ফাউন্টেন পেনের অসুখবিসুখে আজও ভরসা পেনডাক্তারের হাসপাতাল

'এ দোকান আমার মা হয় দাদা। আমায় কেউ প্রচুর টাকা দিলেও এ-দোকান ছেড়ে কোথাও যাব না। চাকরির অফার আমার আছে। বেশ কয়েকটা কোম্পানি বলে রেখেছে। কিন্তু, সেসব তো ব্যাঙ্গালোর, মুম্বই। আজ আমার দোকানকে এক ডাকে সকলে চেনে। সেটা ছেড়ে দিয়ে কী করে যাই বলুন।'

এমনটাই বলেছিলেন তিনি। তারপর বিক্ষেপে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ডুবে গেলেন কলমের অরণ্যে। তাঁর চিবুকের উপর এসে পড়ল রেম্ব্রাঁর কোনো পেন্টিংয়ের মতো শীতদুপুরের আলো। প্যালেট হাতে দাঁড়িয়ে শিল্পীর সামনে আর কী-ই বা থাকে? স্টুডিওর নীরবতায় তো দাঁড়ায় থাকেন শুধু তিনি, তাঁর নিকটবর্তী ক্যানভাস, আর একঘর আলো-আঁধারি একাকিত্ব। শিল্পী আবার  কখনও হয়ে ওঠেন মদন তাঁতি। ভুবনে ঘোষালের সমস্ত দয়াদাক্ষিণ্যকে তোপের মুখে উড়িয়ে তাঁত বোনার যন্ত্র হাতে তিনি একাই পাড়ি দেন ভাবের অজ্ঞাতবাসে। ঠিক সেভাবেই অজ্ঞাতবাসের দ্বিতীয় পাণ্ডব হয়ে, ভবানীপুর অঞ্চলের একটা ছোট্ট ঘরের ভেতর  ঘাড় গুঁজে, সকাল থেকে রাত অবধি ফাউন্টেন পেনের চিকিৎসা করে চলেন দিলীপবাবু। দিলীপ বসাক, কলকাতার কলমপ্রেমীদের কাছে যিনি সুপরিচিত 'পেন ডক্টর' নামে।

নেতাজী ভবন মেট্রো স্টেশনের দু'নম্বর গেট দিয়ে বেরলেই চোখে পড়বে বুড়ো বটগাছের পাতায় ঢাকা একটা লাল-হলুদ সাইন বোর্ড। তার উপর লেখা রাস্তার নাম, ‘দেবেন্দ্র ঘোষ রোড’। এ-রাস্তা ধরে সোজা চলে যাওয়া যায় হরিশ মুখার্জি রোডের দিকে, কিন্তু আমাদের গন্তব্যস্থল এই সরলরৈখিক যাত্রাপথের একপাশে পড়ে থাকা একটা কলম কারখানা। সাইনবোর্ডহীন এই কারখানার বাইরে যে কোনও সময়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে ভেতরে মাঝবয়স পেরনো এক প্রৌঢ় মন দিয়ে বিগত শতাব্দীর গন্ধমাখা কয়েকটা ফাউন্টেন পেন নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছেন। এ-দোকান সম্বন্ধে পাড়াপড়শিরা প্রায় কেউই কিছু বলতে পারেন না। ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে তাঁরা অবাক বিস্ময়ে তাকান, 'পেন? তা, একজন তো সারায় বলে জানতাম, কিন্তু দোকানটা তো ঠিক বলতে পারছি না।' কেউ কেউ আবার মনে করেন দোকানটা উঠেই গেছে। সেখানে  নাকি এখন স্টোভ, মিক্সি মেরামত করা হয়। কিন্তু, সকলের অলক্ষ‍্যে থেকে বহাল তবিয়তেই ঝরনা কলমের কারিগরি করে চলেছেন কলমের জাদুকর দিলীপ বসাক।

ছোটবেলা থেকেই বাবাকে কলম সাড়াতে দেখতেন দিলীপবাবু। তখন অবশ্য তাঁর স্কুলে যাওয়ার বয়স। রঙ বেরঙের, সোনালি রূপোলি নিব লাগানো ওই পেনগুলো খুব টানত তাঁকে। মনে মনে ইচ্ছে হত, কাজ শিখব,তারপর একদিন বাবার মতো হয়ে ব্যবসাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। একদিন বাবাকে গিয়ে বললেন পর্যন্ত, কিন্তু তিনি নারাজ। 'এখন তোমার পড়াশুনো করার বয়স। আগে পড়াশুনো শেষ করো, তারপর দেখা যাবে,' এই বলে স্বপ্নিল স্পৃহায় বুক বাঁধা পুত্রকে সাময়িকভাবে দমিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু এবার উদ্যোগী হলেন দিলীপবাবুর মা। তাঁরও সাধ, বাবার সমস্ত কারিগরি বিদ্যেগুলো ছেলে শিখুক। তারপর মাথা উঁচু করে সেগুলো বহন করে নিয়ে যাক।

