লড়াইয়েরই এক প্রতীকী রূপ হিসাবে আজও এই আগুনের খেলা প্রচলিত। প্রথমে দেবীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়, তারপর শুরু হয় দেবীর অন্যান্য শোভাযাত্র এবং সবশেষে আসে এই লড়াইয়ের পালা। লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের পরনে থাকে গেরুয়া ধুতি। ২০-৩০ মিটার দূর থেকে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের দিকে জ্বলন্ত মশাল নিক্ষেপ করতে থাকে, প্রতি জন কেবল পাঁচবার মশাল নিক্ষেপের সুযোগ পায়। এছাড়াও খেলায় সাদা ধুতি পরে রেফারির ভূমিকায় থাকে একজন ব্যাক্তি যিনি আহত খেলোয়াড়দের নানাভাবে সাহায্য করেন। এছাড়াও তিনি লক্ষ্য রাখেন কোন খেলোয়াড়কে ইচ্ছাকৃত বারবার আঘাত করা হচ্ছে কিনা। যদি খেলায় এমনটা হয়, তাহলে তিনি সেই মূহুর্তেই খেলা বন্ধ করার আদেশ দিয়ে থাকেন। এই গোটা খেলাটি বা উৎসবটি চলে ১৫ মিনিট ধরে। ‘অগ্নি কেলি’ র পাশাপাশি এই খেলাটি অগ্নি উৎসব নামেও পরিচিত।

More Articles