পুতুলবাড়ি থেকে রাইটার্স বিল্ডিং, কলকাতার হানাবাড়িগুলোর হাড় হিম করা গল্প

কলকাতা শহরকে ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ আখ্যা দিয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাও সে আজকে নয়, বহু যুগ আগে। বাংলার ‘নির্জনতম কবি’র সাধের কল্লোলিনীর আজ বয়স বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩২। তার বুকের উপর গড়ে উঠেছে হাই টেক মল থেকে আরম্ভ করে পেল্লায় সব হাইরাইজ। প্রশ্ন হল, এমতাবস্থায় কলকাতার ভূতেরা যাবে কোথায়? ফ্যাতাড়ু সিরিজের ‘দণ্ডবায়সে’র বয়সি পুরনো বাড়ির অভাব নেই কলকাতায়। সে সমস্ত বাড়িগুলোতে আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে যে সূক্ষ্ম দেহে ছায়াময় প্রাণীরাও বাস করে এমনটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু এই গোলকায়নের যুগে এ সকল ছায়াময়দের ভবিতব্য কী? প্রকাশ্য দিবালোকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সুযোগ বা সামর্থ্য তাদের নেই। অতএব, শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা হানাবাড়িগুলোর অন্ধকারে ঘাড় গুঁজেই দিন কাটায় তারা। এমন কিছু হানাবাড়ির গল্পই বলতে চাইছি।

পুতুলবাড়ি

বিস্তৃত গঙ্গার উপর দিনের আলো নিভে আসছে। কষ্ট করে তাকালে দূরে দেখা যাবে বালি ব্রিজ। গঙ্গার ওপারে ঝিকমিকে আলো। জেটির উপর হাওড়াগামী যাত্রীদের ভিড়। এ অবস্থায় আপনি হেঁটে চলেছেন, বাগবাজার মায়ের ঘাট থেকে শোভাবাজারের দিকে। হঠাৎ বাঁ দিকে আপনার চোখ গেল, দেখলেন আদ্যিকালের পেল্লায় একটা বাড়ি গোধূলির আলোয় নিস্তব্ধে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর একটা পাথরের মূর্তি। সময়টা বড় সুবিধের নয়। এমন আসন্ন অন্ধকারের বেলাকে  নিয়েই তো ম্যাকবেথের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘Now o’er the one half world, nature seems dead and wicked dreams abuse the curtain’d sleep. Witchcraft celebrates Pale Hecate’s offerings….’ আপনার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।

‘পুতুলবাড়ি’ নামে বিখ্যাত এই প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকে। শোনা যায়, এ বাড়ির মালিকের কন্যা পুতুল খেলতে খুব ভালোবাসতেন। সেই কারণেই  বিভিন্ন ধরনের পাথরের মূর্তি দিয়ে গোটা বাড়ি সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। পুতুলবাড়ির সৌন্দর্যে স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত হতেন পাড়া-পড়শিরা। কালে কালে বাড়ির মালিকানা গেল কলকাতার এক বড়লোক বাবুর হাতে। সে সময়কার বাবু সমাজ কতটা উচ্ছৃঙ্খল ছিল তা আজ আর নতুন করে বলে দিতে হয় না। সেই নিয়মেই পুতুলবাড়ির নতুন মালিক বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অল্পবয়সী মেয়েদের এই বাড়িতে তুলে এনে তাঁদের উপর যৌন নির্যাতন চালাত। পুতুলবাড়িতে একবার এলে সেখান থেকে আর কেউই বেঁচে ফিরতেন না। নির্যাতন চালিয়ে সেই বাড়ির কোনও ঘরেই তাঁদের পুঁতে দেওয়া হত। বলা হয়, নির্যাতনের শিকার হওয়া এ সকল মেয়েদের অতৃপ্ত আত্মা আজও এ বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়।

যদিও, বাড়ির ভাড়াটেরা দাবি করেন যে এমন কোনও ভৌতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তাঁরা হননি। দিন কয়েক আগে একদল মানুষ ইন্টারনেট থেকে নানান তথ্য সংগ্রহ করে ভূত দেখার অভিপ্রায়ে রাত-দুপুরে তাঁদের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। এতে তাঁরা অত্যন্ত বিরক্ত হন, এবং বাধ্য বাড়ির বাইরে একটা সাইনবোর্ড লাগান, যাতে লেখা আছে, ‘এ বাড়িতে কোনও ভূত নেই।’

রাইটার্স বিল্ডিং

টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে এক মনে কাজ করছেন কলোনেল সিম্পসন। হঠাৎ ঝড়ের বেগে তাঁর ঘরে তিনজন যুবক প্রবেশ করলেন। তাঁদের মধ্যে একজন উদ্যত রিভলভর হাতে গর্জন করে উঠলেন, ‘pray to god Colonel, your last hour is coming’ । এক ঝাঁক গুলির শব্দ, তারপরেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন সিম্পসন। বিনয়, বাদল, দীনেশের কাণ্ড-কারখানার এমনই বর্ণনা পাওয়া যায় শৈলেশ দের ‘আমি সুভাষ বলছি’ গ্রন্থে। এমন বহু রোহমর্ষক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে কলকাতার একসময়কার প্রশাসনিক কেন্দ্র, রাইটার্স বিলডিং।

দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীদের অভিযোগ, সন্ধের পর থেকেই নাকি বাড়িতে ভৌতিক ব্যাপার স্যাপার ঘটতে থাকে। বন্ধ ঘরের ওপার থেকে শোনা যায় টাইপরাইটারের শব্দ। দূর থেকে ভেসে আসে একাধিক মানুষের গোঙানির শব্দ। ১৯৭০ সালে মুন্সিরাম নামে রাইটার্স বিলডিঙের এক নিরাপত্তা কর্মী জানান সন্ধের পর তিনি নিয়ম মাফিক টহল দিতে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখলেন সাদা স্যুট পরিহিত এক সাহেব ‘সেন্ট্রাল ডিসপ্যাচ অফিস’ থেকে দৌড়ে এসে নীচের দিকে চলে গেলেন। তারপর আর তাঁকে দেখা গেল না। তার পেছন পেছন ছুটে এলো বেশ কিছু ছায়ামূর্তি। এমন ঘটনা দেখে মুন্সিরাম নিজের স্নায়ুর উপর আর দখল রাখতে পারেননি। জ্ঞান হারান তিনি।

রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন

ধরুন দিনের শেষ মেট্রো থেকে নেমে আপনি প্ল্যাটফর্মে পা  রাখলেন। স্টেশন চত্তর মোটামুটি শুনশান। হঠাৎ আপনার চোখে পড়ল অস্বাভাবিক কোনও দৃশ্য। পরক্ষণেই আবার সব আগের মতো। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনে একসময় নাকি ঘটত এমনই সব ভয়াবহ কাণ্ড। তখনো ‘গ্রেটার কলকাতা’র ধারণা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কলকাতা মেট্রোর শেষ গন্তব্যস্থল ছিল টালিগঞ্জ। ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার বেশিরভাগ ঘটনাই সে সময় ঘটত রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনকে কেন্দ্র করে। হঠাৎ করেই শেষ ট্রেনের যাত্রীরা বেশ কিছু ভৌতিক অভিজ্ঞতার  সম্মুখীন হতে আরম্ভ করলেন। হয়ত স্টেশনে নেমে তাঁরা বাইরের দিকে যাওয়ার জন্য সবে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় দেখলেন আবছা একটা ছায়া মূর্তি চোখের সামনে ভেসে উঠেই ফের মিলিয়ে গেল। এমন ঘটনার কোনোরকম যুক্তি আজ পর্যন্ত খুঁজে বের করে উঠতে পারেননি কেউই।

হাওড়া ব্রিজ

সবে ভোরের আলো ফুটেছে। হাওড়া ব্রিজের নীচে মল্লিক ঘাট ফুল বাজারে তিল ধারণের জায়গা নেই। হেলতে দুলতে হাতে মুগুর নিয়ে গঙ্গার ধারে ব্যায়াম করতে এসেছেন একদল কুস্তিগির। আচমকা তাঁদের চোখ গেল জলের দিকে। বিস্মিত হয়ে তাঁরা লক্ষ করলেন, জলের তলা থেকে একটা হাত উঠেই আবার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল। যেন কেউ ডুবতে ডুবতে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটুকু করলেন, কিন্তু পারলেন না। এখনো নাকি ভোরের দিকে হাওড়া ব্রিজের নীচে গেলে এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হন অনেকে। তাঁদের যুক্তি, কলকাতার আদিগঙ্গায় ডুবে আজ পর্যন্ত কত মানুষ  মরেছেন তার হিসেব দিয়ে শেষ করা যাবে না। তাঁদের অতৃপ্ত আত্মারা আর যাবে কোথায়? এই গঙ্গার আশেপাশেই তারা ঘোরা ফেরা করে।

রয়াল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব

এক ছিলেন জর্জ উইলিয়ামস। তাঁর ছিল রেস খেলার নেশা। উইলিয়ামস এর সবচেয়ে পছন্দের ঘোড়ার নাম ছিল ‘প্রাইড’ । প্রাইডের গায়ের রঙ ছিল দুধ সাদা। রেসের মাঠে দুর্দান্ত ছুটতে পারত সে। এভাবে কেটে গেল দীর্ঘ সময়। প্রাইডের বয়স বাড়ল। শরীরের তেজ কমে এলো।আর সে আগের মতো ছুটতে পারে না। হাঁপিয়ে পড়ে অল্পতেই। এমনই একদিন রয়াল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে এক বিশাল রেসের আয়োজন করা হল। সেই প্রথমবার প্রাইড জিততে পারল না রেসে। তার পরদিন রেসের মাঠ থেকে তার মৃতদেহ আবিষ্কার করা হয়েছিল। আজও পূর্ণিমারা রাতে সেই ক্লাবের মাঠে একটা সাদা রঙের ঘোড়াকে ছুটতে দেখা যায়। সে কোত্থেকে এসেছে, তার মালিকই বা কে, কেউ বলতে পারেন না।

এমন বহু আজগুবি গল্প গড়ে উঠেছে কলকাতার হানাবাড়িগুলোকে কেন্দ্র করে। ভূতেদের জমজমাটি বৈভবের দিন আর ফুরিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের মহাফেজখানায়। তবু তাদের গল্পকথাগুলো থেকে গেছে। ভূতে বিশ্বাস থাক বা না থাক, মানুষ ভয় পেতে খুব ভালোবাসে। আর তার ভয় পাওয়ার প্রবৃত্তি যতদিন থাকবে, ততদিন কলকাতার ভূতুড়ে বাড়িগুলোর হিম শীতল কিসসা কাহিনীও থেকে যাবে। 

চিত্রঋণ : noise break.com
তথ্যঋণ: Wikipedia

More Articles