শোনা যায়, প্রেতাত্মার রাজত্ব এখানে! যে অলৌকিক কাহিনি জড়িয়ে এই রাজবাড়ির সঙ্গে

নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর লেখা 'বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস' গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে, ময়নাগড় এক সময়ে 'ধর্মমঙ্গল' কাব্যগ্রন্থের লাউসেনের রাজধানী ছিল।

ময়না রাজার মান


 গজনা রাজার ধান

কুচল ঘড়ুইয়ের পাকা

দে নন্দের টাকা।


এককালে অভিজাত পরিবারগুলিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় লোকজনদের মুখে মুখে ছড়া ও প্রবচন প্রচলিত ছিল। কিন্তু ময়না রাজবংশ শুধু প্রবাদেই তাঁদের অস্তিত্ব স্বীকার করে যায়নি, সঙ্গে কিংবদন্তি, ইতিহাস ও মঙ্গলকাব্য প্রসঙ্গে বারবার ধরা দিয়েছে ময়নার রাজারা। এঁরা নাকি চিরকালই অভিজাত। এঁদেরই রাজধানী 'ময়নাগড়'। ময়নার রাজবংশের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস। তমলুক থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রাচীন রাজপরিবার সম্পর্কে আজও প্রচলিত প্রবাদ, ছড়া লোকের মুখে মুখে ফেরে।

নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর লেখা 'বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস' গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে, ময়নাগড় এক সময়ে 'ধর্মমঙ্গল' কাব্যগ্রন্থের লাউসেনের রাজধানী ছিল। শুধুমাত্র মঙ্গলকাব্যেই নয়, লাউসেনের সঙ্গে ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গৌড়েশ্বর ধর্মপালের সেনাপতি কর্ণর পুত্র ছিলেন এই লাউসেন। কিংবদন্তি অনুসারে, ধর্মঠাকুরের কৃপায় লাউসেন না কি এই ময়নাগড়েরই পশ্চিমদিকে সূর্যোদয় দেখিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গ বাদে ইতিহাসের ভিত্তিতে জানা যায় যে, লাউসেনের পরবর্তীতে পরিত্যক্ত ময়নাগড় জনৈক জলদস্যু শ্রীধর হুইয়ের দখলে যায়।

কথিত আছে, ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়ক পাল বংশের রাজা লাউসেন ময়না দুর্গের প্রতিষ্ঠাতা। মতান্তরে দ্বিতীয় মহিপাল (৯৮৮-১০০৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই একাধিক নদীবেষ্টিত দ্বীপের মতো স্থানে জলদুর্গটি তৈরি করেন। পাল বংশ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বহুদিন ময়নাগড় পরিতক্ত ছিল। তখন সেখানে ছিল জলদস্যু আর ডাকাতের আনাগোনা। অনেক পরে উৎকল (বর্তমানে উড়িষ্যা) রাজাদের দ্বারা অধিকৃত হয় ময়নাগুড়ি। বাহুবলীন্দ্র রাজাদের অধীনস্থ জনৌতি দন্ডপাটের সদর দপ্তরকে, বালিসিতাগড় থেকে ময়নাগড় দুর্গে স্থানান্তরিত করা হয়।

আরও পড়ুন: এই মন্দিরের আদলেই নির্মিত দক্ষিণেশ্বর! হুগলি জেলার ইতিহাস বিস্মিত করে

ইতিহাস বলে, গৌড়ের অধিপতি দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে, যুদ্ধে পরাজিত কর্ণসেন তাঁর অধীনেই সেনভূম ও গোপভূম অঞ্চল শাসন করতেন। গৌড়েশ্বরের মন্ত্রীর নাম ছিল মহম্মদ। মহম্মদ ছিলেন অত্যন্ত কুচক্রী। তাঁর ষড়যন্ত্রে সোম ঘোষ নামে এক অনুগত প্রজা কারাগারে বন্দি হয়। পরবর্তীকালে এই সোম ঘোষের সঙ্গে গৌড়েশ্বরের গাঢ় বন্ধুত্ব হলে, মহারাজা সোম ঘোষকে রাজপাট, ঘোড়া, একশো দেহরক্ষী ইত্যাদি প্রদান করেন। এরপর এই মহম্মদের ষড়যন্ত্রে সোম ঘোষের পুত্র ইছাই ঘোষ কর্ণসেনের সঙ্গে যুদ্ধে, তাঁকে পরাজিত করে এবং তাঁর ছয় পুত্রকে বিনাশ করে রাজ্যের অধিকার নেয়। পুত্রশোকে কাতর কর্ণসেনের মহিষী বিষপানে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার ফলে গৌড়েশ্বর মহীপাল অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে কর্ণসেনকে দক্ষিণবঙ্গের অংশবিশেষ (ময়নামণ্ডল) রাজত্ব প্রদান করেন। তিনি আগমন করেছিলেন কংসাবতীর শাখানদী কালিন্দীর জলপথে। এরপর কর্ণসেনের নতুন রাজধানী হল 'কর্ণগড়', যা পরে 'ময়নাগড়' নামে বিখ্যাত হয়।

