একদিনে নয়, যে ভাবে তিলে তিলে প্রাসাদ গড়েছে জোম্যাটো

মহামারিতে জেরবার মানুষের জীবন। চারিদিকে সব বন্ধ। প্রতিমাসে বন্ধুদের সাথে নতুন কোনো রেস্টুরেন্ট ঘোরার যে প্ল্যান হয় কি হবে তার? এদিকে রেস্তোরাঁর বিরিয়ানীর বা চিলি চিকেন ছাড়াও তো আর চলছে না। সুস্বাদু খাবার খেলে তাও খানিক লাঘব হয় এই কষ্টের অনুভূতি। লকডাউনে বাড়ি বসে এসব চিন্তা কার মাথায় আসেনি । করোনার আগেও তো বন্ধুদের সাথে কোথাও বেরোনো  মানেই কোন এলাকায় কী কী ভালো রেঁস্তোরা রয়েছে তাঁর তালিকা বানিয়ে নেওয়া। পকেট সাথ দেওয়া ভালো রেঁস্তোরা অনুযায়ী ঠিক হয় ঘোরার জায়গা। এর মধ্যে গ্রুপের সেলফি লাভার বলে উঠেছে দেখিস রেঁস্তোরার অ্যাম্বিয়েন্স যেন ভালো হয় তবেই তো  সুন্দর সেলফি উঠবে। অলিতে গলিতে রেঁস্তোরা ছানবিনে ভারতবাসী এত দক্ষ বোধহয় দশ  বছর আগেও ছিল না। দেশবাসীর এই দক্ষতার কান্ডারী ' 'জোম্যাটো' অ্যাপ। বাড়ি বসে প্রিয় রেঁস্তোরার খাবার পৌঁছানো হোক বা নতুন কোনো রেঁস্তোরার মেনুতে চোখ বোলানো- সবই আজ এক ক্লিকেই সম্ভব জোম্যাটোর দৌলতে।কিন্তু কীভাবে শুরু এই অ্যাপের পথচলা? চলুন ফিরে দেখা যাক এই অ্যাপের যাত্রাপথের খুঁটিনাটি।

শুরুর কথা

জোম্যাটো অ্যাপের জন্মের কথা বলতে গেলে দুজন মানুষের নাম উল্লেখ করতেই হয়। প্রথমজন দীপিন্দর গোয়াল এবং অপরজন  পঙ্কজ চড্ডা। দুজনেই আইআইটি দিল্লীর প্রাক্তন ছাত্র।পাশাপাশি দীপিন্দর এবং পঙ্কজ সহকর্মী। দুজনে একই সাথে দিল্লীর ব্রেইন অ্যান্ড কো নামক একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এই কোম্পানিতে কাজের সময় দীপিন্দর ও পঙ্কজ এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হন। তাঁরা দেখেন প্রতিদিনই টিফিনের সময় সেই এলাকার খাবার দোকানগুলির সামনে মানুষের লম্বা লাইন। মেনুকার্ড হাতে পেতেই সময় কাবার। এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে থাকেন দুজন সহকর্মী মিলে।

২০০৮ সালে মিলেও যায় সমাধান। তৈরি করে ফেলেন।  'ফুডিবাই' অ্যাপ। ২০১০ সালে এই অ্যাপের নাম বদলে হয় 'জোম্যাটো'। ২০১১ সালে সংস্থার নাম হয় জোম্যাটো  মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড। রাজধানী থেকে আহমেদাবাদ,চেন্নাই, মুম্বই গোটা দেশের মন জিতে নেয় এই অ্যাপ। ২০১৮ সালে পঙ্কজ কোম্পানী ছেড়ে বেরিয়ে গেলে তাঁর জায়গা নেয় গৌরব গুপ্ত। সংস্থার বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজে যোগ দিলেও পঙ্কজের পদত্যাগে তাঁর চেয়ার পান গৌরব। তবে তিনি সেই পদ ছেড়ে দেন ২০২১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ।

জোম্যাটোর লক্ষ্য

এই অ্যাপের বিজ্ঞাপনেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে সংস্থার লক্ষ্য। বিজ্ঞাপনে বলা হয় এই সংস্থার মূল লক্ষ্য হল সকলের জন্য ভালো খাবার নিশ্চিত করা। সংস্থার অন্যতম মাথা পঙ্কজের কথায়, জোম্যাটো হল ব্যবহারকারীর কাছে স্থানীয় রেঁস্তোরা সন্ধানের এক আন্তর্জাতিক মঞ্চ'। সংস্থার ট্যাগলাইন, ' কখনোই খারাপ খাবার খাওয়া নয়' ( নেভার হ্যাভ অ্যা ব্যাড মিল) ।

