চাষের কাজই বদলে দিয়েছে ভাগ্য, শূন্য থেকে শুরু করে আজ লাখপতি মণীশ

Mashroom Farming: ভারতে এই মুহূর্তে যে কয়টি লাভজনক চাষ জনপ্রিয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো এই মাশরুম ফার্মিং। ২০২০ সালে যখন ভারত করোনাভাইরাসের আক্রমণে কার্যত স্তব্ধ, সেই সময়ই নিজের ফার্ম তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মনী...

স্নাতক হবার পরে সকলেই বেরিয়ে পড়েন কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে। কেউ  ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ঝোঁকে, কেউ আবার খোঁজেন রেল কিংবা ব্যাংকের চাকরি। আর চাষবাস? এটা আবার একটা পেশা হলো? ভারত কৃষি নির্ভর দেশ হলেও, ভারতের ৯০ শতাংশ মানুষই কিন্তু এই চাষ বিষয়টিকে খুব একটা ভালো পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু চাষ করেও যে আপনি কিন্তু একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার থেকে বেশি পয়সা রোজগার করতে পারেন। এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন দিল্লি নিবাসী এমবিএ স্নাতক মণীশ যাদব। কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই ২৮ বছর বয়সি যুবক আজ দেখিয়ে দিয়েছেন কী ভাবে নিজের উদ্যোগে ফার্ম তৈরি করে বিশাল ব্যবসা গড়ে তোলা যায়।

কোন ফসলের ব্যবসা করেন মণীশ? কোন ব্যবসায় এত টাকা লাভ রয়েছে? উত্তরটা খুবই সহজ - মাশরুম চাষ। ভারতে এই মুহূর্তে যে কয়টি লাভজনক চাষ জনপ্রিয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো এই মাশরুম ফার্মিং। ২০২০ সালে যখন ভারত করোনাভাইরাসের আক্রমণে কার্যত স্তব্ধ, সেই সময়ই নিজের ফার্ম তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মনীষ। একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মণীশ জানাচ্ছেন, "আমি যেহেতু একজন এমবিএ, তাই বাড়ি থেকে প্রথমেই আমাকে কর্পোরেট চাকরির জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, এই অতিমারি আমার জন্য হয়ে উঠেছিল একটা বরদান। এই সময় যখন ভারত পুরোপুরি স্তব্ধ, সেই সময় আমি শুরু করলাম এগ্রিকালচার ব্যবসা নিয়ে পড়াশোনা। সেখান থেকেই জানলাম এই মাশরুম চাষের ব্যাপারে। আর তার কিছুদিন পর থেকেই শুরু করলাম ব্যবসা।"

একটি ছোট ঘরে ৪ লক্ষ টাকার প্রাথমিক বিনিয়োগ নিয়েই শুরু হয়েছিল মণীশের শ্রী শ্যাম মাশরুম ফার্ম। এই মাশরুম চাষের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানতে মনীষ উজ্বার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে এই মাশরুম চাষ সম্পর্কিত একটি কোর্সও করেন। মনীষ বলছেন, "ভারতে উন্নত মানের কিছু মাশরুম পাওয়া গেলেও, সব থেকে বেশি যে ধরনের মাশরুম ভারতের মানুষ খেতে পছন্দ করেন সেটা হল বাটন মাশরুম। সব থেকে বেশি উপলব্ধ এই মাশরুমটি এই মুহূর্তে ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় মাশরুম। ভারতে আরো অনেক ধরনের মাশরুম উপলব্ধ হলেও, বাটনের বিকল্প নেই। তাই এই মাশরুম চাষ করাই সবথেকে বেশি সুরক্ষিত। পাশাপাশি দিল্লিতে প্রথম থেকেই বাটন মাশরুমের একটা ব্যাপক চল ছিলই, তাই বিক্রি নিয়ে আমাকে কোনদিনই মাথা ঘামাতে হয়নি। মাশরুমের কোয়ালিটিই শেষ কথা বলে। তাই ভালো কোয়ালিটির মাশরুম যদি তৈরি করা যায়, তাহলেই সেটা বিক্রি হতে বাধ্য। তবে তার জন্য কোন কেমিক্যালের অত্যধিক ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন হয় না। একটু বেশি খরচ করে যদি অর্গানিক ফার্মিং করা যায়, তাহলে কিন্তু মাশরুমের স্বাদ এবং মাশরুমের কোয়ালিটি দুটোই হবে দুর্দান্ত। শুধু লাগবে সদিচ্ছা, সঠিক জ্ঞান, এবং উপযুক্ত বিনিয়োগ।"

দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের দিক থেকে মণীশের ফার্ম আকারে ১৬×১৪ ফুট। এই আকারের একটি ফার্ম থেকে মোটামুটি ৩০ টনের মত বাটন মাশরুম চাষ করা সম্ভব। মণীশের কথায়, "আমি লোকাল মার্কেটে এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে আমার মাশরুম নিয়ে যাওয়া শুরু করি। ৫০০ গ্রাম মাশরুমের একটি প্যাকেটের দাম রেখেছিলাম মাত্র ৪০ টাকা। এই দামের মধ্যে এতটা পরিমাণ মাশরুম খুব একটা কোম্পানি দেয় না। এর ফলে আমার বিক্রি করতে সুবিধা হয়। তারপর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যখন মাশরুমের সিজন আসে, সেই সময় প্রত্যেকটি প্যাকেটের দাম ৩০ টাকা করে দেওয়া হয়।" কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের একটি ২০ দিনের টেকনোলজি কোর্স করেই মণীশ আজ এই এই জায়গায় দাঁড়িয়ে। বাকিটা ছিল তার পরিশ্রম এবং সৎ পথে চাষ করার সদিচ্ছা। তবে, ভারতে কিন্তু সব ধরনের মাশরুম চাষ করার খুব একটা ভালো পরিবেশ নেই। সেই সমস্যাকে কিভাবে কাটিয়ে উঠেছিলেন মনীশ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "এই ধরনের মাশরুম ফার্মিং করতে গেলে আপনার সবার আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হল সঠিক মাটি এবং তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ। আপনার ফার্মের তাপমাত্রা যদি খুব বেশি হয়ে যায় তাহলে মাশরুম তৈরি হবে না। তবে অন্য ধরনের চাষের মতো ততটা বেশি জায়গা লাগে না এই মাশরুম চাষ করতে। পাশাপাশি, মাশরুম চাষ খুব একটা কঠিন চাষ নয়। কম খরচে, কম সময়ের মধ্যে এবং কম লোক বলের মাধ্যমেই এই চাষ করা যায়। তুলনামূলক লাভের পরিমাণ বড় চাষের থেকে কম হলেও, মাশরুম চাষ যথেষ্ট লাভজনক।"

আরও পড়ুন-নিজের জমি নেই, তবু চাষে টাকা খাটিয়ে মোটা অঙ্কের লাভ নিশ্চিত করা সম্ভব

তবে শুধু মণীশ একা নন, এই অতিমারির সময়ে অনেকেই নিজের পুরনো চাকরি অথবা ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে এই মাশরুম ফার্মিং এর দিকে মন দিয়েছেন। দিল্লিতে প্রচুর মাশরুম ফার্ম তৈরি হয়েছে বিগত দু'বছরের মধ্যে। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয়টা হলো, যারা এই মাশরুম ফার্ম তৈরি করছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই আদতে কৃষক পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না, এবং প্রায় সকলেই মনীষ এর মতই যুবক ব্যবসায়ী।

দিল্লিতে বেড়ে চলা এই ফার্মিং ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে গিয়েও বেশ আশাবাদী মণীশ। তাঁর কথায়, 'দিল্লির যুব সমাজ যে ফার্মিং ব্যবসাকেও কর্পোরেট চাকরির বিকল্প হিসেবে দেখতে শুরু করেছে, এই বিষয়টা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত মঙ্গলকারী। নব প্রজন্মের মানুষরা যত বেশি কৃষি এবং ফার্মিং এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন, যত বেশি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে যাবেন ভারতের কৃষিকাজকে, ততই ভারতের এগ্রিকালচার ইকোসিস্টেমের জন্য সেটা মঙ্গলের। এর ফলে তৈরি হবে নতুন উদ্যোগপতি, তৈরি হবে নতুন টেকনোলজি, প্রচলিত চাষের পদ্ধতি ছাড়াও এই ফার্মিং হয়ে উঠবে জনপ্রিয়। আরো অগ্রগতি করবে ভারতের কৃষি ব্যবস্থা। কর্মসংস্থানের উপর চাপ কমবে, বেকার সমস্যা থেকেও মুক্তি পাবে ভারত। সর্বোপরি, অন্যান্য দেশের উপর ভারতের নির্ভরশীলতা কমবে, যা প্রভাবিত করবে ভারতের আত্মনির্ভরতাকে।"

