বারবার আক্রান্ত হয়েছে জগন্নাথ মন্দির, কিন্তু অক্ষত থেকেছেন দেবতা

ভারতের বিখ্যাত মন্দিরগুলি বরাবর রাজারাজড়াদের সাহচর্য পেয়েছে। প্রচুর টাকা ঢেলে রাজা যেমন ধার্মিক স্বীকৃতি পেতেন, তেমনই মন্দিরে টুকটাক দান করতেন সাধারণ মানুষও। এছাড়াও ছিল ঠাকুরের গয়নাগাটি। সাধারণ মন্দিরে, যেখানে তেমন ধনভান্ডার ছিল না, সেখানে এই গয়নাগাটিই ছিল স্থানীয় আভিজাত্যের অন্যতম নিদর্শন। প্রধানত এই কারণে, মন্দিরের ওপর হামলা হয়েছে বারংবার। লুঠ হয়েছে মন্দির। আজও মন্দির থেকে গয়না চুরির ঘটনা, মঠ থেকে সম্পত্তি লুঠের ঘটনা আকছার শোনা যায়। বিপুল সম্পত্তির চাকচিক্যই প্রতিবার মন্দিরের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও উপাসনাগৃহের সঙ্গে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক থাকেই। ফলে আধিপত্য বিস্তারের নমুনা হিসেবে এক ধর্ম অপর ধর্মের উপাসনাগৃহ গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইতিহাসজুড়ে।

দ্বাদশ শতক ধরে ইতিহাসের অনিবার্য নিয়মের হাত থেকে রক্ষা পায়নি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতো বিখ্যাত মন্দিরও। জানা যায়, এই পর্যন্ত প্রায় ১৮ বার মন্দির লুণ্ঠিত হয়েছে। মূল মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এমন কোনও প্রমাণ যদিও নেই, তবে সম্পত্তি লুণ্ঠন, বিগ্রহ ধ্বংস বা পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা আকছার ঘটত। এসবের মধ্যেও প্রতিবার কোনও না কোনও আশ্চর্য উপায়ে ‘ব্রহ্ম’-টিকে রক্ষা করা হয়। এই ব্রহ্মই নিমকাঠের বিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে।

এই সমস্ত হামলার মধ্যে প্রথম ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টীয় নবম শতকে। অন্তত মন্দিরের ‘মণ্ডলোপঞ্জী’ তেমনটাই বলছে। ‘মণ্ডলোপঞ্জী’ হল মন্দিরের নথি, যাতে যুগে যুগে যাবতীয় পরিবর্তনাদি, উল্লেখযোগ্য ঘটনা ক্রমানুসারে লিখিত হয়ে আসছে। অ্যান্ড্রিউ স্টারলিং নামে এক সাহেব ১৮২২ সালে সেই মণ্ডলোপঞ্জীর লেখা তুলে উদ্ধৃত করলেন, এবং রক্তবাহুর ভয়াবহ আক্রমণের ঘটনা উঠে এল ইতিহাসে। সেই সময় উড়িষ্যার রাজা সুবাহনদেব। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি এমন একটি আক্রমণ পা টিপে টিপে তাঁর রাজত্বের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রপথে উড়িষ্যা উপকূলে পৌঁছে উড়িষ্যার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন রক্তবাহু। সেই আচমকা আক্রমণ সুবাহনদেব ঠেকাতে পারেনি। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজ্যচ্যুত হন তিনি। এই অবস্থায় রক্ষাকর্তাহীন পুরীর মন্দিরে অবাধে লুটপাট চালাতে শুরু করল বিজয়ী সৈন্যরা। তখন যাবতীয় দেববিগ্রহ গোপালিতে লুকিয়ে ফেলা হল। শোনেরপুরের নিকটবর্তী এই গ্রামে মাটির গভীরে সেই বিগ্রহেরা আশ্রয় পেল।

আরও পড়ুন: স্বয়ং জগন্নাথের লীলা না কি অন্য অলৌকিক— পুরীর মন্দিরে যে রহস্যের উত্তর পাওয়া যায়নি আজও 

