রাশিয়া বনাম ইউক্রেন: মানবতা হারানোর যুদ্ধে বড় চরিত্র ক্রিপ্টোকারেন্সি

"সবাইকে শুভ সন্ধ্যা। আমাদের পার্টির প্রধান এখানে আছেন। আমাদের প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেসনের প্রধান এখানে আছেন। প্রধানমন্ত্রী সিম্হাল এখানে আছেন। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক এখানে আছেন। রাষ্ট্রপতি এখানে আছেন। আমরা এখানে আছি, আমাদের সেনা এখানে আছেন, দেশের নাগরিকরা এখানে আছেন। আমরা সবাই মিলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করছি, দেশকে রক্ষা করছি এবং এই কাজ থেকে বিরত হবো না। ইউক্রেনের রক্ষাকর্তাদের জয় হোক।"

এই বার্তাটা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির। রুশ মিসাইল রাজধানী কিভে বোমাবর্ষনের মাঝে, রুশ সেনার উত্তর কিভ দখল করে নেওয়ার দাবির মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে ইউক্রেনের রাষ্ট্র প্রধানের বার্তা দিলেন দেশবাসীকে, বিশ্বকে। সামরিক অভিযানের পাশাপাশি আরও একটি ছদ্ম লড়াই লড়ছেন তিনি। প্রোপাগান্ডার সঙ্গে লড়াই, ভুয়ো খবরের বিরুদ্ধে লড়াই। একেবারে ময়দানে নেমে খণ্ডন করলেন তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার রটনা। রাজধানী কোনোমতেই শত্রুর হাতে যেতে দেবেন না তিনি। তিনি কূটনৈতিক আলোচনায় রাজি, কিন্তু তা শত্রুর ঘাঁটি বেলারুসে কোনো মতেই নয়।

রাশিয়া সেই সুযোগে ইউক্রেনে তাদের সামরিক অভিযানের ধার আরো বাড়াতে চাইছে। রুশ সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ইগর কোনাসেন্কভের বক্তব্য, "ইউক্রেন আলোচনার প্রস্তাব খারিজ করায় সেনার সব বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অভিযানের তীব্রতা বাড়াতে।"

একটা বিষয়ে এই মুহূর্তে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। রাশিয়া কোনো অবস্থাতেই তাদের সামরিক অভিযান থামাবে না, যতক্ষণ না ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করছে। একের পর এক আর্থিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞাতেও তাঁরা দমে যাচ্ছেনা। কিন্তু কোন জোরে? সেই আলোচনায় আসব, তার আগে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি কী নিষেধাজ্ঞা চাপালো রাশিয়ার ওপর, তা জেনে নিই।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দুটি বৃহত্তম ব্যাঙ্ক, সবেরব্যাঙ্ক এবং ভিটিবি ব্যাঙ্কের সাথে আরো বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তেরোটি বাণিজ্যিক সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সার্খেই লাভরভের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। শুধু তাই নয়, তারা রাশিয়ার ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আনতে চলেছে এবং আরো বেশ কিছু প্রভাবশালী রুশ ব্যক্তিদের কালো তালিকাভুক্ত করতে চলেছে।

ব্রিটেন রাশিয়ার প্রায় সমস্ত বৃহৎ রুশ ব্যাঙ্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তার সাথে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলি যাতে ব্রিটেন থেকে কোনও ভাবেই আর আর্থিক সহায়তা না পায় তা নিশ্চিত করেছে। সেই সাথে রুশ বিমান সংস্থা এরোফ্লোটকে তারা ব্রিটেনের মাটিতে অবতরণ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

নিষেধাজ্ঞা জারি করার তালিকায় যোগ হয়েছে জাপান, কানাডা, চেক রিপাবলিক, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডেরও নাম।

তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তাঁরা রাশিয়াকে সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে অপারগ। অর্থ আদানপ্রদানের ব্যবস্থা সুইফ্ট নেটওয়ার্ক থেকে রাশিয়াকে তারা আলাদা করছেন না। সেটা করলে হয়েতো রুশ অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভাবে ধসে যেতো। বা, সম্পূর্ণ ভাবে হয়েতো ধসে যেতনা। কিন্তু কী ভাবে?

