বাজারে বিকোনো খাঁটি ঘি আদৌ খাঁটি নাকি আদতে বিষ খাচ্ছেন? চোখের নিমেষে বুঝে যাবেন আপনিও

বিভিন্ন নামিদামী কোম্পানি খাঁটি হওয়ার দাবি জানিয়ে ঘি বিক্রি করলেও তাতে আর সেই পুরনো স্বাদ পাওয়া যায় না। তার পিছনে রয়েছে কিছু বিশেষ কারণ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্যবসায়ীদের শ্রীবৃদ্ধির বিষয়টাও।

"কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কি?", প্রাচীন এই বাংলা প্রবাদ কারোরই অজানা নয়। বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে ঘিয়ের গুরুত্বটা অপরিসীম। প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণদের দুপুরের আহারে থাকতো ভাত, গাওয়া ঘি, মধু আর তিল। এই ঘি কে সুখ আর সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।  ঋষি চার্বাক বলে গিয়েছেন, "ঘি খেতে হলে প্রয়োজনে ধার করবে, তবু ঘি খাওয়া ছাড়বে না!" সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও পর্যন্ত এই ঘি রান্নাঘরের এক অপরিহার্য উপাদান হয়ে রয়েছে। বাড়িতে একটু ঘি থাকলে আর রসনাতৃপ্তির কোনো চিন্তা থাকে না। বাড়িতে কিছু রান্না না হলেও একথালা ভাত খেয়ে নেওয়া যাবে এই ঘি এর সাথে। সাথে নুন, কাঁচা লঙ্কা আর আলুভাতে হলে তো কথাই নেই। আম বাঙালির জিভে জল এনে দেবে এই অতিসাধারণ জিনিসটি। তবে বাড়ির প্রবীনদের ইদানিং একটাই অভিযোগ, তাঁদের ছোটবেলার গাওয়া ঘি এর স্বাদ আর এখন কোথায়! আসলে আজকালকার বোতল বন্দি ঘি শুধুমাত্র ট্যাগলাইনে 'খাঁটি' হওয়ার দাবি করলেও, আদতে বেশিরভাগই হয় ভেজাল।

বিভিন্ন নামিদামী কোম্পানি খাঁটি হওয়ার দাবি জানিয়ে ঘি বিক্রি করলেও তাতে আর সেই পুরনো স্বাদ পাওয়া যায় না। তার পিছনে রয়েছে কিছু বিশেষ কারণ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্যবসায়ীদের শ্রীবৃদ্ধির বিষয়টাও। বেশি লাভের জন্য ব্যবসায়ীরা ঘি-এর সঙ্গে মিশিয়ে থাকেন কিছু আলাদা ধরনের ফ্যাট। এগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে হাইড্রোজিনেটেড ফ্যাট, যাকে বেশিরভাগ মানুষ ডালডা হিসাবে চেনেন। এছাড়াও অনেকে এই ঘিয়ের সঙ্গে পাম তেলও মিশিয়ে থাকেন। গন্ধের জন্য কিছুটা ঘি মেশানো হলেও তার পরিমাণ অতি নগণ্যই বলা চলে। এমনকি মোষের দুধের তৈরি দেশী ঘিয়ের মধ্যে অতিরিক্ত রং মিশিয়েও বানিয়ে ফেলা হয় গাওয়া ঘি। অনেক সময় ভেজালের পরিমাণ এতটাই বেশি হয় যে এক কেজি ঘি এর মধ্যে ৬০০ গ্রাম থাকে ডালডা ও ৩০০ গ্রাম পাম তেল। বাকি মাত্র ১০০ গ্রাম থাকে খাঁটি ঘি, যা ব্যবহার হয় শুধু গন্ধের জন্য। অনেকে আবার এই ভেজাল ঘিয়ের সঙ্গে অতিরিক্ত এসেন্স মেশান যাতে ক্রেতারা কেনার সময় টের না পেয়ে যান!

তবে কি এবার বাঙালির পাত থেকে বাদ পড়বে ঘি? না না, অবশ্যই এমনটা নয়। শত ভেজালের মাঝেও আজও কোনো কোনো ব্যবসায়ী বিক্রি করে থাকেন সেরা গুণমানের 'খাঁটি' ঘি। তবে সেটাকে আপনাকে চিনে নিতে হবে। আসলে শরীরের পক্ষে ঘি এর উপকারিতা কখনোই অস্বীকার করা যায় না। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয়দের রান্নায় এবং আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এই বিশুদ্ধ ঘি-এর ব্যবহার হয়ে এসেছে। এর গন্ধ যেমন সুন্দর তেমনই এটি খাদ্যগুণেও ভরপুর। আপনি শুনলে অবাক হবেন যে বিশুদ্ধ ঘি ক্যান্সারের সম্ভাবনাও অনেকটাই কমিয়ে দেয়। এতে রয়েছে বিভিন্ন রকম অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, বিশেষ করে ভিটামিন ই। ঘি-তে থাকা ভিটামিন, মনো আনস্যাচুরেটেড ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে এবং হৃদরোগ কমাতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়া শুষ্ক চামড়া এবং চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে ঘি এর ভূমিকা অপরিসীম। দেহপ্রদাহ কমাতে এবং হজম শক্তি বাড়াতেও এই বিশুদ্ধ ঘি খুবই কার্যকরী। আবার অনেকেই রয়েছেন যাদের দুধ ও দুগ্ধজাত প্রোডাক্টে অ্যালার্জি রয়েছে। আসলে অ্যালার্জির আসল কারণ হল দুধের ল্যাকটোজ শর্করা। যাদের দেহে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের সমস্যা আছে, তারা ডেয়ারি প্রোডাক্ট কোনভাবেই খেতে পারেন না। কিন্তু ঘি বানানোর সময় বারংবার দুধে জ্বাল দেওয়া হয়। এতে ল্যাকটোজ নষ্ট হয়ে যায় এবং অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা চলে যায়। ফলে অন্যান্য ডেয়ারি প্রোডাক্ট না খেতে পারলেও আপনারা ঘি খেতেই পারেন তৃপ্তি করে।

