বাড়ির ভেতর সাক্ষাৎ গঙ্গা! অলৌকিক কাহিনি জড়িয়ে এই সিদ্ধপুরুষের সঙ্গে

একেবারেই সাদামাটা একটি মন্দির, 'সিদ্ধসাধক ভগবানদাস বাবাজি মহারাজ প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীনামব্রহ্ম শ্রী মন্দির'৷ রাধাকান্ত জীউর মূর্তি স্থাপিত আছে এখানে৷ এই মূর্তি নির্মাণ করেন হিরুবাবু, ভগবানদাস বাবাজি-র প্রিয় শিষ্য। বাবাজি বলতেন, ভগবানের নামগানেই মুক্তি, নামগানই পরম ব্রহ্ম। তাই মন্দিরের নাম, 'নামব্রহ্ম'।

আড়ম্বরহীন এই মন্দিরেই ছিলেন বিখ্যাত বৈষ্ণব আচার্য সিদ্ধ মহাপুরুষ কৃষ্ণদাস বাবাজির স্নেহধন্য শিষ্য ভগবানদাস বাবাজি। উড়িষ্যাবাসী এই মহাবৈষ্ণব কৃষ্ণদাস বাবাজির চরণাশ্রিত ছিলেন এক তরুণ সাধক, নাম বৈষ্ণব ভগবানদাস৷
গুরুদেবের আশ্রমে থেকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভক্তিশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন, এবং গুরুদেবের নির্দেশে আনুমানিক ১৮২৫সাল নাগাদ তিনি অম্বিকা কালনায় এসে বসবাস শুরু করলেন৷ প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করে তবে তিনি সাধনায় বসতেন৷ কালনায় তিনি প্রসিদ্ধ শ্রীশ্রীনামব্রহ্ম-র বিগ্রহ (রাধাকান্ত জীউ) প্রতিষ্ঠা করলেন৷

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক। তখন ভগবানদাস বাবাজির নামব্রহ্ম-র বিগ্রহ এবং বাবাজির মাহাত্ম্য চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে ৷ প্রতিদিন মন্দির প্রাঙ্গণে অগণিত ভক্ত ও বৈষ্ণবজনের ঢল৷ এই মাহাত্ম্যর কথা বর্ধমানের রাজার কানে পৌঁছতে সময় লাগল না৷

একদিন কালনায় ভগবানদাস বাবাজির ঠাকুরের আশ্রমে ভোগ নিবেদন সবে শেষ হয়েছে, বাবাজি তাঁর জপের ঝুলি ও মালাটি নিয়ে ভজন কুটিরে গিয়ে বসলেন৷ ধীরে ধীরে ধ্যানমগ্ন হলেন৷ তাঁর চোখদু’টি অর্ধনিমীলিত হয়ে গেল৷ জপের মালাটিও থেমে গেল৷ আর ঠিক সেই সময় উপস্থিত হলেন এক বিশিষ্ট দর্শনার্থী,বর্ধমানের মহারাজা৷ রাজামশাই ভজন কুটিরে বাবাজিকে প্রণাম করতে গেছেন, এমন সময় অপ্রত্যাশিত ভাবে বাবাজি জপের মালাটি নামিয়ে রেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, 'ওরে,মার মার, তাড়া তাড়া, ওকে তাড়িয়ে দে শিগগির৷’ আচমকা এই কথা শুনে অপ্রতিভ মহারাজা ভয়ানক ভাবে মুষড়ে পড়লেন৷ তিনি ভাবলেন যে, তিনি বিষয়ী মানুষ, তাই হয়তো সিদ্ধপুরুষ বাবাজি তাঁকে স্পর্শ করতে চান না৷

এর কিছুক্ষণ বাদেই বাবাজি হঠাৎ নীরব হয়ে গেলেন৷ মহারাজা অপেক্ষায় রয়েছেন,বাবাজির ধ্যান ভঙ্গ হলেই তিনি জানতে চাইবেন, একটু আগের আচরণের কারণ। কিছু পরেই চোখ মেলে ভগবানদাস বাবাজি মহারাজাকে দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং বলে উঠলেন, ‘বাবাজির কখন আসা হয়েছে, প্রসাদ গ্রহণ করেছ?'

