অষ্টাদশ শতকের চিকিৎসা

উনিশ শতক বাংলার ক্ষেত্রে এক নবজাগরণের সময়। বলা চলে, এই সময়েই আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে বাংলায়। এই আধুনিকতার কিংবা নবজাগরণের জন‍্য যে অনেকাংশেই  পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং সংস্কৃতি দায়ী, একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এই নবজাগরণের সময়েও কিন্তু কলকাতার পরিবেশ বিশেষ স্বাস্থ্যকর ছিল না। ম‍্যালেরিয়ার প্রকোপে প্রাণ যেত  অসংখ‍্য নাগরিকের আর ঠিক এর এক শতাব্দী আগেও শহরের চিকিৎসাব্যাবস্থা ছিল নৈব নৈব চ । ১৭০৫ সাল অবধি শহরে ডাক্তার ছিল মাত্র একজন,  হাসপাতালের কোন দেখা ছিল না ১৭০৭ সাল অবধি। এরপর ইংরেজদের দৌলতে হাসপাতাল একটা হয়েছিল বটে, কিন্তু অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন চোখে পড়েনি। হ‍্যামিলটনের ভাষায়, কলকাতায় হাসপাতাল একটা আছে বটে, অনেকেই সেখানে যায় – কিন্তু চিকিৎসার বিবরণ দিতে বেরিয়ে আসেন খুব কমজন।  

  সুতরাং অষ্টাদশের কলকাতাকে সাক্ষাৎ যমপুরী বলাই যায়। যে ছেলেটি কলকাতা দর্শন করবে বলে সন্ধ‍্যায় পা রেখেছিল শহরে, দেখা যায় পরেরদিন সন্ধ‍্যায় সে আর বেঁচে নেই। কিছু এমনটাই ছিল সেসময়ের কলকাতা। হ‍্যামিলটন সাহেব লিখেছেন, ‘ একবছর আমি কলকাতায় ছিলুম। ওটা ছিল আগস্ট মাস। মিলিটারি সিভিলিয়ান এবং নাবিকে মিলে শবারো লোক ছিল শহরে। জানুয়ারির প্রথমে দেখা গেল, এর মধ‍্যেই কয় মাসে মৃত‍্যু-রেজিস্টারে নাম উঠেছে চারশ ষাটজনের।’  সকাল হলে কে বেঁচে থাকবে আর কে থাকবে না, বোঝা বড়ো মুশকিল। তাই ইংরেজরা বছরের একটি দিনকে বেঁছে নিয়েছিল, যাঁরা সারাবছর অতিক্রম করে এই শহরে টিকে থাকবে  তাঁরা এইদিনে সবাই একসাথে আনন্দে মেতে উঠবে বলে। এ যেন হিসাব মেলানোর‌ই এক নামান্তর মাত্র। বছরের সেই দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর। সেসময় কলকাতায় বসবাসকারী লোকেদের  তিনভাগের মধ্যে দুভাগের‌ই ছিল পেটের সমস‍্যা। সম্ভবত কলকাতার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ‌ই ছিল এর মূল কারণ। কলকাতার পথঘাটগুলি ছিল অপ্রশস্ত এবং আবর্জনায় পরিপূর্ণ। ১৭৬৯ সাল পর্যন্ত পয়ঃপ্রণালীগুলি উন্মুক্ত অবস্থাতেই ছিল। কলকাতায় মারা যেত ইংরেজ এবং নেটিভ উভয়‌ই। ইংরেজরা মারা যেত বেশি খাবার ফলে আর নেটিভরা মরত না খেয়ে। মৃত‍্যুর কারণ ছিল ম‍্যালেরিয়া, পাক্কা জ্বর, রক্ত আমাশা কিংবা কলেরা।  