তবে এই সমস্ত সুবিধা বা উপকারিতা যাই বলুন, সবই পাওয়া যায় শুধুমাত্র বিশুদ্ধ খাঁটি ঘি থেকেই। কিন্তু খাঁটি ঘি চিনবেন কীকরে? শুধুই কি ঘিয়ের বোতলের গায়ে সাঁটা লেবেল দেখেই করতে হবে ভরসা? আরে না মশাই! বাড়িতেই খুব সহজ কয়েকটি পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে ফেলা যায় ঘিয়ের বিশুদ্ধতা। তবে এই সমস্ত ঘরোয়া পদ্ধতি অনেকেরই অজানা। আজকের এই প্রতিবেদনে আপনাদের জানাব ঘি-এর বিশুদ্ধতা প্রমাণ করার কিছু ঘরোয়া টোটকা।

প্রথম পদ্ধতি

ঘি ভেজাল নাকি জানতে একটি পাত্রে এক চামচ ঘি গরম করুন। ঘি যদি সঙ্গে সঙ্গে গলে যায় এবং বাদামি হয়ে যায়, তাহলে তা সম্পূর্ণ খাঁটি ও বিশুদ্ধ ঘি। কিন্তু গরম করা সত্বেও যদি এটি গলতে সময় নেয় এবং বাদামির পরিবর্তে হালকা হলুদ হয়ে যায় তাহলে সেই ঘিয়ে অবশ্যই ভেজাল মিশ্রিত আছে। আসলে এই ধরনের ভেজাল ঘি বানানোর জন্য ব্যবহার করা হয় বনস্পতি বা অন্যান্য হাইড্রোজিনেটেড ফ্যাটের, যা গলতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে থাকে।

দ্বিতীয় পদ্ধতি

বাড়িতে আনা ঘি ভেজাল নাকি জানতে আপনি নারকেল তেলের ব্যবহারও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে একটি পাত্রে কিছুটা ঘি এবং নারকেল তেল দিয়ে মিশ্রিত করতে হবে এবং পাত্রটি ফ্রিজে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ রাখার পর যদি ওই ঘি এবং নারকেল তেল পৃথক স্তর তৈরি করে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে, ওই ঘি সম্পূর্ণ ভেজাল।

তৃতীয় পদ্ধতি

ঘি এর বিশুদ্ধতা প্রমাণ করার এই টোটকা সবচেয়ে সোজা। একটু ঘি নিয়ে হাতে কিছুক্ষণ রগড়ান। এরপর শুঁকে দেখুন যে ঘি এর গন্ধ আসছে কিনা। যদি কিছুক্ষণ পরে ঘি থেকে গন্ধ আসা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বুঝবেন ওই ঘিয়ে ভেজাল রয়েছে। কারণ বিশুদ্ধ ঘিয়ের গন্ধ এত তাড়াতাড়ি নষ্ট হওয়ার কথা নয়।

চতুর্থ পদ্ধতি

হাতের তালুতে এক চামচ ঘি নিয়ে কিছুক্ষণ রাখুন। সাধারণ ঘি শরীরের তাপমাত্রায় গলতে শুরু করবে। হাতের তালুতে ঘি নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই যদি সেটা আস্তে আস্তে গলতে শুরু করে তাহলে বুঝবেন সেটা খাঁটি ঘি। অন্যথা হলে ধরে নিতে হবে আপনিও বাজারের 'খাঁটি' ট্যাগলাইনের শিকার।

পঞ্চম পদ্ধতি

কোনো পাত্রে গরম জল করে তার মধ্যে ঘি এর শিশি বসিয়ে দিন। দেখবেন ভেতরের ঘি গলে যাবে। এরপর ওই শিশিটিকে ফ্রিজে রেখে দিন। কিছুক্ষণ ঠান্ডা হওয়ার পর যদি দেখেন গোটা শিশিতে একই রংয়ের জমাট বাধা ঘি তাহলে সেটা অবশ্যই খাঁটি। কিন্তু ওই ঘি ভেজাল হলে শিশিতে আলাদা আলাদা রঙের তেলের আলাদা আলাদা স্তর দেখা যাবে।

আসলে, আজকাল এই ভেজাল ঘিয়ের পরিমাণ এতটা বেশি মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে যে শরীরের কথা মাথায় রেখে আমাদের অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে, গরম ভাতের সাথে আমরা যে ঘি খাচ্ছি তা যেন অবশ্যই বিশুদ্ধ হয়। এছাড়া ঘি কেনার সময় অবশ্যই দেখে নিতে হবে সেটি কোনো নামকরা পরীক্ষাগার থেকে সার্টিফাইড নাকি। সার্টিফিকেট পাওয়া খাঁটি ঘি পেলে, তাহলে আর ঘরোয়া টোটকা ব্যবহারের তেমন কোনো বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রাহকরা জাগ্রত হলে বাজার থেকে অবশ্যই কমবে ভেজালের পরিমাণ। আর বাঙালির রান্নাঘরে সগৌরবে টিকে থাকতে পারবে খাঁটি গাওয়া ঘি।

More Articles