চরণামৃতে সায়ানাইড মিশিয়ে অগণিত হত্যা! কে এই সায়ানাইড মল্লিকা

কর্ণাটকের কগ্গলিপুরা গ্রাম, সেখানে বাস করে কেমপম্মা। অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা। কেমপম্মার বিয়ে হয়েছে এক দর্জির সঙ্গে, তিন সন্তানের জননী তিনি। এ তো আর এক দুজনের সংসার নয় যে অল্প কিছু রোজগার করলেই নিজেদের গ্রাসচ্ছদনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পাঁচজন মানুষের দৈনন্দিন অন্নসংস্থান করা মুখের কথা নয়। কেমপম্মার স্বামী যা রোজগার করেন তাতে এতজন মানুষের খাওয়া পড়া চলে না। অতএব, তাকেই কিছু একটা উপায় বের করতে হল। চিট ফান্ডের ব্যবসা শুরু করল কেমপম্মা। কিন্তু সেখানেও তিনি ব্যর্থ হল। দিন কয়েক চলার পর ব্যবসা ফেল করল। বাড়িতে শুরু হল স্বামীর অত্যাচার। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কেমপম্মাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিল তার স্বামী। তিন সন্তান নিয়ে রাস্তায় এসে দাড়াল ,এ। এবার তিনি কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছুই জানেন না। এমন কেউ নেই যিনি তাঁকে ন্যূনতম সাহায্যটুকু করবেন। 

অতি কষ্টে কেমপম্মার একটা রোজগারের উপায় হল। কয়েকজনের বাড়িতে গৃহ পরিচারিকার কাজ নিল সে। দিন চলে যায় কোনোভাবে, কিন্তু মনে শান্তি আসে না। আজীবন চরম দারিদ্রের মধ্যে সে বড় হয়েছে। বিয়ে হয়ে ঘর সংসার হল, কিন্তু সেখানেও অভাব। ইচ্ছে করে, বড় ঘরের সাহেব মেমসাহেবদের মতো ঝলমলে সব পোশাক আসাক পরতে। কোনোদিন কি সুদিন আসবে না তাঁর? 

গৃহ পরিচারিকার কাজও কেমপম্মা বেশিদিন করতে পারেনি। কিছুদিন পরে একজন স্বর্ণকারের সহযোগী হিসেবে চাকরিতে ঢুকল সে। সেখানেই সায়ানাইড নামক একটা পদার্থের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটল। সোনার গয়না তৈরির কাজে সায়ানাইডের প্রয়োজন পড়ে মাঝে মধ্যে। ফলত কেমপম্মাকেও তার ব্যবহার শিখতে হল। সরাদিন খাটা খাটনির পর কেমপম্মা বাড়ি ফিরে টেলিভিশন খুলে বসল। সিনেমার পোকা সে। শিহরণ জাগানো রহস্য রোমাঞ্চের ছবি থেকে আরম্ভ দুর্ধর্ষ অ্যাকশন থ্রিলার, কিছুই তাঁর বাদ যায় না। এভাবেই একদিন একটা অদ্ভুত ছবি দেখল সে। সেখানে খুনী একজনকে খুন করল খাবারে সায়ানাইড মিশিয়ে। বিষয়টা কেমপম্মাকে ভাবাল। সায়ানাইডের ব্যবহার পেশাগত কারণেই তাঁকে শিখতে হয়েছে। এ জিনিস দিয়ে তবে মানুষকে খুনও করা যায়? কিন্তু তারপর তো জেল হাজত, ফাঁসির আদেশ, ভয়াবহ সব ব্যাপার স্যাপার। কেমপম্মার মনে তখনও দোলাচল। তখনো কেউ জানে না আর কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষের বড় বড় খবরের কাগজের শিরোনামে 'সায়ানাইড মল্লিকা' নামে থেকে যাবে সে। 

প্রত্যেকদিন মন্দিরে যেতে আরম্ভ করল কেমপম্মা। মন্দিরের চাতালে বসে বসে মানুষজন দেখে সে। লক্ষ করে তাঁদের হাবভাব, চালচলন। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ করে সে সাধিকার বেশে মন্দিরের বর্ধিষ্ণু দর্শনার্থীদের সঙ্গে আলাপ জমাতে লাগল। মন দিয়ে তিনি শোনেন তাঁদের দুঃখ কষ্টের কথা এবং ভেতরে ভেতরে ফন্দি আঁটেন। মুখে তার লেগে থাকে বৈরাগ্যের হাসি। দুঃখ কষ্ট পীড়িত ভক্তদের সে বলে, 'আসলে ঈশ্বরের কাছে পুজো দিতে হবে বুঝলে? তাহলেই দেখবে আর কোনও কষ্ট থাকবে না। চিন্তা কোরোনা, আমিই তোমাদের সাহায্য করব।' গ্রামের বাইরের অপরিচিত কোনও মন্দিরে সে তাঁদের পুজো দেওয়ানোর নাম করে ডাকে এবং আসবার সময় দামি শাড়ি এবং গয়নাগাটি পরে আসার নির্দেশ দেয়। এখান থেকেই উন্মুক্ত হল তার অন্ধকার জগতের প্রবেশ পথ। 

