স্মৃতির ভিতর যে স্বাদের নিরন্তর চলাচল

শীত এবারে খানিক নরম হয়ে আসছে। এই মাঘ মাসটুকুই বড় জোর, তারপরে হাওয়া ঘুরতে শুরু করবে। এইসব ভাবতে ভাবতে উনোনের কোল ঘেঁষে উবু হয়ে বসে আছে উনো কুঁজো বুড়ো। ওর লাঠিগাছখানা পাশে নামানো। ছটফটে ছাগলছানাও এখন খানিক শান্ত হয়ে বুড়োর কোল ঘেঁষে শুয়েছে। শরীরের ওম ভাগ করে নিচ্ছে ওরা আসলে। শিয়াকুলের পাতা ওদের পিঠে ছায়া আর আলোর জাফরি বুনে চাইছে কেবল। এইসব চাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাতে বয়েই গেছে বুড়োর। সকাল সকাল পেট ভরে মাড়ভাত খেয়ে ও এখন মৌতাত করছে নরম রোদ্দুরে বসে বসে। এই তো শীতের কদিন। শীত ফুরোলেই আবার পান্তায় ফিরে যাবে ওর সকাল গুলো। তখন মচমচে ভাজা মরিচ ডলে নিতে নিতে ওর আমানিখানা রঙিন হয়ে উঠবে। ওইটুকু নিয়েই বুড়োর সুখ।

বুড়ির অবশ্য এসব দেখার সময় নেই, সকালে উঠে থেকে উনো কোটি কাজ নিয়ে তার সাংসারিক যাপন। সকাল মিটলে এবারে দুপুরের রাঁধাবাড়া। শাকে, ডালে, ঝোলে ঝালে ডুবে যাবার তখন অগাধ আয়োজন। মানুষ কি কেবল পেট ভরানোর জন্য রাঁধে? তা তো না। বুড়ি তাই মাথা নীচু করে ব্যস্ত হাতে শাক বাছে, কুটনো কাটে। বুড়ির বউমা ওই কোণে বসে বসে মশলা বাটে এক মনে। ওর কি এই গেরস্থালির কাজে মন নেই! কী জানি। বুড়ি এসব ভালো বোঝে না। এত বুঝতে গেলে আর সংসার চলে ক্যামনে! পোনকা শাকের ডাল আর মুলোর টক রাঁধতে রাঁধতে বুড়ি কত কী যে ভাবে। বউ এসে বলে, 'হলো মা? এবারে আপনি সরুন মাছের ঝালটা করে নিই!' বুড়ির এসব পছন্দ হয় না, এসব মাখা মাখা ঝালদা তার জিভে রোচে না। আহা! শীতের দিনে এমন বাটা মাছের পাতলা সর্ষেবাটা ঝোল ধনে পাতা ছড়িয়ে, সে যেন 'অম্মিতো'। তা বললিই বা শুনছে কে! বুড়ির জিভের তোয়াজ করতে বয়েই গেছে সক্কলের। তার শাউড়ি তাকে কত শেখালে, কত শেখালে তার দিদি শাউড়ি কিন্তু তা বললি কী হয়, বুড়ির মাথার মধ্যে কোন সে এক দেশ বাসা বেঁধেছে, সে খবর রাখে কে? কেউ রাখে না, রাখার দরকারই বা কী! বিয়ে হয়ে এসেছে সে এই এত্তগুলো বছর, এখনও তার বাপের বাড়ির স্বাদ সে ভুলতে পারলো না! এ কি কম অপরাধ হলো! মানুষের অভিপ্রয়াণের ইতিহাসে কি কেবল ভিটে মাটি আর শরিকি মকদ্দমার নির্যাস মিশে থাকে? মানুষের স্বাদও থাকে তো, স্মৃতির ভিতর তার নিরন্তর যাওয়া আসা কেবল। সেসব কি আর বললেই বেমালুম ভুলে যাওয়া চলে?