সামান্য সময়ে এত পরিবর্তন! মহারাজের বিস্ময়ের অবধি রইল না৷ ঠাকুরকে একটু আগের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি কারণ জানতে চাইলেন। তখন এক অদ্ভুত কথা বাবাজি বললেন৷ তিনি বললেন,আমি তো একটু আগে বৃন্দাবনে ছিলাম, ওখানে একটি ছাগলছানা তুলসীগাছগুলোকে খেয়ে নিচ্ছিল, তাই তাড়াচ্ছিলাম৷ তোমাকে তো আমি এখন দেখলাম, তুমি আমার অতিথি, তোমাকে কি তাড়াতে পারি? বিস্ময়ে হতবাক মহারাজা ভাবলেন, এটা কী করে সম্ভব? চোখের সামনে উনি উপস্থিত রয়েছেন, অথচ বলছেন বৃন্দাবনে ছিলেন! মহারাজা বাবাজিকে প্রণাম সেরে বেরিয়ে এসেই ওঁর পরিচিত একজনকে বৃন্দাবনে ‘তার’ করলেন, বিস্তারিত জানিয়ে৷ আশ্চর্য হলেন তিনি উত্তর পেয়ে৷ সত্য কথাই ওই দিন, ওই সময় বৃন্দাবনের গোবিন্দ মন্দিরে গোবিন্দজির তুলসীমঞ্চে উঠে একটি ছাগল গাছ খাচ্ছিল এবং কালনার ভগবানদাস বাবাজি লাঠি হাতে ছাগলটিকে তাড়িয়ে দেন৷ শুধু এই নয়, উনি নাকি প্রায়শই বৃন্দাবনে উপস্থিত থাকেন, একথাও বৃন্দাবনের মন্দিরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

এই অসীম শক্তিধর মহাপুরুষটি যে অলৌকিক শক্তির অধিকারী– তা বিস্মিত মহারাজের বুঝতে বাকি রইল না৷

কথিত আছে, একবার প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কালনায় এলেন ভগবানদাস বাবাজিকে দর্শন করতে৷ তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের একজন বিশিষ্ট আচার্য৷ তাঁর দর্শন পাওয়ামাত্র বাবাজি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন৷ বললেন, গোঁসাইজি তাঁর পরমপিতা শ্রীঅদ্বৈতের বংশোদ্ভূত, পরমপূজনীয়৷ প্রচারবিমুখ, নিরভিমানিতা ও শ্রদ্ধাভক্তির মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি।

১৮৭০ সালে মথুরাবাবুর সাথে বজরায় করে চলেছেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব৷ কালনা ঘাটে এসে নৌকা নোঙর করল রাতের বেলা৷ সকাল হতেই রামকৃষ্ণদেব ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে উপস্থিত হলেন ভগবানদাস বাবাজির আশ্রমে৷ রামকৃষ্ণদেবের পদধূলিধন্য ‘রামকৃষ্ণ সারদাপাঠ মন্দিরটি ভগবানদাস বাবাজির আশ্রমের ঠিক বিপরীতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷

মহাপুরুষ ভগবানদাস বাবাজি মহারাজের আশ্রম কালনায় ‘নামব্রহ্ম বাড়ি’ নামে পরিচিত৷ এই বাড়িটির আরও একটি পরিচয় আছে৷ বাড়িটি কালনায় 'পাতালগঙ্গা' নামে খ্যাত৷ তিনি প্রতিদিন গঙ্গাস্নানে যেতেন, শেষে একভাবে বসে বসে জপতপ করার ফলে ভালভাবে আর হাঁটতে পারতেন না৷ তাঁর অঝোরে কান্না ও আকূল আহ্বানে মা গঙ্গা নিজেই তাঁর বাড়িতে এসেছেন৷ গঙ্গায় যখন জোয়ার আসে, তখন ওঁর বাড়িতে কুয়োর জলেও জোয়ার আসে৷ এই বাড়ির এটি একটি প্রধান আকর্ষণ৷ অনেকটা চোরাকুঠুরির মতো দেখতে৷ সিঁড়ি দিয়ে নামলেই জলের ছোঁয়া৷ ভগবানদাস বাবাজি এই গঙ্গার জলে স্নান করতেন৷ শুধু যে জোয়ারের সময় জল বাড়ে, তাই নয়, এই জলের রং ঘোলা, একদম গঙ্গার মতো৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাপুরুষের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই কিংবদন্তি মন্দিরটি৷ মন্দিরের পিছনেই আছে বাবাজির পুষ্পসমাধি৷

লীলাপ্রসঙ্গকার লিখেছেন (লীলাপ্রসঙ্গ, গুরুভাব-উত্তরার্ধ, পৃষ্ঠা: ১৪৫-৪৬) “শুনিয়াছি একস্থানে একভাবে বসিয়া দিবারাত্র জপ, তপ, ধ্যানধারণাদি করায় শেষ দশায় তাঁহার পদদ্বয় অসাড় ও অবশ হইয়া গিয়াছিল৷ কিন্তু অশীতি বর্ষেরও অধিক বয়স্ক হইয়া শরীর অপটু ও প্রায় উত্থান শক্তি রহিত হইলেও বৃদ্ধ বাবাজীর হরিনামে উদ্দাম ও উৎসাহ, ভগবৎপ্রেমে অজস্র অশ্রুবর্ষণ ও আনন্দ কিছুমাত্র না কমিয়া বরং দিন দিন বর্ধিতই হইয়াছিলো৷”

[তথ্যসূত্র: কালনার জনশ্রুতি ও ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য]

More Articles