এখন প্রশ্ন ওঠে, কে এই রক্তবাহু? প্রফেসর কে. সি. পাণিগ্রাহী এঁকে তৃতীয় গোবিন্দ বলেই অভিহিত করেছেন। ডেক্কানের রাষ্ট্রকূট সম্রাট এই তৃতীয় গোবিন্দ। পাণিগ্রাহীর মতে, সুবাহনদেব নামে মণ্ডলোপঞ্জীতে যাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তিনি আদতে ভৌমকার বংশের রাজা প্রথম শুভকরদেব। এসব কথা মনগড়া নয়। প্রমাণও রয়েছে। ৮৩৯ খৃস্টাব্দে রাজা তৃতীয় শুভকরদেবের হিন্দোল লেখ এবং অমোঘবর্ষের সঞ্জন লেখে এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। লেখা আছে তাতে, রাষ্ট্রকূট সম্রাট তৃতীয় গোবিন্দের (৭৯৮-৮১৪) যাবতীয় কারিকুরি। কোশল, কলিঙ্গ, বঙ্গ, দাহলা এবং ওদ্রক–এই যাবতীয় অঞ্চল দখল করেন তৃতীয় গোবিন্দ। কলিঙ্গ বলতে মূলত উড়িষ্যা অঞ্চলকেই বোঝানো হত তখন। তাছাড়া তৃতীয় গোবিন্দের আমলেই যে রাষ্ট্রকূটেরা অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল– ইতিহাস এই ঘটনার সাক্ষী দেয়। কাজেই তৃতীয় গোবিন্দই যে উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন, এই নিয়ে মোটামুটি নিঃসন্দেহ হওয়া চলে। হিন্দোল লেখেও একথা স্পষ্ট লেখা রয়েছে যে, রাষ্ট্রকূটদের উড়িষ্যা আক্রমণ প্রথম শুভকরদেবের আমলেই।

শোনা যায়, রক্তবাহু যখন সমুদ্রপথে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনে উড়িষ্যার নৃপতি স্বয়ং জগন্নাথের যাবতীয় ছবি, বিগ্রহ ইত্যাদি নিয়ে সাঙ্গপাঙ্গ-সহ গোরুর গাড়ি করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এইভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে সেইসব বিগ্রহ গোপালি পৌঁছয়। দীর্ঘদিন তাদের আর কোনও সন্ধান ছিল না। অবশেষে, এই ঘটনার প্রায় ১৪৬ বছর পর, সোমবংশী রাজা প্রথম যযাতি মাটি খুঁড়ে এই বিগ্রহাদি উদ্ধার করেন। পুরীতে নতুন একটি মন্দির তৈরি করে বিগ্রহগুলিকে সেখানে আনা হয়। দীর্ঘদিন মাটির তলায় থাকার ফলে বিগ্রহগুলির অবস্থা তখন খুব একটা ভাল না। সেজন্য সেবায়েতদের সাহায্যে ‘নবকলেবর’ অনুষ্ঠান করেন প্রথম যযাতি। জগন্নাথ মন্দির চত্বরেই মুক্তি মণ্ডপের পাশে আটত্রিশ হাত মাপে ভিত প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ওপর মন্দিরের স্থাপত্যটি নির্মিত হয়। এই বিপুল সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রথম যযাতি ‘দ্বিতীয় ইন্দ্রদ্যুম্ন’ আখ্যা পেয়েছিলেন। এছাড়া সেই গোপালিতেও একটি নতুন মন্দির স্থাপনা করে জগন্নাথের একটি বিগ্রহ রাখা হয়। সোনেরপুর থেকে মাইল ষোলো দূরে সেই গোপালি গ্রাম মূর্তিসহ আজও টিকে রয়েছে। বর্তমানে কোস্তমালির ছাওলিয়া পাহাড়ে তার অবস্থান। এখানে দেবতাদের অবহেলা হয়নি কখনও। রক্তবাহুর শাসনকালে গোপালিতেই প্রতিদিন পুজো পেতেন সেইসব দেবতারা। পুরীর শ্রীক্ষেত্রে তাদের পুনরাবর্তন ঘটে ৮১৪ থেকে ৮১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই।

পুরীর মন্দির আক্রমণের প্রথম নথিবদ্ধ ঘটনাটি খানিকটা এরকমই। এর আগে আক্রমণ হয়ে থাকলেও তার কোনও নথি নেই। তাই বলা যায়, এই প্রথম আক্রমণ এমন এক পরম্পরার সৃষ্টি করবে, যাতে বারবার বিপর্যস্ত হবে জগন্নাথের মন্দির। তবে প্রভু জগন্নাথের কৃপাতেই হোক, বা রক্ষাকর্তাদের সাবধানতায়– ঐতিহাসিক নিদর্শন, ভক্তির পীঠস্থলটি বেঁচে গিয়েছে প্রত্যেকবারই। 

More Articles