এই একটি মাশরুম ফার্ম থেকে এই মুহূর্তে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা রোজগার করছেন মণীশ। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তার ফার্মকে আরো বড় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন এই ব্যবসায়ী। সেই বর্ধিত ফার্মে তৈরি হবে নতুন ধরনের মাশরুম। বাটন মাশরুম ছাড়াও মর্ষেলা, শিটাকে, এনোকির মত নতুন ধরনের মাশরুমও চাষ করার ইচ্ছা আছে তাঁর। ভারতের মাশরুমের ব্যবসাকে আরো বড়ো করে তুলে ধরাটাই এখন তাঁর লক্ষ্য।

রইল আপনার জন্য কিছু স্পেশাল টিপস

১. ভালো মানের মাশরুম চাষ করতে হলে আপনাকে ভালো জাতের বীজ ক্রয় করতে হবে। আপনার কাছের নার্সারি থেকে আপনি ভাল মানের মাশরুমের বীজ পেয়ে যেতে পারেন। সেই বীজ ব্যবহার করে ভালো জাতের মাশরুম তৈরি করা যেতে পারে।

২. মাশরুম চাষের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো ফার্মের তাপমাত্রা। মনে রাখবেন, যদি আপনি মাশরুম চাষের ফার্ম তৈরি করেন, তাহলে তার তাপমাত্রা যেন কোনভাবেই ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে না যায়। তাপমাত্রা কম রাখার জন্য আপনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

৩. মাশরুম চাষ করার জন্য সঠিক জায়গা আপনাকে বেছে নিতে হবে। কমপক্ষে এতটা আয়তনের একটা জায়গা বাছবেন যেখানে এক টন পর্যন্ত মাশরুম তৈরি করা যায়। সঙ্গেই, মাশরুম ফার্ম কখনোই খুব ঘিঞ্জি জায়গায় তৈরি করবেন না। শহর থেকে দূরে, একটু মফস্বল অথবা গ্রামের এলাকায় ফার্ম তৈরি করা ভালো।

৪. যদি আপনি বড় আকারে এই ব্যবসা করতে ইচ্ছুক থাকেন, তাহলে ফার্ম তৈরি করার আগে বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলুন। কারণ সাধারণ ঘরের তাপমাত্রায়, খুব একটা বেশি দিন পর্যন্ত মাশরুম ভালো থাকে না।

৫. এই ব্যবসায় পা ফেলার আগে মার্কেটটা ভালো করে বুঝে নিন।

৬. যারা এর আগে মাশরুম ফার্মিং করেছেন তাদের সাহায্য নিতে পারেন। আপনার এলাকার কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে যদি মাশরুম চাষের উপর একটি কোর্স করতে পারেন তাহলে সব থেকে ভালো হয়। নতুবা কিছু ইউটিউব চ্যানেল থেকেও আপনি আপনার প্রয়োজনের তথ্য পেয়ে যেতে পারেন।

৭. আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী বিকল্প কিছু পথ তৈরি করুন। আপনি যদি মাশরুমের কোয়ালিটি ভালো রাখতে পারেন, তাহলে কিন্তু আপনার মাশরুম বিক্রি হবে। তাই আপনার এলাকার আবহাওয়া, এবং আপনার বাজেট ভালো করে বুঝে নিয়ে তারপরই মাশরুমের ব্যবসা শুরু করবেন।

৮. বড় আকারে এই ব্যবসা করতে ইচ্ছুক থাকলেও প্রথমে একটা ছোট ফার্ম তৈরি করে মাশরুমের ব্যবসা শুরু করা ভালো। তাহলে আপনি ভালো করে বুঝতে পারবেন এই মাশরুমের মার্কেট কিভাবে কাজ করে এবং আপনি কিভাবে আপনার।

More Articles