গয়ানাথের বালিশে কেউ শোয় না, কপকপ করে খায়!

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: যদি পুরো খাঁটি বালিশ কিনতে চান তাহলে বাংলাদেশ যেতেই হবে। এ বালিশে শোয় না কেউ, রসে চুপচুপে দুর্দান্ত মিষ্টি বালিশ কপকপ করে খায়। ছোট বড় হরেক বালিশ মিলবে। বঙ্গ মিষ্টির মনভরানো কথায় রসগোল্লা, মিহিদানা, সন্দেশ, পেঁড়া, চমচম আরও কতো রকমারি কিছু আছে, তেমনই আছে বালিশ মিষ্টি।
 
পরিপূর্ণ পেটমোটা বালিশ মিষ্টি দেখতে অনেকটা বিছানার বালিশের মতো। শুনলে অবাক হবেন, এই মিষ্টি আবিষ্কারকের পরিবার পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হলেও এই বঙ্গে বালিশের কদর হয়নি। যদিও বাংলাদেশের সর্বত্র গয়ানাথের বালিশের কদর আছে। সে ঈদ হোক বা শারদোৎসব বা বিয়ের অনুষ্ঠান অতিথি আপ্যায়নে বালিশ দেওয়া মানে কৌলীন্যের প্রতীক।
 
দেশ বিভাগের পরে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে চলে এসেছেন তাঁদের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে গয়ানাথের বালিশ মিষ্টির স্বাদ। এ স্বাদের সত্যিই কোনও ভাগ নেই। তবে দেশভাগ হয়েছে। বালিশ থেকে গিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে। ময়মনসিংহের নেত্রকোণা এই মিষ্টির জন্মস্থল। আবিস্কারক বলুন আর জন্মদাতা বলুন, নেত্রকোণার গয়ানাথ ঘোষের নাম জড়িয়ে রয়েছে।
 
নেত্রকোণা শহরের যে কেউ দেখিয়ে দেবেন স্থানীয় বারহাট্টা রোডের গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এখানেই দেখবেন রসে টইটুম্বুর নধর বালিশ। বঙ্গজ মিষ্টান্ন ইতিহাসের পাতা উল্টোলে মিলবে গয়ানাথের কথা। একশ বছর পুরনো এই কথা। শক্তিগড়ের (এখন পূর্ব বর্ধমান জেলা) অতি বিখ্যাত ল্যাংচার সঙ্গে পাল্লা কষতে নেত্রকোণার গয়ানাথ ঘোষ বানিয়েছিলেন বালিশ মিষ্টি। শুরুতেই ক্রেতাদের মধ্যে ছড়িয়েছিল উত্তেজনা। বিক্রি হতে থাকে বেশ।
 
তখনও ভারত ভাগ হয়নি। নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টির কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়েছিল পুরো বঙ্গ প্রদেশে। তবে পূর্ব বঙ্গে এর আলাদা রাজত্ব। বালিশ মিষ্টির  স্বত্বাধিকারী হন গয়ানাথ ঘোষ। তিনি স্থান পান বাংলার মিষ্টি ইতিহাসে।
 
গয়ানাথ ঘোষের স্বপ্ন ছিল নতুন ধরনের মিষ্টি আবিষ্কার করা। একদিন তিনি বিশাল সাইজের একটি মিষ্টি তৈরি করেন। সেটি ক্রেতাদের খেতে দেন। এর আকার অনেকটা কোল বালিশের মতো।  ক্রেতাদের পরামর্শে মিষ্টির নাম রাখলেন বালিশ। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় অল্পদিনেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এই মিষ্টির নাম। আবিস্কারক হিসেবে পরিচিতি পান গয়ানাথ ঘোষ। লোকমুখে বালিশ মিষ্টির নাম হয় গয়ানাথের বালিশ।
 
মিষ্টি ব্যবসায়ী গয়ানাথের ব্যবসা লাভের উপর লাভ দেখতে থাকে। কোনওভাবেই বালিশের গুণমান নিয়ে ফাঁকিবাজি করতেন না গয়ানাথ। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, নেত্রকোণা শহরের অন্যান্য মিষ্টির দোকানেও বালিশ মিষ্টি রাখতে হতো।
 
