শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ, আজ ভারতের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, ডক্টর লালের যাত্রাপথ অবাক করবে

যার কেউ নেই তাঁর ঈশ্বর আছেন। আর ঈশ্বরই তাঁকে রক্ষা করবেন সব বিপদ থেকে - এমনটাই বিশ্বাস অরবিন্দ লালের। আদ্যোপান্ত একজন আধ্যাত্মিক মানুষ অরবিন্দ লাল। হয়তো অভিজ্ঞতাই তাঁকে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। যে বছর উত্তরাখণ্ডে বন্যা হল সেবার নবরাত্রি পালনের জন্য রানিখেতে ১১ দিনেরও বেশি সময় কাটিয়েছিলেন এক আশ্রমে। ছুটি কাটিয়ে যেদিন দিল্লি ফিরলেন তারপর দিন থেকেই শুরু প্রবল বৃষ্টি, ভূমিধ্বস। বন্যার আকার নেয় পরিস্থিতি। মৃতের সংখ্যা ৬০ এরও বেশি। রানিখেত আজও রাজ্যের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। লালের মতে এ ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া আর কিছুই নয়,হতে পারে না। পাঠকেরা এতক্ষণে নিশ্চয় খানিক কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন এই অরবিন্দ লাল কে? অরবিন্দ লাল আর কেউ নন, ডক্টর লাল প্যাথ ল্যাবের বর্তমান মালিক। ২০২১ সালে ফোর্বসের তৈরি একশো ধনী ভারতীয় ব্যক্তিদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। স্থান ৮৭ এবং মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২.৫৫ বিলিয়ন ডলার।

শুরুর সময়

অবিভক্ত ভারতের রাওলপিন্ডে থাকতেন ডাক্তার এসকে লাল। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি। তবে স্বাধীনতার আগেই অবসর নেন এসকে লাল। দেশভাগের সময় দিল্লিতে চলে আসেন তাঁরা।সেখানে দু'বছর সরকারি ল্যাবরেটরিতে কাজ করার পর নিজের সেন্ট্রাল ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি নামে একটি প্যাথলজি ল্যাব খোলেন। অরবিন্দের কথায়, 'সে সময়ে কোনো বেসরকারি ল্যাব ছিল না, সবটাই সরকারি। ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে পথচলা শুরু এই ল্যাবরেটরির। আমার জন্মও সেবছরের আগস্ট মাসে। তাই বলা যায় আমি এবং এই ল্যাব সমবয়সি'। তবে ছেলে অরবিন্দ লাল স্বপ্নেও ভাবেনি বাবার তৈরি এই ল্যাবের সাথে যুক্ত হওয়ায় কথা।

লালের স্বপ্নভঙ্গ

আড়াই বছর বয়সে অরবিন্দকে দিল্লির বারাখাম্বা রোডের নামকরা মডার্ন স্কুলে ভর্তি করা হয়। এমনিতেই প্রিম্যাচিওর সন্তাত, তার উপর মায়ের চোখের মণি লালের খুব অল্প বয়সেই ছাত্রজীবন শুরু হয়ে যায়। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়েই ঠিক করে ফেলেন বড় হয়ে নৌবাহিনীর ফাইটার পাইলট হবেন। তাঁর কথায়, আমি শুধু উড়ানের স্বপ্ন দেখতাম'। সেইমত নৌবাহিনীর ন্যাশানাল ক্যাডেট কর্পসে ভর্তি হন এবং সেরা ক্যাডেটের পুরস্কারও পান। দশম শ্রেণীর পর প্রতিরক্ষা বিভাগে নিয়োগের জন্য যে পরীক্ষা দেন তাতেও উত্তীর্ণ হন লাল। কিন্তু মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় ক্ষীণদৃষ্টির কারণে বাদ পড়েন। অন্যান্য বিকল্প পদে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকলেও তাঁর ফাইটার পাইলট হবার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। তবে তিনি আর নৌবাহিনীতে যোগ দেননি। পরে সেই স্বপ্ন ভঙ্গের কথা মনে করে লাল বলছেন, আমি '১৫ বছর বয়সেই নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছিলাম'।

এরপর পরিবারের এক সদস্যের পরামর্শ মতো জীব বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে লাল দিল্লির দয়াল সিং কলেজ থেকে মেডিক্যালের একটি ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর পুণের সেনা হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। তখনও পর্যন্ত ভাবেননি বাবার ল্যাবে কাজ করবেন। কিন্তু বাবার মৃত্যু অরবিন্দের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বাবা এসকে লাল তাঁর ভাই অরুণের হাতে খুন হয় বলেই তাঁর পরিবারের দাবি। এরপরই ল্যাবের দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন ডঃ অরবিন্দ লাল।

