গঞ্জের হাটের ছুরি শুঁটকি, অপেক্ষা আর ফুরোয় না

শীতের শেষবেলায় এমন বৃষ্টি বাদল কার ভালো লাগে বলো দেখি! মাঘের শেষ কাটালে বৃষ্টি বড় সৌভাগ্যি, এমন তো প্রবচনে বলা আছে জানি। তা৷ বলে, আলু আর প্যাঁজের জমি তইলে গেলে মানষের কি ভালো লাগে! মানুষ তখন টিপিটিপি বৃষ্টিতেও কালো ছাতাখানা মাথায় চাপিয়ে আলের পাশটিতে গিয়ে বসে থাকে। ওর মাথার উপর হিজল গাছ ওই ডালপালা মেলে দিয়ে বসে আছে একা একা। সেই রাত থাকতে জল হচ্ছে। হিজলের বুক মাথা সব কিছু ভিজে একেবারে ঝুপ্পুস। এই বৃষ্টি খানিক ধরেছে এবার। এমন করে বসে বসে, জল নামা দেখতে দেখতে ওই দূরে চোখ চলে যায় মানুষের। অমন সর্ষেক্ষেতের ওপারে তখন থমকে থাকা মেঘের মাথায় রূপোলী পাড় তার আশমানি রূপকথা বুনে দিতে চায় পৃথিবীকে ভালোবেসে। চাষী মানুষের একখানা পশমে বোনা মন নেই একথা মনে করেন বুঝি আপনারা! কালো ছাতা বসে বসে দেখে এসব। দেখতে দেখতে ওর খেয়াল যায়, দুপুর গড়িয়ে পড়েছে ধীরে।

সে কথা ভেবে ওর খানিক খিদেই পায় বুঝি। মায়ের কথা মনে পড়ে ওর। মায়ের মুখে আস্ত একখানা ভাতের থালা দেখতে পায় ও। খিদের সঙ্গে মা যে কেমন করে মিশে গেছে ওর চৈতন্যে, সে কথা ভেবে দেখবার মতো অবকাশ ওর হয়নি বুঝি কখনও। ও তাই একখানা ডুব দিয়েই তাড়াতাড়ি চান সারে। সারতে সারতেই ওর খিদে লাগে জোর। মায়ে ভাত বাড়ে। কলাই করা থালায় ধোঁয়া ওঠে। ভিজে হাওয়ায় শিরিশিরিয়ে ওঠে ওর আপাদমস্তক। মানুষ আর কী করে তখন! গরম ভাতের থালাখানা টেনে নেয় কোল ঘেঁষে! কাসি থেকে পিপুলের ডাঁটার চচ্চড়ি বেড়ে দেন মা। আলগা হাতে ভাত দে মেখে নিতে নিতে ওর জিভ ওর মগজ ভরে ওঠে ভিজে মাটির স্বাদে। ও টের পায় গাছেদের মতো, এই ভাতের পাশটিতে বসে কী আশ্চর্য সংশ্লেষে পিপুলের রসে মাটির লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরছে ও, ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে।

ছবি সৌজন্যে : betaapi.inscript.me

মায়ে বলে, 'ঘরে তো বাজার নাই পিলু! কুমড়া পাতা তুলছি খানিক। ভাগ্যি হাড়িতে ক’খান সিদোল তোলা ছিল!' সিদোলের কথায় পিলু ফিরে আসে ভাতের থালায়। এমন ভেজা একখানা দিনে পুঁটির শুঁটকি পেলে মানুষ আর কী চায়? পাতায় ভাজা ঝাল ঝাল সিদোল খেতে খেতে পিলুর মনে পড়ে ওর বাপের কথা, ইছামতীর পাড়ে ওদের ফেলে আসা মামার বাড়ির কথা। বাপে যে কী ভালোবাসতো! ছুরি শুঁটকি রাঁনলেই তাড়াতাড়ি মাঠের তে ফিরতো , বলতো, 'বউ খিলে লেগেছে, ভাত দে'। মায়ে আজকাল আর ছুরি শুঁটকি রাঁধে না, সে কি ওর বাপ মরে গেছে বলে? কী জানি, ওই গন্ধের সঙ্গে বুঝি বাপের হাসিখানা মিলে মিশে আছে।