ইতিমধ্যে ভারত ভাগ মঞ্জুর হলো। ময়মনসিং বিভাগটি পড়ল পাকিস্তানের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই  নেত্রকোণা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেল। দেশ বিভাগের পর ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা মানুষদের মনে সুখানুভূতির ছোঁয়া হয়ে থেকে গেল বালিশ।
 
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরেও গয়ানাথ ঘোষ নেত্রকোণা ছাড়েননি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেন। যদিও তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য ভারতে চলে আসেন। এরপর ষাটের দশকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের ও ভারতের সীমান্তে যুদ্ধ হয়। তবে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত ছিল শান্ত। ১৯৬৫ সালের এই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। প্রাণ বাঁচাতে পূর্ব পাকিস্তানের বহু নাগরিক ভারতের দিকে বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেন। রক্তাক্ত অবস্থা।
 
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেখে চিন্তিত গয়ানাথ ঘোষ স্থির করেন পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবেন। তিনি ১৯৬৯ সাল নাগাদ পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। অতিপ্রিয় দোকানটি বিক্রি করেন নেত্রকোনার বাসিন্দা কুমুদ চন্দ্র নাগের কাছে। তবে বালিশ মিষ্টি তৈরির পদ্ধতি তিনি কাউকে জানাননি।
 
বিখ্যাত মিষ্টির দোকান কেনার পর ব্যবসা ধরে রাখতে নাগ পরিবার খুঁজে বের করে বালিশ মিষ্টি তৈরির মূল কারিগর নিখিল মোদককে। পরে তাঁর কাছেই দোকানটি ফের বিক্রি করা হয়। সেই থেকে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার চলছে মোদক পরিবারের সঙ্গে। পুরনো ঐতিহ্যবাহী নাম রেখে দিয়েছেন তাঁরা।
 
নেত্রকোণা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সব প্রান্তে বালিশ মিষ্টির সুনাম রয়েছে। কিন্তু এর আবিষ্কারক গয়ানাথ ঘোষ আর বালিশ মিষ্টির কোনও দোকান পশ্চিমবঙ্গে খোলেননি। তিনি যেন ভুলেই যান তাঁরই অদ্ভুত আবিষ্কার। ফলে পশ্চিমবঙ্গে বালিশ মিষ্টির পরিচিতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার বালিশ মিষ্টি প্রচারে উদ্যোগ নেয়।
 
 নেত্রকোণার বালিশ দেখতে কেমন-যারা কখনও এই বিখ্যাত দোকানে ঢুকেছেন তারা দেখে চমকে গেছেন। রসের গামলায় ভাসছে ছোট বড় কোল বালিশের মতো মিষ্টি। কোনটা আকারে এক ফুটের বেশ্যার। এর ওজন এক কেজির মতো। এছাড়াও ছোট, মাঝারি বিভিন্ন রকমের বালিশ মিলবে।
 
বালিশ তৈরি হয় দুধ ছানা, চিনি এবং ময়দা দিয়ে।   ছানার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। মণ্ড দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন সাইজের মিষ্টি বালিশ। চিনির গরম রসে তা ঢেলে জ্বাল দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে ঠাণ্ডা করে আবার চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হয় অনেকক্ষণ। রসে টুইটম্বুর হয়ে যায় বালিশ। বিক্রির আগে বালিশের উপর দেওয়া হয় ঘন সুস্বাদু ক্ষীরের প্রলেপ বা দুধের মালাই।
 
নেত্রকোণায় কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠান হচ্ছে আর বালিশ থাকবেনা তাও কি হয় নাকি! সরকারি অনুষ্ঠানেও খাবার তালিকায় প্রাধান্য পায় বালিশ।
 
তবে গয়ানাথ যেন রহস্যজনকভাবে মিলিয়ে গেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কোনো অভিমান হয়েছিল? মন ভেঙেছিল এই মিষ্টি গবেষক আবিষ্কারকের? এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর নেই।
 
সৌজন্য:
  • গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি: ইত্তেফাক সংবাদপত্র
  • Famous sweets of Bangladesh: UNB News
  • বাংলাদেশ তথ্য বাতায়ন
 

More Articles