পুজোর কেনাকাটা শেষ হয় না শ্রীলেদার্স ছাড়া! শূন্য থেকে শুরু করে আজ একশো কোটির কোম্পানি

Sreeleathers: আজ বাঙালির দুর্গাপুজোর কেনাকাটা শেষ হয় না শ্রীলেদার্স-এর জুতো ছাড়া।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে মাস্টারদা সূর্য সেন ৬৫ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুণ্ঠনে উদ্যত হন। ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সিতে অবস্থিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সময় তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, যথাসম্ভব অস্ত্র লুঠ করার সঙ্গে এলাকার সম্পূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। ওই রাতেই পুলিশের অস্ত্রাগারের দখল নেয় মাস্টারদা এবং তাঁর সঙ্গীরা। গোলাবারুদ না পেলেও অস্ত্র লুঠ করে বেরনোর সময় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় অস্ত্রাগারে। তাঁদের পরবর্তী মিশন ছিল চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। মাস্টারদা এবং তাঁর সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নেন, সারারাত পায়ে হেঁটে দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই শহরে পৌঁছবেন। কিন্তু ব্যর্থ হয় সেই পরিকল্পনা, এবং জালালাবাদের ঘন জঙ্গলে আশ্রয় নেন তাঁরা। ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এসে পৌঁছয় জালালাবাদে। প্রবল যুদ্ধ হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে।

সেদিন মাস্টারদার সেই দলের একজন সদস্য ছিলেন ২১ বছর বয়সি এক তরুণ সুরেশচন্দ্র দে। ব্রিটিশের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে গুরুতর আহত হন সুরেশ। জীবন বাঁচাতে দলের সদস্য শান্তি নাগ সুরেশকে কাঁধে করে নিয়ে কাছের গ্রামে পৌঁছন। ব্রিটিশ বাহিনী ওই এলাকায় সংগ্রামীদের খোঁজে চিরুনিতল্লাশি শুরু করেন। প্রথমদিকে সুরেশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচলেও এক বছরের মাথায় গ্রেফতার হয় ওই তরুণ। জেলে ব্রিটিশদের প্রলোভনে পা দেননি বলে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয় তাঁকে। বেশ কয়েক বছর পর ছাড়া পেলেও দীর্ঘদিন গৃহবন্দি ছিলেন সুরেশ। পরে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে পূর্ব পাকিস্তানের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে জামশেদপুরে পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। জানা যায়, সেনাবাহিনীর পাহারাতেই বিয়ে সেরে ছিলেন সুরেশ। প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এই তরুণ শুরু থেকেই নিজের ব্যবসা স্থাপনের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু কী করবেন, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তখনই মাথায় আসে জুতোর ব্যবসা শুরুর কথা। সেসময় খুব অল্পসংখ্যক ভারতীয় মানুষই পায়ে জুতো পরতেন। জুতো পরার চল ছিল মূলত ইউরোপীয় এবং অভিজাত ভারতীয়দের মধ্যে। তাছাড়া সেইসময় জুতোর যা দাম, তাও ছিল ভারতীয়দের নাগালের বাইরে। ফলে এবড়োখেবড়ো,পাথুরে কিংবা প্রচণ্ড তপ্ত বা কাঁটাযুক্ত রাস্তায় দীর্ঘকাল খালি পায়েই হেঁটে বেড়িয়েছেন ভারতীয়রা। এহেন পরিস্থিতিতে সুরেশ তাঁর দেশবাসীর জন্য সস্তায় টেকসই জুতো তৈরির স্বপ্ন দেখেন। ১৯৫২ সালে বাস্তব রূপ পায় সুরেশের বহুদিনের ইচ্ছে। সে-বছর জামশেদপুরের একটা ছোট দোকান থেকে শুরু হয় আজকের শ্রীলেদার্স-এর পথচলা। নিজের কোম্পানি শুরুর আগে বেশ কিছুদিন বাটা কোম্পানিতে কাজ করেছিলেন সুরেশচন্দ্র দে। ধীরে ধীরে জামশেদপুরে এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শ্রীলেদার্স-এর জুতো।

