চাষের জন্য মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে এল দেবীমূর্তি! বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের ধারণা

গাজা, ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন– এই তিনটি স্থানের নাম কোথাও যেন একই সূত্রে গাঁথা। তবে এই গাঁথনের মূলে কোনও সুমধুর সম্পর্ক নেই, বরং রয়েছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস।

গাজা ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলীয় একটা ফিলিস্তিনি ছিটমহল। সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের আগ্রাসন নীতির কারণে গাজা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এতদিন ধরে ইহুদিরা বলতেন, গাজা স্ট্রিপের কোনও ইতিহাস নেই। আবার অনেকের মতে, অতীতে এই স্থানে কোনও মানুষই নাকি বসবাস করতেন না। কিন্তু সম্প্রতি গাজার চাষভূমি থেকে আবিষ্কৃত একটি পৌরাণিক চুনাপাথরের ভাস্কর্য,  ইহুদিদের এত বছরের ধারণাকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।   

প্যালেসটাইনের নিদল আবু ইদ নামে এক কৃষক, ইউনিসের আল-কারারা শহরে তাঁর চাষভূমি খনন করার সময় হঠাৎই একটি কর্দমাক্ত মূর্তির মাথা খুঁজে পান। তাঁর কথায়, "আমি যখন আমার জমি চাষ করছিলাম, তখন এটি পাই। প্রথমে এটি কর্দমাক্ত ছিল, কিন্তু যখন আমি এটিকে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলি, তখন আমি বুঝতে পারি যে, এটি একটি মূল্যবান জিনিস। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আমি এটি বিক্রি করে দিয়ে কিছু টাকা আয় করতে পারব, কিন্তু পরে একজন প্রত্নতাত্বিক আমাকে বলেন, এই মূর্তিটি আসলে একটি অমূল্য প্রত্নতাত্বিক সম্পদ।"

আরও পড়ুন: এশিয়ার একমাত্র গ্রিক কবরস্থান আছে কলকাতাতেই! অনাদরের ইতিহাস চোখে জল আনবে

গাজায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে, ডিরেক্টর জেনারেল অব আন্টিকিউটিস অ্যান্ড কালচার হেরিটেজ মিনিস্ট্রি জামাল আবু রিদা বলেছেন, গাজায় আবিষ্কৃত ২২ সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এই মূর্তিখানি আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। প্রত্নতাত্বিক বিভাগের মত অনুযায়ী, কেনানীয় যুগের পুরাণ শাস্ত্রে ভালবাসা, সৌন্দর্য এবং যুদ্ধের দেবীর নাম ছিল অনাত। নিদল আবু ইদ নামক ওই কৃষক চাষের জমি থেকে যে দেবীমূর্তির মাথা আবিষ্কার করেছিলেন, তা দেবী অনাত-এর মূর্তি। এই মূর্তির মাথায় একটি কুণ্ডলীকৃত সাপের অবয়ব দেখতে পাওয়া যায়। অনেকের মতে আবার, এই সাপ হল শক্তির প্রতীক।

জামাল আবু রিদা এই মূর্তি প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, 'এই মূর্তি যে সভ্যতারই নিদর্শন হোক, এই ভূমি নিয়ে জিওনিস্টদের মিথ্যে দাবিকে তা নস্যাৎ করে।'

চলুন জেনে নেওয়া যাক, এই কেননীয় যুগ আসলে কী?

কেননীয় যুগের নামটি এসেছে কেনানাইন ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে। কেনানাইন ধর্মটি অনেক পুরানো সেমিটিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। এই যুগে বসবাসকারী মানুষেরা মূলত পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন, পৃথিবীতে তখন একেশ্বরবাদ তেমনভাবে আসেনি বললেই চলে। ব্রোঞ্জ যুগের প্রথমদিকে কেননীয়রা এই ধর্ম পালন করতেন। কেননীয় ধর্ম কখনও ছিল বহু ঈশ্বরবাদী, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেশ্বরবাদীও। এই ধর্মের সঙ্গে মেসোপটেমিয়াম এবং ইজিপশিয়ান ধর্মের বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যায় এবং অনুমান করা হয়, এই ধর্মটি মেসোপটেমিয়াম এবং ইজিপশিয়ান ধর্মের অনুকরণেই সৃষ্টি হয়েছিল। এই যুগের প্রেম, ভালবাসা এবং যুদ্ধের প্রধান সেমিটিক দেবী ছিলেন অনাত। তিনি অতীব সুন্দরী এক নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রাচীন গ্রন্থে তাঁকে চিরকুমারী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননীয় যুগের দেব-দেবীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন এই দেবী অনাত। তিনি তাঁর যৌবনশক্তি এবং যুদ্ধ হিংস্রতার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি মিশরীয় রাজা দ্বিতীয় রামসেসের রাজত্বকালে (১২৭৯-১৩১৩ খ্রিস্টপূর্ব) জনপ্রিয়তার শিখরে অবস্থান করতেন। রাজার প্রিয় দেবী হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রজাদের মধ্যেও ক্রমেই তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, নানা ধর্মীয় কারণে দেবতা রেশেফের সঙ্গে দেবী অনাতের নাম বহু ক্ষেত্রে জড়িত ছিল। যদিও পুরাণ অনুযায়ী, মূলত বাল নামক এক দেবতার মৃত্যু এবং তার পুনরুত্থানে দেবীর ভূমিকার জন্যই তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। হিব্রু শব্দ বাল-এর অর্থ হল মালিক বা প্রভু। তিনি কেননীয় যুগে উর্বরতার দেবতা হিসাবে পূজিত হতেন। দেবী অনাত, বালের মৃত্যুতে খুবই শোকগ্রস্ত হয়ে পরেন এবং অবশেষে তিনি বালকে নরক থেকে পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিলেন। মিশরীয় পুরাণে অনাতকে আবার একজন নগ্ন দেবী হিসাবেও দেখানো হয়েছে, মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ী দেবী সিংহের ওপর বিরাজমান ছিলেন এবং হাতে থাকত একটি ফুল। হেলেনিস্টিক যুগে, দেবী অনাত এবং আস্টার্টে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে আটারগাটিস নামে এক দেবতা হিসেবেও পূজিত হত বলে কথিত আছে। অনাত একজন দক্ষ যোদ্ধা হওয়ার কারণে তাঁকে অনেকেই গ্রিক দেবী এথেনা-র সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।    

 

 

More Articles