নির্জন মন্দিরে ভক্তদের নিয়ে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ পুজোর ভান করার পর তাঁদের চোখ বুজতে বলত। ভক্তরা চোখ বুজলে সায়ানাইড মেশানো চরণামৃত নিয়ে তাঁদের হাতে দিত এবং পান করতে বলত। শরীরে সায়ানাইড প্রবেশ করার ফলে যা হওয়ার তাই হত। খানিকক্ষণের মধ্যেই তাঁদের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেত এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন তাঁরা। কেমপম্মা সেই সুযোগে তাঁদের শাড়ি এবং গয়নাগাটি নিয়ে চম্পট দিত। ১৯৯৮ সালে কেমপম্মা তাঁর প্রথম হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তারপর দীর্ঘ হতে থাকে তালিকা। তার শিকার ধরার কিছু শর্ত ছিল। যেমন, ব্যক্তিকে হতে হবে বয়স্ক এবং অসহায়। ধরা যাক কেউ এসে তাকে বললেন, 'বড় হাঁপানির টান ওঠে মা। সারিয়ে দাও।' হয়তো ছেলে হারিয়েছেন। অনেক থানা পুলিশ করেও তাঁকে খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ কেমপম্মার থানে এসে হত্যে দিয়েছেন। মাথায় একটা প্ল্যান ছকে ফেলত সে। যন্ত্রণায় কাতর ব্যক্তিকে নিয়ে যেত সকলের অলক্ষ্যে। তারপর বন্দোবস্ত শুরু হত। পুলিশ বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু লাশ উদ্ধার করছিল। কিন্তু হত্যাকারীকে কিছুতেই ধরতে পারছিলেন না। আক্রান্তদের শরীরে কোনও কাটা ছেঁড়ার চিহ্ন নেই। এমনকী মুখে কোনও কষ্টের ছাপও নেই। যেন তাঁরা পরম শান্তিতে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত। অথচ পোস্টমর্টেম করলেই জানা যাচ্ছে, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে জটিল পদ্ধতিতে। রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে সায়ানাইড। প্রশাসনের চোখ কপালে উঠে গেছিল। 

২০০০ সালে কেমপম্মা একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কিন্তু ঠিক ছ'মাস পরেই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। তার উপর অভিযোগ ছিল ছিঁচকে চুরির। কোনও এক ধনী গৃহস্তের বাড়িতে হোম যজ্ঞ করার নাম করে তিনি কিছু দামি জিনিসপত্র চুরি করে পালাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও  কেমপম্মার কার্যকলাপ বন্ধ হয়নি। সকলের চোখের আড়ালে তিনি নিয়মিত হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজের নাম ক্রমাগত পাল্টাত কেমপম্মা। প্রত্যেকটা শিকারের পর ধারণ করত নতুন কোনও ছদ্মবেশ। শেষ যাঁকে খুন করেছিল তাঁর কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন 'মল্লিকা' হিসেবে। সেখান থেকেই তাঁর নাম হয়ে ওঠে 'সায়ানাইড মল্লিকা'। 

তার বিভিন্ন হত্যাকান্ডের গল্প শুনে সত্যিই শিউরে উঠতে হয়। নাগবেণী নামক এক নিঃসন্তান মহিলা একদিন চোখে জল নিয়ে তাঁর কাছে এসে নিজের কষ্টের কথা জানিয়েছিলেন। কিছুতেই সন্তান হয় না তাঁর। কেমপম্মা তাঁকে বিশেষ এক দিনে মন্দিরে পুজোর সামগ্রী নিয়ে আসতে বলে। তার পরের গল্প খুব কিছু আলাদা নয়। যেই চোখ বুজেছেন নাগবেণী, কেমপম্মা তাঁকে সায়ানাইড মেশানো চরণামৃত দিয়েছেন। তারপর তাঁর চোখে অন্ধকার নেমে আসতেই দক্ষতার সঙ্গে তাঁর গয়নাগাটি চুরি করে পালিয়েছে। প্রধানত এই ঘটনার পর থেকেই পুলিশ কেমপম্মাকে ধরতে বড়সড় ফাঁদ পাততে শুরু করল। অবশেষে যখন সে গ্রেপ্তার হল তখন তার নামে ঠিক কতগুলো খুনের মামলা ঝুলছে, তার সঠিক হিসেব প্রশাসনও দিতে পারেনি। ২০১২ সালে কেমপম্মার ফাঁসির আদেশ হয়। শোনা যায় সারা কর্ণাটক রাজ্যে সেই ছিল প্রথম ব্যক্তি যাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

কেমপম্মার ভয়াবহ সব কিসসা শুনে একদল হয়ত তাঁর অতিরিক্ত লালসাকে খুনের মোটিভ হিসেবে খাড়া করবেন। এ তত্ত্ব যে পুরোপুরি গলধপূর্ণ এমনটা নয়। লালসা কেমপম্মার ছিল বৈ কী। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে সে লালসারও কিছু সামাজিক কারণ ছিল। যে দারিদ্র ও পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের মুখোমুখি কেমপম্মাকে হতে  হয়েছে তারপর তাঁর কার্যকলাপের জন্য কি পুরোপুরি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা চলে?

তথ্যঋণ:

The Life of Cyanide Mallika - India's First Convicted Female Serial Killer 

Wikipedia

 

More Articles