নাজেহাল হয়েছিল ব্রিটিশরা, ফোর্ট উইলিয়াম হয়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্র
বিচিত্র শহর এই কলকাতা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগেও যে স্থান ছিল ম্যালেরিয়ার আঁতুড়, নদীতীরগুলি ছিল পশু আর মানুষের মৃতদেহে পরিপূর্ণ; সেই শহর আজ পরিণত হয়েছে মহানগরীতে। কলকাতার কলকাতা হয়ে ওঠার এই দীর্ঘ সফরে, এই শহর সাক্ষী থেকেছে অনেক ঘটনার, এই শহরের কোলেই জন্ম নিয়েছে অনেক ইতিহাস। কিন্তু কলকাতার বুকেই কিছু ঘটনা এমনও আছে যাকে ইতিহাস আপন করে নেয়নি। এমনই এক ইতিহাস ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লার কলকাতার বুকে স্থাপিত প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ন্যাক্কারজনক পরাজয় ।
১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ , মিরজাফরের বিশ্বাসঘতকতা , কোম্পানির কাছে সিরাজের পরাজয় কিংবা 'বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা'র ক্ষমতা কোম্পানির হাতে স্থানান্তর– এই ইতিহাস আমাদের জানান দিয়ে এসেছে বহু বছর ধরে । কিন্তু সিরাজের সাথে ব্রিটিশদের পলাশি-পূর্ববর্তী যুদ্ধ এবং ইংরেজদের আত্মসমর্পণের কাহিনী এখনো বহুজনের অজানা । অনেকেরই মনে হতে পারে ১৮০০ সালের আগে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রসঙ্গ এলো কোথা থেকে! আসলে ১৮০০ সালে নির্মিত ফোর্ট উইলিয়াম ছিল দ্বিতীয়বারের জন্য স্থাপিত ফোর্ট । বর্তমানে কলকাতা শহরের ডালহৌসির যে স্থানে ইস্টার্ন রেলওয়ের অফিস , সেটি হলো প্রথম ফোর্ট উইলিয়ামের ভগ্নাংশমাত্র। মুঘলদের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধের পর ১৬৯০ সালে কোম্পানির মূল ব্যবসায়িক কর্মকেন্দ্রের স্থল, হুগলি থেকে কলকাতার স্থানান্তরিত করা হয় । ১৬৯৬-১৭০২ সালের মধ্যে স্থাপন করা হয় প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম। স্যর চার্লস আইরি প্রথমে ১৭০১ সালে এই দুর্গের দক্ষিণাংশ নির্মাণ করেন এবং পরের বছর অর্থাৎ ১৭০২ সালে ব্যবসায়িক লেনদেনের কর্মকেন্দ্র স্থাপন করা হয় দুর্গের মধ্যভাগে। ইংল্যান্ডের রাজা উইলিয়ামের নাম অনুসারে এই ফোর্টের নামকরণ করা হয়, "ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ"। ১৭১৩ সালে ‘কোর্ট অব ডিরেকশন’ এই কেল্লার বিষয়ে রায় দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন , নদী তীরবর্তী এই দুর্গটি পরিপাটি এবং জমকালো করে তৈরি করা হলেও, এর ভিত আদৌ অতো পোক্ত নয়। এই অনুমান যে পুরোপুরি সঠিক, তা প্রমাণিত হয় ১৭৫৬ সালে, যখন বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লা রজার ড্রেকের উস্কানিমূলক আচরণের কারণে কলকাতা আক্রমণ করেন।
১৭৫৬ সালের ১৬ জুন পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ করেন সিরাজ। তিনি জানতেন, এই কেল্লা আক্রমণ করা মানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সার্বিকভাবে নাজেহাল করে দেওয়া কারণ কোম্পানির সমস্ত কাজ এই কেল্লা থেকেই সম্পন্ন হয়ে থাকত । এই আক্রমণের আশঙ্কা ড্রেক সম্ভবতঃ আগেই করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি ১১ই জুন রাত ১০টার সময় ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে পালিয়ে যান এবং মৃত্যুর মুখে রেখে দিয়ে যান কয়েক হাজার নরনারীকে । ফোর্ট উইলিয়ামে তখন সেনা সংখ্যা মাত্র পাঁচশো জন । পরাজয় নিশ্চিত জেনেও হলওয়েল সৈনদের বলেন, ফোর্টে মজুত থাকা তিন-তিনটি সিন্ধুক ভর্তি সোনাদানা, গিনি, মোহর তিনি তাঁদের সমান ভাগে ভাগ করে দেবেন, তাঁরা যেন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তখন ফোর্টে উপস্থিত ছিল কয়েক হাজার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, পর্তুগিজ, আরমেনিয়ানসহ বহু নারী এবং শিশু । ২০ জুলাই, দুপুরের আগেই তিন তিনবার সিরাজের সেনা ফোর্টের গায়ে আছড়ে পড়ে এবং তিনি কোম্পানির অবশিষ্ট মানুষদের উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণ করার ইঙ্গিত দেন। বাধ্য হয়ে মাত্র একশত ছেচল্লিশজন নরনারী নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন হলওয়েল। প্রথম নির্মিত জৌলুসপূর্ণ ফোর্ট উইলিয়াম তখন এক ধ্বংসস্তূপ মাত্র। সেদিন ইংরেজদের তৈরি এই কেল্লাকেই তিনি শুধু ধ্বংস করেননি বরং কোম্পানির লোকেদের সকল গর্বকেও ধূলিসাৎ করে সেই ধূলির উপর পা রেখেছিলেন বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লা।
ডালহৌসি স্কোয়ারে ঘটে যাওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই শোচনীয় পরাজয়ের কথা যেমন কলকাতাবাসী মনে রাখেনি, তেমনই এই ঘটনাকে ইতিহাস নিজের কোলে স্থান দেয়নি । অথচ, ইস্টার্ন রেলওয়ের বাড়ির দেওয়ালে মার্বেল পাথরে লেখা আছে, "এইখানে এই পিতলের পাত বরাবর ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের উত্তর পশ্চিম কোণ।"কেল্লার উত্তরসীমায় ছিল সুবিশাল ঘাট ,জোয়ারের দাগ লেগে থাকতো দেওয়ালগুলির গায়ে,পূর্ব সীমায় ছিল নেতাজি সুভাষ রোড। জেনারেল পোস্ট অপিসে গেলে দেখে যায়, গুটিকয়েক খিলান এখনো অবশিষ্টাংশ হিসাবে রয়ে গেছে , চিহ্ন রেখে গেছে ইংরেজ নির্মিত প্রথম ফোর্ট উইলিয়ামের আর যুগ যুগ ধরে বলে গেছে, সিরাজের নিকট কোম্পানির পরাজয়ের গল্প কিন্তু আমরা তা ভালোভাবে শুনতে পাই না বোধহয় ।
তথ্যসূত্র –
শ্রীপান্থ রচিত ‘কলকাতা’
‘banglapedia’ ওয়েবসাইট ।