সংস্থার বাণিজ্যিক মডেল ও আয়ের পথ

জোম্যাটোর মূল আয়ের পথ হল অ্যাপে দেখতে পাওয়া বিভিন্ন বিজ্ঞাপন। এছাড়া অ্যাপে নথিভুক্ত থাকা রেঁস্তোরাগুলির থেকে কমিশন পেয়ে  থাকে জোম্যাটো। তবে অতিমারি বয়ে এনেছে বিপদ। করোনা অতিমারির কারণে রেঁস্তোরা বন্ধ থাকলেও চালু ছিল বাড়ি বাড়ি খাবার ডেলিভারি পরিষেবা। তাই বদলে ফেলা হয় বাণিজ্যিক মডেল। রেঁস্তোরার বদলে অতিমারির সময় থেকে প্রতি অনলাইন খাবার ডেলিভারি থেকে কমিশন সংগ্রহ করে সংস্থা।

কঠিন সময়

চলার পথে চড়াই উতরাই নিত্য সঙ্গী। জন্মলগ্ন থেকেই একটি নির্দিষ্ট এলাকার সব রেঁস্তোরাগুলিকে  এক ছাতার তলায় আনতে মাথার ঘামে পায়ে পড়ার জোগাড় হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই অ্যাপের জনপ্রিয়তা খানিক মসৃণ করেছিল চলার পথ। তবে সংস্থার পথে বার বার বহু বাঁধা এসেছে। সময়টা ২০১৫। সংস্থার সামনে এমন পরিস্থিতি এসে ধরা দেয় যার একমাত্র উপায় হয় রাখো নাহলে ছাঁটাই করো। সে সময় ৩০০ কর্মী ছাঁটাই করে এই সংস্থা, এঁদের মধ্যে ১০% কর্মী ছিলেন আমেরিকার। সেই বছরেই। আমেরিকায় 'আরবান স্পুন' নামক একটি রেঁস্তোরা কিনেছিল সংস্থা। কিন্তু লক্ষ্মী লাভের বদলে ভরাডুবি  হয়েছিল সেই প্রয়াস। ২০১৬ সালে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, শ্রীলঙ্কা, ইতালির মত দেশগুলিতে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যবসা। পরের বছর আরও এক বিপদের মুখোমুখি হয় সংস্থা। সাইবার হানায় চুরি ১৭ মিলিয়ন অ্যাপ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য।তবে সে বিপদও কাটিয়ে ওঠে জোম্যাটো।

দিনবদল

ফের সময় বদলাতে শুরু করে ২০১৯ সালে। অতিরিক্ত ছাড় প্রদানের মধ্য দিয়ে ব্যবসায় লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন সংস্থার মালিকেরা। ২০২০ আর্থিক বর্ষে বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ২২৫%। প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পর সংস্থা ৯,৩৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহের আশায় তাদের আইপিও প্রকাশ করেছে। বর্তমান ভারত ও আমিরশাহিতে প্রতিমাসে ১০.৫ মিলিয়ন খাবার অর্ডার করা হয় এই অ্যাপের মাধ্যমে। বর্তমানে রেস্তোরাঁর সন্ধান দেওয়ার পাশাপাশি খাবার ডেলিভারিও হয় এই অ্যাপের মাধ্যমে।

অতিমারি পরিস্থিতে কয়েক হাজার রেঁস্তোরা পথ চলা শুরু করে জোম্যাটোর হাত ধরে। চলতি সময়েই সংস্থাটি তার বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছে। শুধু তাই নয় ২০৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে 'উবার ইটস' কিনে নিয়েছে এই সংস্থা। ' গ্রোফারস' যা বর্তমানে 'ব্লিঙ্ককিট ' নামে পরিচিত তাতেও ৯.৩ % শেয়ার আছে বলে ঘোষণা করেছে জোম্যাটো।


জোমাল্যান্ড

২০১৮ সালে এই অ্যাপ সংস্থা 'জোমাল্যান্ড' নামক ভারতের সবথেকে বড় ফুড কার্নিভাল চালু করে।প্রথম বছরেই ১ লক্ষেরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছিল এই কার্নিভালে। বর্তমানে ভারতের ১০ টি শহরে প্রতিবছর এই কার্নিভাল আয়োজন করা হয়।

কথায় আছে, মানুষের মন জেতার পথ তাঁদের পেট হয়ে যায়। একথা অনেক আগেই বুঝেছিলেন পঙ্কজ এবং দীপিন্দর। হাজার বাধার পরও তাই তাঁদের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন এই আইআইটি প্রাক্তন দীপিন্দর। তাই আজ মানুষের ফোনে ফোন জোম্যাটো। ভোজনরসিকদের জন্য যথার্থ ঠিকানা এই অ্যাপ।

More Articles