এসব বোঝে না কেউ, বুঝতে চায়ও না বুঝি। বুড়ি তাই নড়া দাঁতে নস্যি ডলতে ডলতে ওই দূরে গোরুদের ফ্যান খাইয়ে আনতে যায়। আনাজের খোসাপাতি আর ফ্যান খেয়ে কমলি একটু জিরোলে আবার বুড়ি ফিরে আসে নিকোনো দাওয়ায়। ওই কমলির ফ্যানজল খাওয়া দেখতে দেখতে বুড়ি ভাবে তার ছেলেবেলায় কেমন এই মাঘের বেলায় নতুন চালের ফ্যান দিয়ে ওর দিদিমা শাকের ঝোল রেঁধে দিতেন। সে ফ্যানের স্বাদ কত! সেসব ভেবে বুড়ি বড় করে শ্বাস ফেলে। কোন সেই ছেলেবেলায় ওরা বর্ত্তের ভাত রান্না করতো। সেসব ব্রতের ভাতে মিশে থাকতো আইবুড়ো নাম খণ্ডানোর ব্যাকুলতা। মাছ, মুখীকচু, থোড়, দই চিনি আর চাল দিয়ে রান্না হতো সে ভাত, লোকে বলতো ঘণ্টভাত। বুড়ির জিভে একেকদিন সেই স্বাদ এসে জড়ো হয়। বুড়ি তো কখনও লাইব্রেরির ক্যাটালগ দেখেনি, বুড়ি তাই টের পায় না, কেমন করে স্বাদের স্মৃতিরা মগজের ভিতর ঘুমিয়ে থাকে অকাতরে।

তবুও একেকদিন ওর ভারী ইচ্ছে করে লাউপাতায় সিদল শুটঁকি রান্না করতে। এসব রাঁধলে কেউ খাবে না জেনেও ওর ইচ্ছে করে। করলেই কি আর হয়! বউ মানুষের শাড়ির সাধ থাকতে আছে, নোলকের সাধ থাকতে আছে, তাই বলে জিভের সাধ! এই তো আর কদিনে মাঠে মাঠে লালতে শাক উঠবে, তখন সেই লালতে শাকের রসুন দিয়ে ঝোল আর লালতে শাক ভাজা। কেন রে, লালতের গিঁট চচ্চড়ি খেলে কি তোদের জাত যাবে? যাবেই তো। শ্বশুর ঘরে এসে থেকে ও শুনেছে, এ বাড়ির রান্না শিখে নে বউ। শিখেছেও সেসব। শিখতে শিখতে ওর জিভ আর মাথা কেবলই ফিরে গেছে কোন সে টিলা পাহাড় আর উপত্যকা পেরিয়ে হাওড়ের দেশে, বিল, বিলানের দেশে। সেই যেখানে এমন দিনে মাছ দিয়ে সরিষা শাকের হাতে মাখা ভর্তা খায় লোকে! সেই দেশে। কিন্তু সে তো আর ওর দেশ নয় এখন! এখন ওর স্বাদ কাহনে রাষ্ট্রেরও খানিক খানিক ভূমিকা আছে। একেকদিন সেসব পালিয়ে বুড়ি আতপ চাল বাটা দে, নারকেল কোরা দে চালতার অম্বল রাঁধে। সে অম্বলে মিশে থাকে নতুন গুড়ের গন্ধ। বুড়ো, বুড়োর ছেলে, ছেলের বউ সেসব ভালোবেসেই খায় কিন্তু ওরাও জানে এসব রোজের রান্না নয়। একটা দেশ পালানো মেয়ের খামখেয়ালীপনা এসব। খেয়াল মিটে গেলেই মেয়েটা আবার ফিরে আসবে অনুশাসনের আওতায়। বুড়ি এসব ভেবে ভেবে খানিক দুস্কু পায় বইকি, তবু দুস্কু নিয়ে সংসার চলে না। বুড়ি তাই শাউড়ির মতো করে ডাল রাঁধে পোনকা শাক দে, মুলোর টক রাঁধে। খেতে বসে বুড়ো খুশি হয়। বুড়োর ব্যাটা খুশি হয়। বুড়ো সুরুক সুরুক করে বাটিতে চুমুক দে টকের ঝোল খায়। বলে, 'বউ কাল শোল মাছ দে ঝাল টক রাঁধিস তো।' বুড়ি এসব কথার উত্তর দেয় না। বলে, 'আরও খানিক ভাত দেবো তোমায়?'

ভাত দিতে দিতে বেলা আরও খানিক বাড়ে। বুড়ির বউমা এসে পাশে বসে এতক্ষণে। এবারে শাউড়ি বউতে মিলে খাবে, এঁটো সকড়ির পাট চোকাবে। সেসব মিটলে পাটি পেতে বসবে বুড়ি। বসে বসে ও পাড়ার বিলের ঠাকুমার সঙ্গে গল্প করবে, হাতে হাতে পানের বাটা এগিয়ে দেবে। এবারে সরস্বতী পুজোয় গোটা সেদ্ধর বাজার কী হবে, কোন হাড়ি ঝালাই করতে দিতে হবে এসবই সে গল্পের সার। সে গল্পে শুনতে শুনতে কেউ টেরও পাবে না, আস্ত একখানা দেশ মাথার মধ্যে নিয়ে, আস্ত একটা জীবন কেমন কাটিয়ে দিল বুড়ি। বেমালুম।

More Articles