  কিন্তু তাই বলে কি শহরে ডাক্তার-বদ‍্যির অভাব ছিল! একেবারেই নয়। শোনা যায়, সে সময়ে ডাক্তার এবং উকিল, এই দুই পেশার লোকই ছিল বেশি। বাকি যারা ছিলেন, তারা ছিলেন দোকানী আর কিছু সরকারি চাকুরিজীবি। সেকালে যারা ডাক্তার-বদ‍্যি ছিলেন তাদের কোন পড়াশুনা ছিল না, ছিল না কোন ডিগ্ৰিও। অবস্থা এমনই ছিল যে, কাগজের রোগী কেটেও ‘সার্জন’ হিসাবে মান‍্যতা পেতেন তাঁরা। ব্ল‍্যাক টাউনে অর্থাৎ নেটেভদের পাড়ায়, চিকিৎসা বলতে সবকিছুই চলত। যেমন – কবিরাজি, ঝাঁড়ফুক, তাবিজ- কবচ কিংবা হেকিমি। ওষুধ বলতে ভালুকের লোম, পাখির ঠোঁট, সাপের চোখ এছাড়া গাছগাছলা তো আছেই। অনেকে আবার ডাক্তার হতেন কেবল কয়েকখানি বক্তৃতা শুনেই। কলকাতার সেসময়ের ডাক্তার প্রসঙ্গে বলা হত, আজ হয়তো যিনি ডাক্তারি করে পয়সা রোজগার করতেন, গতদিন তিনি কাজ করতেন জাহাজের খালাসি হিসাবে। তাই কলকাতার নেটিভদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না চোরঙ্গি পাড়ার সাহেবরা। তাঁরা আবার বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। তাই তাঁরা চিকিৎসা করাতেন ইংল‍্যান্ডের পন্থায়। তা কী ছিল সেই পন্থা? চলুন একবার জেনে নেওয়া যাক।  

  একথা উনিশ শতকের। ১৮৬৪ সালে একটি হাসপাতালের রোগীর চিকিৎসার রেকর্ডে কিছু চিত্র ফুটে উঠছে। একজন অসুস্থ রোগী জ্বর নিয়ে ভোরবেলা ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। বেলা ১টায় তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। শুরুতেই তাঁর দেহ থেকে ১ পাইন্ড মতো রক্ত ফেলে দেওয়া হয়, এরপর আবার বেলা ২টোর সময় আগের মতোই ১পাউন্ড রক্ত ফেলে দেওয়া হয়। এরপর খেতে দেওয়া হয় তেল আর নুনের ঘন্ট। পরেরদিন সকালে খেতে দেওয়া হয় ক‍্যাস্টর ওয়েল।  এখানেই শেষ নয়, এরপর :

‘ At 7a.k. 16 oz blood was taken away and antimonial wine in camphor mixture was prescribed. At noon 18 leeches were applied to the right side; at 9 a.m. the patient was bathed in perspiration and blister was applied to the epigastric.’

অতঃপর দুপুরেই রোগী শেষ নিশ্বাস ত‍্যাগ করলেন। বর্তমানে যেকোন মানুষের‌ই এই প্রেসক্রিপশন পড়ে মনে হবে অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে রোগীর মৃত‍্যু হয়েছে। কিন্তু তত্কালীন সময়ে এই ছিল বিজ্ঞানের বহর। মনে করা হত, শরীরে রোগের প্রধান কারণ শরীরে থাকা বিষাক্ত রক্ত। অত‌এব শরীর থেকে রক্ত বের করা চাই। রক্ত নিষ্কাশনের মাধ‍্যম হিসাবে ব‍্যবহার করা হতো জোঁকের।

  এই ডাক্তারদের কিন্তু রোগীর অভাব বিশেষ হতো না। রীতিমতো বাড়ি থেকে আদর আপ‍্যায়ন করেই মোটা টাকার বিনিময়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হতো রোগীর বাড়িতে। বছর বছর টাকার গদির উপর শুয়ে দিব‍্যি আরামের সঙ্গে দিন কেটে যেত ডাক্তার-বদ‍্যিদের আর বছর বছর মানুষ টাকার অভাবে এবং সঠিক চিকিৎসার অভাবে ব্ল‍্যাক টাউন থেকে চৌরঙ্গি পাড়ার মারা যেতেন অসংখ‍্য মানুষ। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে কয়েকশো বছর, কলকাতার আনাচে কানাচে গেলেই এখনও দেখা মেলে তাবিজ নিয়ে বসে থাকা মানুষের, তাঁদের ক্রেতার অভাব আজও হয়তো বিশেষ হয় না।

 

তথ্য সূত্র-

  • শ্রী পান্থ রচিত ‘কলকাতা’।
  • স্বপন বসু রচিত ‘বাংলার নবচেতনার ইতিহাস’।

 

More Articles