রথের মতোই ধুমধাম! জগন্নাথকে মাসির বাড়িতে দেখতে আসেন লক্ষ্মী

হেরাপঞ্চমী পালিত হয় মহাধুমধাম করে। বিপুল ভক্তসমাগম হয় এই দিনে মন্দিরে। ভোগ চড়ানো হয় দেবতাদের, তার সঙ্গে চলে পুজোপাঠ এবং আরতি। লক্ষ্মী আসেন জগন্নাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

সদ্য রথযাত্রা গেল। বর্ষা এবার জলপাইগুড়িতেও ঢুকে পড়েছে বেশ খানিকটা আগেই। একনাগাড়ে বৃষ্টির মাঝে গৌড়ীয় মঠে মহা ধুমধাম করে রথযাত্রা হলো। সকাল থেকে পুজোপাঠ, হইহই রইরই কাণ্ড। মঠের উল্টোদিকের মিষ্টির দোকানের বিক্রি প্রায় তিন-চারগুণ বেশি সেদিন। তার রেশ এখনও কাটেনি। ইতিমধ্যে ‘হেরাপঞ্চমী’-ও পেরোল। কী এই হেরাপঞ্চমী? পুরাণ কী বলছে? জলপাইগুড়ির সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কী? আসুন জেনে নিই।

কথিত, ১০৮ ঘড়া জলে চান করে জ্বর আসে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার। হপ্তাদুয়েক পরে জ্বর থেকে উঠে মাসির বাড়ি ঘুরতে যান তিন ভাইবোন। তাই রথ পৌঁছয় মাসি গুণ্ডিচার মন্দিরে। রথযাত্রার সেই দিনটি থেকে গুনে গুনে পাঁচদিনে পঞ্চমী। এই পঞ্চমীতে জগন্নাথের স্ত্রী শ্রীমতী লক্ষ্মীদেবী জগন্নাথকে দেখে যান। এই কারণেই এই পঞ্চমীর নাম হেরাপঞ্চমী। আবার প্রাণনাথ জগন্নাথকে হারিয়ে লক্ষ্মী তাঁর খোঁজ করেন বলেন অনেক জায়গাতে একে ‘হরা-পঞ্চমী’-ও বলা হয়ে থাকে। স্কন্দপুরাণে এই হেরা-পঞ্চমীর উল্লেখ রয়েছে।

রথযাত্রার দিন থেকে উল্টোরথের আগে পর্যন্ত জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা, তিন ভাইবোন থাকেন মাসি গুণ্ডিচার বাড়িতেই। কিন্তু ভাইবোনকে নিয়ে মাসির বাড়ি এলেও জগন্নাথ স্ত্রী লক্ষ্মীকে আনতে ভুলে যান। দেবী মন্দিরেই থেকে গিয়েছিলেন। এই ঘটনায় যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন দেবী। তিনি একটি পালকিতে করে এসে পৌঁছন গুণ্ডিচার বাড়ির সামনে। সুবর্ণ মহালক্ষ্মীরূপে জগন্নাথকে ভয় দেখাতে শুরু করেন, বলেন এই মুহূর্তে ফিরতে হবে মন্দিরে, নয়তো অনর্থ হবে। মহালক্ষ্মীকে তুষ্ট করার জন্য জগন্নাথ তাঁকে ‘আজ্ঞা মালা’ উপহার দেন। কিন্তু তখন প্রচণ্ড রেগে গিয়েছেন দেবী। দেবীর সেই ভয়াবহ রূপ দেখে ভয়ে গুণ্ডিচার সেবকরা প্রধান দরজা বন্ধ করে দেন।

আরও পড়ুন: সতীর অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত আলো দেখেছিলেন তান্ত্রিক, কিংবদন্তির ঠিকানা এই জেলা

এরপরে কী ঘটে, তা নিয়ে দু'রকম কথা প্রচলিত আছে। লক্ষ্মী সেখান থেকেই মন্দিরে ফিরে আসেন। অথবা ঘটনাটি সম্পূর্ণ অন্যদিকে মোড় নেয়। নকচন দ্বার দিয়ে গুণ্ডিচার মন্দিরে প্রবেশ করেন লক্ষ্মী। নিজের অনুচরদের বলেন, জগন্নাথের রথ নান্দীঘোষের একটা অংশ ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন। আদেশ দিয়েই চলে যান না দেবী। একটি তেঁতুলগাছের আড়ালে লুকিয়ে সবটা দেখেন তিনি। অনুচররা নান্দীঘোষের একটা অংশ ভেঙে আনলে তিনি জগন্নাথের মন্দিরে ফিরে আসেন। কিন্তু প্রধান দ্বার দিয়ে প্রবেশ করেন না। হেরা-গোহরি নামে একটি অন্য পথ দিয়ে প্রবেশ করেন। কবিকর্ণপুর গোস্বামী শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকে একে ‘হেরা মহোৎসব’ বলে উল্লেখ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীপাদ আবার এই উৎসবকে বলেছেন ‘শ্রীলক্ষ্মীবিজয়োৎসব’।

