রাশিয়া কি স্রেফ ইউক্রেনের সঙ্গে লড়াইয়েই থেমে থাকবে, নাকি নজর বাল্টিক দেশেও!

ইউক্রেন সরকার কোনোরকম শর্ত ছাড়াই রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছে বারবার। কিন্তু  এখনও পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। রাশিয়ার সৈন্যদের হুঁশিয়ারি দিতে গিয়ে জেলেন্সকি জানিয়েছেন যে ইউক্রেনের উপর যাঁরা আক্রমণ নামিয়ে আনছেন, তাঁদের অচিরেই শাস্তি ভোগ করতে হবে। তিনি এও বলেছেন যে কবর ছাড়া হামলাকারীদের কোনও শান্তির জায়গা অবশিষ্ট থাকবে না। বলছেন, হিসেব রাখা হচ্ছে, কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেওয়া হবে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে একদিকে যেমন রয়েছে পরমাণু বিস্ফোরণের ভয়। অন্যদিকে তেমন পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন এ যুদ্ধের বিরুদ্ধেই দল বেঁধে পথে নেমেছেন। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। কিন্তু জল্পনার পারদ থেকে গেছে  তুঙ্গে। তাহলে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দোরগোড়ায় এসে পড়ল? একদল আবার এও মনে করছেন যে এ যুদ্ধের মেয়াদ খুব বেশিদিন নয়। শিগগিরই শান্তিচুক্তিতে বসতে হবে রাশিয়া এবং ইউক্রেন-কে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভবনা কি এখনই দেখা যাচ্ছে, নাকি ইউক্রেনের পর এবার এস্তোনিয়া, লাতভিয়া এবং লিউথেনিয়ার মতো বলটিক দেশগুলির দিকে হাত বাড়াবে রাশিয়া?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে উঠেছিল লাতভিয়া, এস্তোনিয়া এবং লিউথেনিয়ার মতো দেশগুলি। তারপর ’৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর তারা স্বাধীনতা লাভ করে এবং ঠিক তার এক দশক বাদে ২০০৪ সালে ন্যাটোর সদস্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই তারপর থেকে ন্যাটোর মিত্র দেশগুলির ছত্রছায়াতে তাদের শাসন ব্যবস্থা চলেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন । রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করার পর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সারা দেশে এমারজেন্সি ঘোষণা করেছেন লিউথেনিয়ার প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়াও লাতভিয়ার সরকার নিজেদের দেশের বেশ কিছু রুশ টিভি স্টেশনের উপর ভুঁয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগে দ্রুত নিষেধাজ্ঞা নামিয়ে এনেছে।

বলটিক দেশের সরকারগুলি মূলত একটাই আশঙ্কা করছে। এখনই যদি পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি ভ্লাদিমির পুতিনকে উচিত শিক্ষা না দেয়, তাহলে রাশিয়া ফের তাদের উপর আক্রমন নামিয়ে এনে পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে। লিউথেনিয়ার বিদেশমন্ত্রী ইউ এস এর সামরিক সচিব-কে জানিয়েছেন, ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ আসলে গোটা ইউরোপের যুদ্ধ। পুতিন-কে যদি এখানেই থামানো না হয় তাহলে তিনি  এগোতেই থাকবেন।' ইউক্রেন-কে শুধুমাত্র যুদ্ধে সমর্থন জানিয়েই বলটিক দেশগুলি থেমে থাকেনি। তাদের অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী দিয়েও যথাযথভাবে সাহায্য করেছে তারা। এ ছাড়াও সেখানকার রাষ্ট্রনেতারা সাম্প্রতিককালে কিয়েভে গেছিলেন নিজেদের সহানুভূতি প্রকাশ করতে। এস্তোনিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কের্স্টি কালিউলেড জানিয়েছেন, ইউক্রেনের পক্ষে নৈতিক অবস্থান নিতেই তাঁরা কিয়েভে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। যদিও, রুশ আক্রমনের ফলে নিজেদের দেশের প্রতিরক্ষার  বিপর্যয় প্রসঙ্গকে তিনি আমল দিতে নারাজ।

