আদা-লঙ্কা বাটায় চমৎকার পাঁঠার ঝোল, শিমূল পলাশের আলো ছড়ানো সে হেঁশেল

গাছে গাছে রঙের কোলাহল। শিমূলে পলাশে এমন ছবি আঁকা আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে মানুষের সকাল কাটে দুপুর কাটে। এমন ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে ওই দূরে তাকালে এমনিই মাথা ঝিম ঝিম করে। তবু মানুষের চোখ চলে যায় ওই দূরে, ওই রঙের বেপরোয়া উদযাপনে। পূর্ণিমের আর দেরী নেই। শুক্ল পক্ষের নরম জোছনায় এখনই এই আলপথ, এই শাল মহুয়ার জঙ্গল ফুটে থাকে কেমন। এই তো কাল এই সাঁওতাল পাড়ায় রঙের উৎসব। সে রঙ অবশ্যি দেখা যায় না চোখে, মনের ভিতরে তার কত কত ঢেউ জাগে আর পড়ে। এ পাড়ার মোড়ল এমন দিনে কাঁধে জলের ঘটি নিয়ে বসে থাকেন এক ঠাঁই। পাড়াতুতো মানুষ তাঁর পায়ে জল ঢেলে দেয়, এনে দেয় শালের মঞ্জরী। সেসব ফুরালে জল খেলা চলে দিনভর।

এসব নিয়ে পাশের পাড়ার তেমন মাথা ব্যাথা নেই। নেড়া পোড়ার আয়োজন করে যারা তাদের আর যাই থাক কেজো বুদ্ধি তেমন নেই। তাদের বাবা কাকারা বরং হাতে সময় থাকতে হাট বাজার সেরে নেয়। গাছে গাছে, খিড়কির উঠোনে শিমের লতা শুকিয়ে এসেছে এতদিনে। তাও বেছে বেছে কচি দেখে শিম তোলে গোপালের ঠাকুমা। গোপাল, গোপালের দিদি রূপা এসব নিম শিমটিম খেতে চায় না। কিন্তু বললেই আর শুনছে কে! গোপালের ঠাকমার আবার মা শেতলায় অগাধ বিশ্বেস। মায়ের দয়া হবিনি এসব খালি পর, বুজছ মানিক? মানিক, মানে আমাদের গোপলা এসব বোঝে না। প্রথম গ্রাসে কোনো রকমে তেতো মেতো খেয়ে ঢক করে জল খেয়ে নেয়। তাতেই কি নিস্তার আছে! বড়ি আর সজনে খাড়া দে এমন বড়ির ঝোল খেতে কে চায়!

তবু গোপালের মা, ঠাকমা এসব রান্না করে কী যে আনন্দ পায়! গোপালের পছন্দ পাকা মাছের টক। তবে চাইলেই বা দিচ্ছে। পুঁটি মাছের টক খেতে বয়ে গেছে গোপালের। ঠাকমা সেসব শুনেও শোনে না, বলে দ্যাখ তো রূপা কেমন পুঁটির টক ভালোবাসে! এসব শুনলে গোপাল রেগে যায়। যাবেই তো, দিদির জন্যই তাহলে রাঁধো তোমরা! বলতে বলতে পাতের ভাত পাতে পড়ে থাকে, গোপালের ঠাকমার কি সাধ্যি আছে গোপালকে ফেরায়!

গোপাল তখন নন্দীদের বাড়ি পেরিয়ে ওই দূরে। পড়ে থাক মাছের টক পড়ে থাক সজনে খাড়ার ঝোল, গোপাল এখন নেড়া পোড়ার তদারকি করবে বিকেল ভোর। গোপালের ঠাকমাও জানে এসব, গোপালের থালার ভাত তরকারি তাই আস্তাকুড়ে ফেলে দিতে দিতে একবার তিনি ফজলি আমের নুয়ে পড়া ডালখানায় না তাকিয়ে পারেন না। পাটকেলে ন্যাজ ঝুলিয়ে এমন মস্ত এক জোড়া হাড়িচাচা এসে বসেছে দ্যাখো! আহা ওদের কেমন রঙিণ পোষাক দ্যাখো, ওদের তাই বুঝি রঙ খেলার বালাই নেই। এসব ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে তলিয়ে যেতে চেয়েও পারেন না তিনি। পূন্নিমে লাগার আগে তুলসি তুলে রাখতে হবে। এঁটো সকড়ির কাপড় চোপড় ছেড়ে আরেকবার গা ধুয়ে নেন তাই। এ বাড়িতে গপালের নিত্য সেবা হয় যে! দোলের দিনে তাই কাজের অন্ত নাই। পেস্তা বাদাম বেটে গোলাপ জল ছিটিয়ে মালাই শরবত বানাতে হয় সক্কাল সক্কাল। এ গাঁয়ে কে আর এমন শরবত বানায়! এসব তিনি শিখেছেন সেই দিল্লির পিসি শাশুড়ির থেকে। মনে থাকতে তাই কাগজি বাদাম ভিজিয়ে দেন বাটি ভরে। বাদাম ভিজোনো হলে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করতে হবে। কাল সক্কাল সক্কাল ঘিয়ের নুচি ক্ষীরে ডুবিয়ে না দিলে মজবে না ভালো। এদিকে আবার ছাপ সন্দেশ করা বাকি। বউমাকে যদিও বলেছিলেন ছাপ কখানা মেজে ধুয়ে শুকিয়ে রাখতে, তবু কাজের বাড়িতে বিশ্বাস কী! মানুষের ভুল হতে কতক্ষণ! গোপালের ঠাকমা তাই জলচৌকিখানায় বসে তোলা উনুনে দুধ জ্বাল দেন আর মনে মনে আলমারি দেরাজ মিটসেলফ হয়ে তার মনখানা ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিকে।