রান্না তো কেবল আর জিভ দিয়ে খায় না মানুষ! রান্নায় মিশে থাকে সোহাগ আদর লোনা জলের দাগ। এসব কখনও বলে না পিলু, কিন্তু ও জানে মায়ে কেন ছুরি শুঁটকি রাঁনতে চায় না। বলে, 'আরেকটু ভাত দ্যাও মা। মায়ে জানে, সিদোল করলে পোলায় ভাত খানিক বেশিই খায়।' বলে, 'ভাবছিলাম, সিদোলের চাটনি দে তোরে চিতই পিঠা করে দিমু, সে দেবো নে আরেকদিন।' পোলা’য় ঘাড় নাড়ে। তিতা বলো পিঠা বলো ভাতের যুগ্যি কেউ না। ভাতের গরাস মুখে তুলতে তুলতে ওর তৃপ্তিরা তখন হিজল গাছের মতো ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে যেতে চায়। স্টিলের ফুলকাটা বাটিতে মরিচ রসুন ফোঁড়নের ডাল ঢেলে দেয় মা। চুমুক দিয়ে ডাল খাবে ছেলে। ছেলের খাওয়া দেখতে দেখতে মায় সব ভুলে যেতে চায়।

বাপের গড়ন পেয়েছে ব্যাটায়। অমন মুখ দেখলে মায়ের আবার মরিচ বাগাড় দে ছুরি শুঁটকি রাঁনতে সাধ যায়। এই গাঁয়ের ওই ওপাশে তিনআমতলা পেরোলে বাসুদেব মন্দির। মন্দির পেরোলে একখানা গঞ্জ। সেখানে রোববারে রোববারে হাট বসে। হাটে মানুষ কত! মুরগির বাচ্চা থেকে ধামা কুলো শুঁটকি, কী নেই!

বাপজানকে বলবে এখন, ভালো দেখে ছুরি শুঁটকি নে আসতে। বলতে বলতে মায়ে টের পায়, ছেলের ভাত কখানা শেষ। বলে, আর ভাত নিবি? নেয় না আর। এবারে হাপুস হুপুস করে পাকা চালতার টক খাবে কালো ছাতার ছেলে। গাছ পাকা চালতায় কী বাস! খেতে খেতে পোলায় বলে ওবেলা রান্ধিস না মা। মায় কয়, ক্যান? মুড়ি খাবি? না না, কালো মাথার ছেলে মুড়ি খাবে না। বাপের পারা ছেলে এমন মেঘ বাদলের দিনে বাপের মতো করি ল্যাটকা খিচুড়ি রাঁনবে মাকে ভালোবেসে। হাপুস হুপুস করে পাকা চালতার টক খাওয়া ছেলে তাই কালো ছাতাখানা ফেলে রেখে আবার মাঠে যায়। গেঁজে থেকে একখান চিকচিকি বের করে জমির তে ছাঁচি প্যাঁজ তোলে, কড়াইশুঁটি তোলে। তারপর ওই দূরে হেঁটে হেটে চলে যায় কালো ছাতার ছেলে। সেই যেখানে হলুদ ফুলের ওপারে রূপোলী মেঘের পাড় তার রূপকথাখানা বুনে দিতে চেয়েছে! সেই সেখানে। সেই রূপকথার রাজ্যি থেকে কুরুশে বোনা ফুল তুলে আনবে ছেলে। সর্ষে ফুলের গন্ধে তখন ভরে উঠতে চাইবে ওর করতল। বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যে নামলে পর, লম্ফ জ্বেলে পাটখড়ি দে উনোন ধরাবে, আনাজ কাটবে। কাটতে কাটতে দু’কলি চটকা গানও কি গুনগুনিয়ে উঠবে না! উঠেবে উঠবে।

আঁচে পাতিল খানা বসিয়ে দিতে দিতে ওর মনে পড়বে বাপের মুখ, মায়ের মুখ। বাপের মতো করে খিচুড়ি রাঁধা হলে পোলায় এখন কুরুশ দিয়ে বোনা সর্ষে ফুলের বড়া ভাজবে ভারী যত্ন করে। গোটা গোটা ছাঁচি পেঁয়াজ আধ ডুবো হয়ে চেয়ে আছে খিচুড়ির পাতিল থেকে ওই। রাত খানিক বেড়েছে বোধহয় এতক্ষণে। পোলায় খিচুড়ি বেড়ে দেবে, বড়া সাজিয়ে দেবে কলাই করা থালায়। ওর রান্নাখানায় তখন রূপোলী মেঘের আলো ছড়িয়ে পড়তে চাইবে অকারণে। ঠিক যেন অবন ঠাকুরের গল্প। মায়ে ব্যাটায় বসে বসে ল্যাটকা খিচুড়ি খাচ্ছে ওই। ওদের গল্পে এসে পড়ছে বাপের কথা, নদীর কথা, শামলী গাইয়ের কথা। কথায় কথায় মা কত কথাই না বলছে আজ। বলছে, 'আর দিন গঞ্জের হাট তে ছুরি শুঁটকি কিনে আনবি পিলু?' পিলু কইছে না কিছু। কী কইবে পিলু! ও কেবল মুখ নীচু করে ছাঁচি প্যাঁজের খিচুড়ি খাচ্ছে।

More Articles