সুরেশচন্দ্র দে-র তিন ছেলে শেখর, সত্যব্রত এবং আশিস পরে এই ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বড় ছেলে শেখর জামশেদপুর, বিষ্টুপুর এলাকার দোকানের দ্বায়িত্ব নেন। ছোট ছেলে আশিস সাকচি স্টোর এবং স্টিলের শহরে হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। সত্যব্রত ১৯৮৫-'৮৬ সাল নাগাদ চলে আসেন কলকাতায়। বাবার তৈরি জুতোর ব্যবসার 'শ্রীলেদার্স' নামটি নিয়েই ধর্মতলার লিন্ডসে স্ট্রিটের ১০০ বর্গফুটের একটি দোকানে কাজ শুরু করেন। তখন মাত্র সাত ধরনের জুতো পাওয়া যেত এই দোকানে। প্রথম বছর মাত্র দেড়শো টাকার জুতো বিক্রি হয়। দ্বিতীয় বছর মোটামুটি ভিড় জমতে থাকে লিন্ডসে স্ট্রিটের দোকানে। পরের দু'-তিন বছরের মধ্যে শ্রীলেদার্স-এর নাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। লাইন দিয়ে জুতো কেনার জন্য ভিড় পড়ে যেতে থাকে দোকানের সামনে। আজ সেই দোকান ৩৫০০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে অবস্থিত। ওই এলাকাতেই হগ মার্কেটের ঠিক উল্টোফুটে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে রয়েছে শ্রীলেদার্স-এর আরও একটি শোরুম। প্রথম দিকে সত্যব্রতই ছিলেন সেলসম্যান, ক্যাশিয়ার, সুইপার। অর্থাৎ, সব নিজে হাতেই সামলাতেন। ১৯৮৯ সালে বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী শিপ্রা দে স্বামীকে ব্যবসায় সাহায্য করতে শুরু করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্ত জল করে খেটে ব্যবসা গড়ে তোলেন সত্যব্রত। আজ বাঙালির দুর্গাপুজোর কেনাকাটা শেষ হয় না শ্রীলেদার্স-এর জুতো ছাড়া। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পুজোর জন্য জুতো কেনা বাঙালির দুর্গাপুজোর খুব পরিচিত এক ছবি। শিপ্রা দেবীর কথায়, "যে বছর থেকে পুজোয় লাইন দিয়ে জুতো কেনা শুরু হয় সে বছর মনে হয়েছিল বাইরের থেকে দোকানের ভিতরে মনে হয় বেশি ভিড়।"

দামে কম, অথচ ভালো মানের জুতো তৈরি করাই শ্রীলেদার্স-এর ইউএসপি। সেলসের পাশাপাশি জুতো তৈরির বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখেন কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আজ ১০০ কোটির কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে শ্রীলেদার্স। কম দামে ভালো মানের জুতো, ব্যাগ, বেল্ট সবকিছুর জন্যই আজ সকলেরই প্রথম পছন্দ শ্রীলেদার্স।

কলকাতা ছাড়াও দেশজুড়ে ৩০টি আউটলেট রয়েছে শ্রীলেদার্স-এর। কলকাতার ধর্মতলায় দু'টি আউটলেট ছাড়াও কলেজ স্ট্রিট ও গড়িয়া হাট চত্বরে আউটলেট রয়েছে শ্রীলেদার্স-এর। পূর্ব ভারতের সবথেকে বড় জুতোর শোরুম রয়েছে এই কোম্পানির। গ্রিসের ৩০০ দোকানে জুতো রফতানি করে শ্রীলেদার্স। সত্যব্রত দে-র মেয়ে রচিতা দেও যোগ দিয়েছেন বাবার ব্যবসায়। রচিতার গলায় শোনা গেল, ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ প্রান্তে অনলাইনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে কোম্পানি। একশো শতাংশ দেশীয় এই জুতোর কোম্পানি কলকাতাবাসীর অন্যতম প্রিয়। তাই তো বাঙালির কাছে পুজোর জুতো মানেই শ্রীলেদার্স।

More Articles