ডক্টর লাল প্যাথল্যাবের পথচলা

১৯৭৭ সালে বাবার ব্যবসার সাথে যুক্ত হন অরবিন্দ। তখন খুব বেশি হলে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী ল্যাবে রক্ত পরীক্ষার জন্য আসতেন। পাশাপাশি তিনি  সেখানে ডাক্তারি এবং প্যাথলজির ছাত্রদের পড়াতেনও। শুরুর দিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, 'আমি যে সময় এই ল্যাবের দ্বায়িত্ব নিই সেই সময় কোনো বেসরকারি ল্যাবে থাইরয়েড পরীক্ষা করা হতো না কারণ এই পরীক্ষায় পারমাণবিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যবহার করা হত।তাই এই পরীক্ষার খুঁটিনাটির দায়িত্বে ছিলেন মুম্বাইয়ের ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টার। লাল এবং তাঁর স্ত্রী এই অফিসের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সেখানে থাইরয়েড পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নেন। তারপর ১৯৮২ সালে নিজের ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা চালু করেন। ভারতে এই প্রথম কোন বেসরকারি ল্যাবে এই পরীক্ষা চালু হল। সেবছরই এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীদের ড্রাগ পরীক্ষার জন্য এই ল্যাবকে  স্ট্যান্ডবাই ল্যাবরেটরি হিসেব বেছে নেওয়া হয়।

লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা, লিভার ফাংশন পরীক্ষার জন্যও এই ল্যাবের কথা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় মেশিন, উন্নত প্রক্রিয়া এবং কম্পিউটারের ব্যবহার মানুষের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলে।কিছুদিনের মধ্যেই লাল ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসায় ঢুকে পড়েন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তিনিই প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা নিয়ে আসেন বাজারে। ১৯৯৫ সালে সেন্ট্রাল ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরির নাম বদলে করেন ডক্টর লাল প্যাথল্যাব। ২০০১ সালে দিল্লীর বাইরে প্রথম ল্যাব নির্মাণ করেন গুরুগ্রামে। এই মূহুর্তে ভারতে ২৩৪ টি ল্যাব রয়েছে লালের। ২০০৪ সালে মার্কিন সংস্থা কোয়েস্ট ডায়াগনিস্টিকের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেও তা খুব বেশি লাভজনক হয়নি তাঁর কোম্পানির জন্য। ২০০৫ সালে ওয়েস্ট ব্রিজ ক্যাপিটাল সংস্থার সিইও ২৬ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন যা কোম্পানির ব্যবসাকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। ২০১০ সালে টিএ অ্যাসোসিয়েট সংস্থার ১৬ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। ২০১৩ সালে কোম্পানির বাজার মূল্য দাঁড়ায় ১৭৫০ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট দলে যোগ দেন ওম মনছন্দা , ফলে কোম্পানি লাভের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে।

২০১৫ সালে কোম্পানির আয় ৭০% বৃদ্ধি পায় এবং লাভের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। বর্তমানে দুটি পদ্ধতিতে ব্যবসা রয়েছে সংস্থার। প্রথমত, ল্যাবে পরীক্ষা করাতে আসা রোগী এবং দ্বিতীয়ত বিভিন্ন হাসপাতালের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের নমুনা পরীক্ষা করা। আজ একদিনে ৭০ থেকে ৮০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হয় লালের বিভিন্ন ল্যাবে।

তবে এখনো ভারতের একাধিক জায়গায় স্থানীয় ল্যাবরেটরির সাথে যথেষ্ট প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয় তাঁর সংস্থাকে। অরবিন্দ লালের মতে, 'আমরা উত্তর, পূর্ব এবং মধ্য ভারতের বাজার ধরতে সক্ষম হলেও দক্ষিণ ভারত এখনও অধরা থেকে গিয়েছে। তাই আমরা চেষ্টা করছি নতুন ধরনের বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়ে আসতে যাতে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া যায়। এই মুহূর্তে আমরা ভারতের বৃহত্তম হিস্টোপ্যাথলজি ল্যাব এবং কিডনি বায়োপসি পরীক্ষার দ্বিতীয় বৃহত্তম ঠিকানা'। করোনাকালে প্রায় ৩ মিলিয়ন কোভিড নমুনা পরীক্ষা করেছে লালের ল্যাব। গত এক বছরে কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধির পরিমাণ ১০,০০০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ফোর্বসের একশো ধনী ভারতীয়দের তালিকায় এসেও নির্লিপ্ত লাল। তাঁর কথায়,'পরের বছরেই তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দিন। নিজের সম্পদ নিয়ে কথা বলব এমনটা আমার স্বভাব নয়। এখনো অনেক পথ চলা বাকি'।

তবে বর্তমানে লালের লক্ষ্য দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা। দগদগে ঘা নিরাময়ে বা কার্বন মনোক্সাইডের যে বিষ দেশের বহু নাগরিকের শরীরকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে তাঁদের জন্য হাইপারবেরিক অক্সিজেন থেরাপির ব্যবস্থা করা। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সিয়াচেনের  জওয়ানদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখাও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার তালিকায় রয়েছে। লালের কথায়, 'আমি সারাজীবন ধরে মনে প্রাণে নিজেকে একজন সেনা হিসেবে ভেবে এসেছি।এখন সময় এসেছে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেবার'।

২০১৯ সালে ডঃ অরবিন্দ লালকে ভারতীয় সেনাবাহনীর পক্ষ থেকে ব্রিগেডিয়ার সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।২০০৯ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারও দিয়েছেন ভারত সরকার।

More Articles