ইতিপূর্বে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এস্তোনিয়া, লাতভিয়া এবং লিথেনিয়ার মতো দেশগুলির আলাদা হয়ে যাওয়া-কে রাশিয়ানদের ট্র্যাজেডি হিসেবেই দেখেছিলেন। যদিও, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের পুনর্দখল প্রসঙ্গে কিছুই বলেননি তিনি, কিন্তু সে সম্ভবনা-কে একেবারে তোপে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের এক অন্যতম কারণ ছিল ন্যাটো। ইউক্রেন এখনও পর্যন্ত ন্যাটোর অংশ নয় ঠিকই, কিন্তু ইতিপূর্বে সে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে। পুতিন মনে করেছিলেন ইউক্রেনের সঙ্গে মিত্রত্ব স্থাপনের মধ্যে দিয়ে ন্যাটো আসলে রুশ বিরোধী এক আঁতাত গড়ে তুলতে চাইছে। এবার দেখে নেওয়া যাক এর শুরুটা কোথায়।

সোভিয়েত পতনের পর থেকেই ন্যাটো পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশ-কে গ্রাস করতে আরম্ভ করে। তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগও আনা হয়েছিল যে পূর্ব ইউরোপের বন্ধু দেশগুলিকে আসলে তারা উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে সস্তার শ্রমিক সরবরাহের কাজে ব্যবহার করছে। মাথায় রাখতে হবে ন্যাটোতে প্রায় তিরিশটার কাছাকাছি দেশ অংশগ্রহণ করলেও তার মূল হর্তাকর্তা বিধাতা ইউ এস এ। সি শরৎচান্দ মনে করছেন ইউ এস এই হল ন্যাটোর প্রথম ও শেষ কথা। নব্বইয়ের দশক থেকে শক থেরাপির মধ্যে দিয়ে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি-কে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে আনার চেষ্টা করছিল। এর ফলে সদ্য খণ্ডিত হওয়া রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়ে। রাশিয়াতে সে সময় কিছু বিরোধী স্বরের আবির্ভাব ঘটেছিল ঠিকই, কিন্তু তা ইউ এস এর আগ্রাসী মনোভাব-কে দমন করতে পারেনি। ২০০৮ সালে জার্মানি আর ফ্রান্সের আপত্তি সত্ত্বেও ইউ এস এ জর্জিয়া-কে ন্যাটোর অংশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ঠিক পরেই জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার কাজিয়া-কোন্দল শুরু হল। তার ন্যাটোর মিত্রশক্তি হয়ে ওঠার সম্ভবনায় ইতি পড়ল। পূর্ব ইউরোপের ‘ওয়েস্টার্নাইজেশনে’র আগাগোড়া বিরোধিতা করে এসেছে রাশিয়া। পুতিনের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রবণতা দেখা যায়। এর ফলে রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি দিনকে দিন অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে। এখন কথা হচ্ছে, এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রাশিয়ার মনে হতেই পারে,‌যে সকল পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি ন্যাটোর মিত্রস্থানীয়, তাদের শুদ্ধিকরণ করব। সে ক্ষেত্রে লাতভিয়া, লিউথেনিয়া এবং এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলি তার আক্রমনের প্রকোপ থেকে বাদ পড়বে না। এ ছাড়াও পুতিন যদি চান প্রাচীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু কিছু অংশ পুনর্দখল করতে, তাহলেও তা বলটিক দেশগুলির জন্য ঘোর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

সম্ভবনা যাই থাক, ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তা আগে থেকে গণনা করা কার্যত অসম্ভব। দিনে দিনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পালটাচ্ছে। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। এমতাবস্থায় রুশ-ইউক্রেনের দ্বন্দ্ব ঠিক কোন বাঁক বদলের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে তা আগে থেকে কেই বা বলে দিতে পারে?

More Articles