মূল্যবৃদ্ধির নাছোড় চাপ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমবে কবে!

Inflation Rate: মূল্যবৃদ্ধির হার এখনও যথেষ্ট চড়া। সেই তিমিরেই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের দিনযাপন।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে খানিকটা স্বস্তি মিললেও এখনো রয়েই গেলো খানিক উদ্বেগ। শুক্রবার ১২ অগাস্ট কেন্দ্র সরকার প্রকাশিত মূল্যবৃদ্ধি, শিল্পবৃদ্ধি এবং আমদানি-রপ্তানির পরিসংখ্যানে চোখ রেখে খানিকটা এমনই প্রতিক্রিয়া জানালেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের মূল্যবৃদ্ধির হার জুন মাসের ৭.১% থেকে কমে জুলাই মাসে ৬.৭১% হলেও এখনো পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বেঁধে দেওয়া সহনসীমার বেশ কিছুটা উপর দিকেই রয়েছে এই পরিসংখ্যান। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া নির্ধারিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে মূল্যবৃদ্ধির সহনসীমা সর্বাধিক ৬% পর্যন্ত হতে পারে।

সবজি এবং ভোজ্যতেলের দাম জুন মাসের থেকে অনেকটাই কমলেও, অন্যান্য কয়েকটি জিনিসপত্রের দাম কিন্তু প্রায় একই রকম অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে। এর আগে জুন মাসে সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল ৭.৭৫%। তবে জুলাই মাসে এই মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা মাথা নামিয়ে হয়েছে ৬.৭৫%। এই পরিসংখ্যানটা সাধারণ মানুষের জন্য কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও এখনও সাধারণ মানুষের স্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারেনি এই পরিসংখ্যান। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মূল্যবৃদ্ধি যতই ৭ শতাংশের নিচে নেমে আসুক না কেন, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এখনো থাকতে চলেছে আরো কয়েক মাস।

তবে মূল্যবৃদ্ধির পরিসংখ্যানের এই নিম্নমুখী গ্রাফ দেখে অনেকটাই আশাবাদী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর শক্তিকান্ত দাস। একটি লিখিত বিবৃতিতে আরবিআই গভর্নর বলছেন,

এই মুহূর্তে জুলাই মাসে ভারতের মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.৭১%। এপ্রিল মাসে যেখানে এই মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৮%, তার তুলনায় এখন পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো। রিজার্ভ ব্যাংকের রেপো রেট বৃদ্ধি থেকে শুরু করে, বেশ কিছু পারিপার্শ্বিক প্রভাবের কারণে মূল্যবৃদ্ধির গ্রাফ এই মুহূর্তে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। আমরা হয়তো ভারতের মূল্য বৃদ্ধির সব থেকে খারাপ সময়টা অতিক্রম করে এসেছি। সামনে হয়তো আমাদের জন্য সময়টা আরো ভালো।

কিন্তু সত্যিই কি আমাদের জন্য ভালো সময় আসছে? সেটা কিন্তু এখনই স্পষ্ট ভাবে বলা যাচ্ছে না। জুন মাসে ভারতের শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১২.৩%। সাধারণ পরিমাপ অনুযায়ী এই পরিসংখ্যান খুব একটা অস্বাভাবিক না হলেও মে মাসের তুলনায় কিন্তু এই হার অনেকটাই কম। মে মাসে যেখানে ভারতের শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ১৯.৬%, সেখানে জুন মাসে কিন্তু শিল্প উৎপাদনে একটা লক্ষণীয় হ্রাস এসেছে। সরকারি মহলের দাবি, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও অর্থনীতি যে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সেটা স্পষ্ট হচ্ছে এই শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির হার থেকে। পরপর দুই মাস এই হার ১০ শতাংশের উপরে থাকার কারণে, অনেকেই অর্থনীতির হাল পরিবর্তন নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন। কল কারখানা থেকে শুরু করে, বিদ্যুৎ, ভোগ্যপণ্য, সব জায়গাতেই উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে শেষ কয়েক মাসে। তবে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও বাণিজ্য ঘাটতি ভারতের একটা অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে। বৈদেশিক বাণিজ্য তো অনেকদিন ধরেই নিম্নমুখী। সম্প্রতি আবার দেশীয় বাণিজ্যেও ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জুলাইয়ে রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ২.১৪% বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬২৭ কোটি ডলার হলেও আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বেশি, ৪৩.৬১%। ফলে ৩,০০০ কোটি ডলার ছুঁয়ে গিয়েছে ঘাটতির পরিমাণ।