Moynagarh palace

কর্ণসেনের দ্বিতীয় পত্নী রঞ্জাবতী বাঁকুড়ার রামাই পণ্ডিতের উপদেশে ধর্মঠাকুরের তপস্যা শুরু করেন। ধর্মঠাকুরের তপস্যার ফলে লাউসেনকে পুত্ররূপে লাভ করেন। লাউসেন 'লবসেন' বা 'লাম্বাদিত্য' নামে খ্যাত ছিলেন। এরপর লাউসেন অজয় নদীর তীরে ইছাই ঘোষকে নিহত করে পিতৃরাজ্য উদ্ধার করেন। এর ফলে লাউসেনের সাম্রাজ্য বীরভূম থেকে ময়নাগুড়ি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এই ময়নাগুড়িতে লাউসেনের কীর্তিসমূহ এখনও বিদ্যমান। রঙ্কিনী কালী মূর্তি লাউসেন দ্বারা পূজিতা হতো। এই মূর্তি লাউসেনের বৌদ্ধধর্ম প্রীতিকে স্পষ্ট করে।

উৎকল-রাজ কপিলিন্দ্রদেবের রাজত্বকালে তাঁর অন্যতম সামন্ত রাজা কালিন্দীরাম, কেলেঘাই নদীর তীরবর্তী বালিসিতাগড়ের সামন্তরূপে রাজত্ব করতেন। এই কালিন্দীরামের পঞ্চম পুরুষ গোবর্ধনানন্দ জলদস্যু শ্রীধরপুর হুইকে পরাজিত করে ময়নাগর দখল করেন। সেই সময় তৎকালীন উৎকলরাজ মহারাজা হরিচন্দন ময়নাগড় দখল করতে আসেন, সকল সামন্ত রাজা বশ্যতা স্বীকার করলেও গোবর্ধন সামন্ত খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন। এর ফলে মহারাজা হরিচন্দন যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং গোবর্ধন সেই যুদ্ধে পরাজিত হন। বন্দি গোবর্ধনের বীরসুলভ দাপট এবং সংগীতসাধনা উৎকল রাজের কানে পৌঁছয়। তিনি সসম্মানে গোবর্ধন সামন্তকে মুক্ত করেন এবং বীরযোদ্ধাকে রাজ সম্মানস্বরূপ, সিংহাসন, রাজছত্র, চামর, ডঙ্কা, রাজচিহ্ন, যজ্ঞোপবীত এবং 'বাহুবলীন্দ্র' উপাধি প্রদান করেন। সেই সঙ্গে তিনি অধিকৃত বালিসিতাগড় তথা ময়নাগড়কে স্বাধীন রাজত্বরূপে ঘোষণা করেন।

বাহুবলীন্দ্র গোবর্ধন সামন্ত প্রতিষ্ঠিতি প্রাচীন রাজবাড়ির নির্মাণশৈলীতে বৌদ্ধ এবং উড়িষ্যার স্থাপত্যরীতির যৌথ শৈল্পিক নিদর্শন দেখা যায়। সেই সময় জলদস্যুদের প্রবল আক্রমণ ছিল। রাজ্যকে এর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সামন্তরাজ বাহুবলীন্দ্র গোবর্ধন মূল বসতবাড়িটিকে কেন্দ্র করে চারিদিকে দ্বিস্তরীয় ধাঁচে গভীর পরিখা খনন করান। ঠিক যেন দ্বীপে অবস্থিত মূল রাজবাড়িটি। পরিখাদু'টি কালিদহ এবং মাকড়দহ নামে পরিচিত। গড়সমেত কালিদহের পরিমাপ ৫,৬২,৫০০ বর্গফুট এবং দৈর্ঘ্য ৭৫০ ফুট। মাকড়াদহের পরিমাপ ১,৪০০ ফুট‌। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এই দহদু'টিতে কুমির ভর্তি করে রাখা হতো, গড়ের সুরক্ষার জন্য। পাড়ে এখনও আছে কাঁটা-বাঁশঝোপের জঙ্গল। ময়নাগড়ে ঢুকতে গেলে এখনও এই নদীপথে নৌকো নিয়ে যেতে হয়। এখানে আছে একটি বিশালাকার অদ্ভুত তেঁতুল গাছ, স্থানীয় লোকজন এবং বর্তমান বাহুবলীন্দ্রদের বংশধররা বিশ্বাস করেন, ওই তেঁতুল গাছটিতে ব্রহ্মদৈত্য বাস করে এবং তার প্রমাণও নাকি তাঁরা নিয়মিত পান, এমনটাই দাবি।

More Articles