এই ভেবেই তিনি প্রস্তাব করলেন, ছেলের পড়াশুনো চলুক, কিন্তু তার পাশাপাশি কাজ শিখুক সে। এমন করেই বাবার হাত ধরে প্রথম কলম মেরামতির কাজে আসা দিলীপ বসাকের। তখন অবশ্য ফাউন্টেন পেনের এমন দুর্দশা ছিল না। বাজারের এক চেটিয়া আধিপত্য সে সময় দখল করে বসেনি বল পয়েন্ট পেন। তারপর যুগ পাল্টাল, আশি নব্বইয়ের দশক থেকে ঝরনা কলমের ব্যাবহার এলো কমে। ল্যাজলো জোসেফ বিরোর মস্তিষ্কপ্রসূত ইউজ এন্ড থ্রো বল পেন পৌঁছে গেল বাঙালির ঘরে ঘরে। কম্পিউটারের আবির্ভাবের ফলে বাঙালি কাগজ কলমকে ভুলে গেল। গড়ে উঠল টাইপিং কালচার, কলমের ভাগ্যে জুটল দুয়োরানির অবহেলা। বাহুল্যকে আর কেই বা পুষে রাখতে চায়? তাকে ছেঁটে ফেলে মেদমুক্ত স্লিম ফিট আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্তি নিয়েই তো চলে দুনিয়াদারির যুদ্ধ।

কলম মেরামতির পাশাপাশি দিলীপবাবু এখন মনোযোগ দিয়েছেন কলম বানানোর কাজে। পুরনো মডেলের ধাঁচে অবিকল বানিয়ে তুলছেন নতুন ধরনের ঝর্ণা কলম। বেশ কিছু কোম্পানির সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা চলছে। এমনকী বাংলাদেশেও নিজের তৈরি কলমের একটা বাজার তৈরি করতে চাইছেন তিনি। এ কাজে তাঁর একমাত্র সহকারি তাঁর কন্যা। বর্তমানে সে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ল কলেজে পাঠরত। ব্যক্তিগত অর্ডারভিত্তিক কাজও করেন দিলীপবাবু। তাঁর কাছে গিয়ে শুধু বলতে হবে মডেলের নাম এবং নম্বর, তারপর খুবই অল্প সময়ের মধ্যে হাতে এসে যাবে ম ব্লাঁ বা শেফার্সের অননুকরণীয় সমস্ত রেপ্লিকা। এই কারনেই দিলীপ বসাক আক্ষরিক অর্থে একজন ম্যাজিসিয়ান। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বললেন, 'আপনি যে কোনও মডেলের কলম আমায় দিন। একবার দেখেই বলে দেব পেনটা কবে তৈরি, ভেতরে কী ধরনের পার্টস আছে। মানে, আমার এতদিন এসব ঘেঁটে ঘেঁটে এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে আর দু'বার ভাবতে হয় না।'  নামীদামি কোম্পানির সঙ্গে  নিজের ১০/৪ এর কলম কারখানাতে বসে পাল্লা দিয়ে চলেছেন দিলীপবাবু। এখানেও তিনি মনে করিয়ে দেন এক কিংবদন্তির কথা। তাঁর নাম, জন উইলিয়াম হেনরি। উনিশ শতকে মেশিনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ছেনি হাতুড়ি হাতে একা লড়েছিলেন হেনরি, তারপর কালে কালে হয়ে উঠেছিলেন উপকথার নায়ক।

দোকানের বাইরে একফালি চাতালে দাঁড়িয়ে, আশেপাশের ব্যস্ত কোলাহলের মধ্যে দিলীপবাবু যখন শুনলেন, তাঁকে নিয়ে একটা স্টোরি করতে চাই, তাঁর মুখে ফুটে উঠল খই ছড়ানো হাসি। মায়া মাখা গলায় প্রশ্ন করলেন, 'আমার খোঁজ পেলেন কোথা থেকে?' শোনা যায়, পাঁচশো বছর ধরে নানান নথিপত্র ঘেঁটে মোনালিসার হাসির একাধিক অর্থ উদ্ধার করেছিলেন তাত্ত্বিকরা। কিন্তু এ কলমখ্যাপার হাসিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বোধহয় কোনো মনোজ্ঞ মস্তিস্কের নেই। এ হাসি তো কবিতার মতো। তার সূচনায় 'বন্দিনী এক বাঘিনী চিতা'-র অপারগ চেয়ে থাকা, আর বাকিটা 'রোগা শালিকের বিবর্ণ হৃদয়ের ইচ্ছার মতো', ম্লান। 

More Articles