গোপাল জানে এসব, রূপাও জানে। এ বাড়িতে গোপালের নিত্যসেবা তাদের তো অজানা নয়, ওরা তাই তোলা উনুনের দিকে চেয়ে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মা জিজ্ঞেস করলে খানিক চুপ করে থাকে। তবু পিড়াপিড়ি করলে বলেই ফেলে, জানো মণ্টুদের বাড়িতে কাল মাংস হবে। এ আর নতুন কথা কী! প্রেতি বচ্ছর তো হয়! এই এত্ত বড় লোহাড় কড়াইয়ে কষিয়ে কষিয়ে পাড়া প্রতিবেশীকে গন্ধে ডুবিয়ে তবে না ঘোষাল বাড়ির পার্বণের রান্না। এই দিস্তে দিস্তে শুকনো লঙ্কা বাটছে আর বাটছে। অমন গরগরে ঝোল দেখলে এমনিই পেট কনকনায়। গোপাল এসব শুনে আর চুপ করে থাকতে পারে না, বলে কনাক। কনকনাক। তুমি কাল মাংস করবে মা। গোপালের মা বলেন, সে কেমন করে হবে মানিক? এ যে বৈষ্ণব বংশ ! ওরা অঘোর, শাক্ত। ওরা আর আমরা কি এক হলুম রে! এসব কথা গোপালের মাথায় ঢোকে না। বলে আমিও শাক্ত হবো মা। আমি মাংস খাব। দোলের দিনে লুচি পায়েস খেতে বয়েই গেছে গোপালের।

রূপা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। ও জানে, মায়ের মতামতের গুরুত্ব নেই তেমন। বৈষ্ণব বাড়িতে এসে ইস্তক মা’কে কত কী যে করে যেতে হচ্ছে! তাই ও কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে খানিক। বলে, মা, সেদিন ও পাড়ায় মাদল বাজছিল, শুনেছ? কী ভালো লাগে, তাই না মা? মা হাসেন, বলেন তুইও শুনছিলি বুঝি! মায়ের এই হাসিখানা ভারী সুন্দর। ভাই বোনে মায়ের গা ঘেঁষে বসে বসে মায়ের গন্ধ নেয় নাক ভরে।

বলে – মা, ও মা, একদিন ওদের মত মাংস রান্না করে দেবে। ওরকম লাল লাল মাংস? মা বলেন , দেবো। এই না গাঁ না মফসসলে খাসির মাংসের দোকান আছে দু-চারটে। সময়ে সময়ে পাঁঠাও কাটে ওরা। মায়ের মেজ পিসি কেমন আদা লঙ্কা বাটা দিয়ে পাঁঠার নিরিমিষ ঝোল রাঁধতেন সে কথা মনে পড়ে যায় ভাই বোনের। সে গল্পে মাংসের গন্ধ পাওয়া যায়। সে গল্পে দোলের দিনে ওদের মায়ের কিশোরীবেলা বেণী উড়িয়ে রঙ মেখে বেড়ায় দেদার। সেই মা বৈষ্ণব কি শাক্ত সেকথা জানয়ে ওদের বয়েই গেছে। ওরা কেবল জানে ওদের নিত্যসেবার জোগাড় করা মা, আদা বাটা লঙ্কা বাটায় চমৎকার পাঁঠার ঝোল রাঁধেন। আহা, সে ঝোলের রঙে শিমূল পলাশের আলো ছড়িয়ে থাকে বিলকুল।

More Articles