এরপরে বহুরা বিজয় বা উল্টোরথের দিন আসে। যেদিন ভাইবোনকে নিয়ে জগন্নাথ ফিরে আসেন নিজের মন্দিরে। তখন মন্দিরের সামনে লক্ষ্মী তাঁর দাসীগণকে নিয়ে পালকি করে উপস্থিত হন। শ্রীজগন্নাথের মালা শ্রীলক্ষ্মীদেবীর গলায় পরানো হয়, তখন ‘বন্দাপনা’ তণ্ডুল, দূর্বা এবং প্রদীপ দিয়ে জগন্নাথের আরতি করে রথ পরিক্রমণ করেন দেবী। তারপরে ফিরে যান মন্দিরে। তিন ভাইবোনও ফেরেন। পুরীর মন্দিরের ইতিহাস বলছে, এই পুজো শুরু করেছিলেন রাজা কপিলেন্দ্র দেব। মাদলা পাঁজি অনুসারে, তিনিই সোনার মহালক্ষ্মী মূর্তি গড়িয়ে হেরাপঞ্চমী পালন শুরু করেন।

উড়িষ্যা এবং বাংলার বিভিন্ন জায়গায় এই পুজো পালিত হয়। তার মধ্যে জলপাইগুড়ি উল্লেখযোগ্য। এই অঞ্চলে এককালে শাক্ত প্রভাব ছিল খুব। শংকরদেবের (১৪৪৯-১৫৬৯) হাত ধরে এবং তাঁর শিষ্য মাধবের (১৪৮৯-১৫৯৬) চেষ্টায় এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম নতুন করে প্রচারিত হতে শুরু করে। বলা বাহুল্য, গোটা দেশে যে ভক্তি আন্দোলন চলছিল, এ ছিল তারই প্রভাব। তারই ফলাফল জলপাইগুড়ি অঞ্চলের মিশ্র সংস্কৃতি। একদিকে পাড়ায় পাড়ায় কালীমন্দির, অন্যদিকে শহরের প্রায় মাঝখানে, করলা নদীর তীর ঘেঁষে গৌড়ীয় মঠ। পুরাতন পুলিশ লাইন এলাকার সেই গৌড়ীয় মঠেই মহা ধুমধাম করে রথযাত্রা অনুষ্টিত হয়। কিন্তু গুণ্ডিচার মন্দিরটি আবার যোগমায়া কালীবাড়ির সংলগ্ন। ডিভিসি রোড ধরে থানার দিকে এগোলে, পথে পড়ে 'আধুনিকা' শাড়ির দোকান। আধুনিকা বাঁহাতে রেখে যে রাস্তাটি ঢুকে যাচ্ছে ডানদিকে, সেইটিই টেম্পল স্ট্রিট। সেই রাস্তা ধরে সোজা খানিকটা এগিয়ে গেলেই যোগমায়া কালীবাড়ি। সামনে বেশ কিছু মিষ্টির দোকান, নিরামিষ চপের দোকান। অমন নিরামিষ চপ গোটা শহরে মেলা ভার।

প্রায় একশো বছরের পুরনো এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২৭ সালে। তখন একচিলতে টিনের চালায় পুজো হতো। এরই সংলগ্ন গুণ্ডিচা মন্দির। এখানেই হেরাপঞ্চমী পালিত হয় মহাধুমধাম করে। বিপুল ভক্তসমাগম হয় এই দিনে মন্দিরে। ভোগ চড়ানো হয় দেবতাদের, তার সঙ্গে চলে পুজোপাঠ এবং আরতি। লক্ষ্মী আসেন জগন্নাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এই মন্দিরে পুজো করেন ব্রজগোপাল দাস। এই তিথিকে সামনে রেখেই বছরের এই বিশেষ দিনটি উৎসব হয়ে ওঠে এখানে। সুদূর আমেরিকা থেকে পর্যন্ত শিষ্যরা আসেন। এমনই এক শিষ্য নন্দানন্দন দাস এই বিশেষ দিনটির ব্যখ্যা করে জানান, এই হেরাপঞ্চমীর দিন কৃষ্ণের ষোলো হাজার আটমৈষি কৃষ্ণের খোঁজে লাঠি নিয়ে বৃন্দাবনে আসেন। আর বৃন্দাবনে থাকা মহাপ্রভুর সতীর্থরা নাকি তাঁদের ফুল ছুড়ে পরাজিত করেছিলেন। এই ভাবেই ভক্তদের আনন্দে, ব্যাখ্যায়, ভক্তি, পূজায় নীলাচলের জগন্নাথ পূজিত হন জলপাইগুড়ির গুণ্ডিচা মন্দিরে। গৌড়ীয় মঠ থেকে রথে করে যেখানে এসে ওঠেন জগন্নাথ। তাকে ঘিরে উৎসবে মেতে ওঠেন সবাই।

 

More Articles