রিজার্ভ ব্যাংকের রেপো রেট

দেশের মুদ্রাস্ফীতি রোধ করার জন্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে বৃদ্ধি করা শুরু হয়েছে রেপো রেট। চলতি বছরের মে মাস থেকে এখনো পর্যন্ত মোট ১.৪% শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে রেপো রেট। এর ফলে এই মুহূর্তে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের রেপো রেটের পরিমাণ ৫.৪ শতাংশ। তবে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই রেপো রেট কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার সর্বাধিক জায়গায় পৌঁছায়নি। চলতি আর্থিক বছরে আবারও রেপো রেট বৃদ্ধি করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্ভাবনা অনুযায়ী, চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আবারো রেপো রেট বৃদ্ধি করতে পারে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এই প্রসঙ্গে ইকোনমিক টাইমসের সঙ্গে কথা বলার সময় কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ উপাসনা ভরদ্বাজ জানিয়েছেন,

মনিটারি পলিসি কমিটি আগামী ভবিষ্যতে আরও রেপো রেট বৃদ্ধি করতে পারে। বাইরের সেক্টরগুলির মধ্যে ভারসাম্যের অভাব এবং বিশ্বজুড়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার কারণে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করার সম্ভাবনা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। আমাদের ধারণা, ১.৪ শতাংশেই এই রেপো রেট বৃদ্ধি থামবে না। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই রেপো রেটের হার দাঁড়াবে ৫.৭৫ শতাংশ।

অন্যদিকে ইলারা ক্যাপিটালের অর্থনীতিবিদ গরিমা কাপুর বলছেন, আরবিআই-র বর্তমান নীতি অনুসারে আরো ২৫ শতাংশ রেপো রেট বৃদ্ধি হতে পারে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই বিষয়টি অত্যন্ত সহায়ক হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ গরিমা কাপুর। পাশাপাশি ইয়েস ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দ্রনীল পাল বলছেন, সেপ্টেম্বরেই নতুন করে রেপো রেট বৃদ্ধি করতে পারে আরবিআই, এবং তাও আবার ১০ বা ২০ বেসিস পয়েন্ট না, সোজা ৩৫ বেসিস পয়েন্ট। ফলে রিজার্ভ ব্যাংকের এই রেপো রেট বৃদ্ধির পরিমাণ নিয়ে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও, রিজার্ভ ব্যাংক যে আগামী ভবিষ্যতে রেপো রেট বৃদ্ধি করবে, সেই বিষয়ে কার্যত একমত সকলেই।

কী ভাবে সামাল পরিস্থিতিতে

জুলাইয়ের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভারতের প্রখ্যাত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহানন্দা কাঞ্জিলাল বলেন,

চড়া মূল্যবৃদ্ধি এই মুহূর্তে আর্থিক বৃদ্ধির পথে একটা বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাসে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। ৩,০০০ কোটি ডলার ঘাটতি হয়েছে বিগত কয়েক মাসের মধ্যেই। এর ফলে টাকার দামে আবারও চাপ তৈরি হতে পারে। ডলারের দাম বৃদ্ধি হলে আমদানি খরচ বাড়বে। এর ফলে অস্বস্তিতে পড়বে ভারতীয় বাজার।

অন্যদিকে, বিশ্ব বাজারের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। ফেডারেল রিজার্ভের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আরো চড়া হারে সুদ বৃদ্ধি হতে পারে আমেরিকায়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে বিশ্ব বাজারের উপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে বড় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের এই ঘোষণার পর সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ভারতীয় শেয়ার সূচক সেন্সেক্সের উপর। বিগত দুই দিনে প্রায় ১,৫০০ পয়েন্ট পড়ে গিয়েছে ভারতীয় শেয়ার সূচক সেন্সেক্স। নিফটির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।

এপ্রিল থেকে জুন মাসে ব্রিটেনে জিডিপির সংকোচন ঘটেছে, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড বছর শেষে মন্দার ইঙ্গিত দিয়েছে। এর ফলে সব দিকেই সমস্যায় পড়েছে ভারতীয় অর্থনীতি। ব্রিটেন এবং আমেরিকার মতো উন্নত দেশে মন্দা ভারতের দেশীয় বাণিজ্য ঘাটতিকে খানিকটা বাড়িয়ে দিতে পারে। এই মন্দা বিশ্বে চাহিদা কমালে ধাক্কা খেতে পারে ভারতের রপ্তানি। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়লে কমবে টাকার দাম। এর ফলে তেল কেনার জন্য ভারতকে খরচ করতে হবে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। আর এই খরচ বৃদ্ধি পেলে কিন্তু তা পরিস্থিতির সমাধান তো করবেই না, উল্টে ইন্ধন যোগাবে মূল্যবৃদ্ধিতে।

More Articles