এই ঠান্ডা যুদ্ধের মোকাবিলা কী ভাবে করছে রাশিয়া?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু রাশিয়ার বিরাট বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার নয়, ক্রিপ্টোকারেনসি ও আরো একটি বড় কারণ রাশিয়ার এই আত্মবিশ্বাসের। তাঁরা বলছেন, রুশ বিত্তপতিরা তাদের অর্থ খুব সহজেই বিটকয়েনের মাধ্যমে ব্লকচেন প্রযুক্তিতে রাখতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা সহজেই এই আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারবেন।

ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে রুশ অর্থমন্ত্রক তাদের পার্লামেন্টে ক্রিপ্টোকারেনসি নিয়ে বিল পেশ করেন। দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক গুলির আপত্তি এক্ষেত্রে একেবারেই ধোপে টেকেনি। সরকার এত দ্রুত বিল কেন আনল এবং শীর্ষ ব্যাঙ্কদের অগ্রাহ্য করলো তা নিশ্চয়ই আপনার আর বুঝতে বাকি নেই।

ক্রিপ্টোকারেনসি আমাদের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বিরোধী একটি আর্থিক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীভূত। এর কোনো সীমানা নেই, কোনো এক ব্যক্তির হাতে একছত্র ক্ষমতা নেই, সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন আদর্শে তৈরী হওয়া একটি আর্থিক ব্যবস্থাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। যার সুযোগ এই মুহূর্তে রাশিয়া নিচ্ছে। যদিও এখনও ক্রিপ্টোকারেনসির মাধ্যমে সব ধরণের লেনদেন বেশ কঠিন, তাও রাশিয়ার অর্থনীতিকে বেশ ভরসা যোগাচ্ছে বিটকয়েন।

এই বিষয়টি অনুধাবন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীরা ক্রিপ্টোকারেনসির এই সুতোও কেটে দিতে চাইছে। যথেষ্ট কঠিন হলেও তারা বুঝেছে যে এই কাজ করা সম্ভব না হলে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল করা সম্ভব হবে না। দু'জন ব্যক্তি যদি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এই মুহূর্তে লেনদেন করতে না পারেন তাহলে তারা বিটকয়েনের মাধ্যমে সহজেই করতে পারবেন। সুতরাং ক্রিপ্টোকারেনসির ক্ষমতা আশা করি বুঝতে পারছেন। হ্যাঁ, সব ধরণের লেনদেন কঠিন হলেও তারা পরিষেবার বিনিময়ে বিটকয়েন আদানপ্রদান করতে পারবেন।

তবে রাশিয়ার এই ক্রিপ্টোকারেনসি নীতির সবথেকে বড় বিরোধী তাদেরই দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। সরকার যতোই বিটকয়েনকে মান্যতা দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগুক, শীর্ষ ব্যাঙ্ক মনে করে ক্রিপ্টোকারেনসি পিরামিড স্কিমের চাপ বহন করে তাই তাকে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। শীর্ষ ব্যাঙ্কের এই আপত্তি সত্ত্বেও সরকারের তথ্য বলছে দেড় কোটি রাশিয়ান এখনও পর্যন্ত ক্রিপ্টোতে বাইশ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিনিয়োগ করেছেন।

তবে হ্যাঁ, রাশিয়ানদের পক্ষে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিটকয়েনকে রুবেলে পরিণত করা, কারণ আমেরিকা থেকে শুরু করে ব্রিটেন, কানাডা সবাই রাশিয়ার ক্রিপ্টো সম্পদও বাজেয়াপ্ত করতে চাইবে।

কিন্তু মানবতার কী হবে? আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় কি ফিরে আসবে শান্তি? নিরীহ মানুষের প্রাণ? ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের সাহায্যের আর্তি কি শুনছেন ন্যাটোর প্রধানেরা? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি, কিন্তু এটা বলাই যায়, যে বহু চর্চিত ক্রিপ্টোকারেন্সি এবার যুদ্ধের ময়দানেও নেমে পড়ল। 

More Articles