অভিনেত্রীর কেপমারি থেকে লেখকের বডিগার্ড, কিমাশ্চর্য কলকাতা বইমেলা

চতুর্দিকে ঠাসা ভিড়, আর তার ফাঁকে ফাঁকে ঘটে চলেছে অদ্ভুত সব ঘটনা। কোথাও প্রখ্যাত লেখিকা আত্মরক্ষার তাগিদে বাউন্সার সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন। আবার কোথাও জনপ্রিয় সিনেমা অভিনেত্রী ভরা বইমেলায় পকেট মারতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন। এমনই বিরল সমস্ত ঘটনার সাক্ষী থাকল 'কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা' ২০২২। ব্যপার দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছে।

দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। মূলত ইতিহাস ভিত্তিক গল্প-উপন্যাস লিখে থাকেন তিনি। সাম্প্রতিককালে তাঁর উপন্যাস ‘নরক সংকেত’ অবলম্বনে ‘স্বস্তিক সংকেত’ নামক একটা সিনেমা বানিয়েছেন পরিচালক সায়ন্তন ঘোষাল। বাণিজ্যিকভাবে সফল লেখিকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেবারতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একদল মানুষের কাছে তাঁর লেখা ব্যপকভাবে প্রশংসিত হলেও দেবারতি-র পাঠকদের একটা অংশ মনে করেন যে তিনি ইতিহাসকে বিকৃত করেন। দিন কয়েক আগে অমিত দাস নামে এক যুবক তাঁর ছবি ব্যবহার করে একটা মিম তৈরি করেন। সেই মিম সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার পর মুহূর্তের মধ্যেই সেটা ভাইরাল হয়ে যায়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সেই মিম অচিরেই দেবারতি-র কাছে গিয়ে পৌঁছয়। এরপর তিনি সরাসরি লালবাজারে-র সাইবার ক্রাইম সেল-এ অমিতে-র নামে অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি মনে করেন, তাঁর লেখা কারুর পছন্দ নাই হতে পারে, কিন্তু সমালোচনা হওয়া উচিত গঠনমূলক। দেবারতি-র মতে,  একজন প্রাপ্ত-বয়স্ক মানুষের অনুমতি ছাড়া তাঁর ছবি নিয়ে মিম বানিয়ে অমিত নিজের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এও জানান যে অমিত যা করেছেন তা সাইবার ক্রাইমে-র ‘সেকশন ৬৭’ অনুযায়ী এক দণ্ডনীয় অপরাধ। গোটা ঘটনায় অমিতে-র উপর  আইনি চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে তিনি দেবারতি-র কাছে ক্ষমা চান।

এদিকে সামগ্রিক ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরেই ফেসবুকে দেবারতি-র বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। একদল প্রশ্ন তোলেন, তিনি ডাব্লিউবিসিএস অফিসার বলেই কি তাঁকে কিছু বাড়তি সরকারী সুবিধে পাইয়ে দেওয়া হল? তাঁদের মতে, দেবারতি নিজের সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে আসলে অমিত-কে লঘু পাপে গুরু  দণ্ড দিয়েছেন। গোটা ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু জল গড়ালো বহুদূর।

গত শনিবার কাতারে কাতারে মানুষ বইমেলা গিয়ে দেখেন তাঁদের পরিচিত লেখিকা দাঁড়িয়ে আছেন বাউন্সারদের ঘেরাটোপে। তাঁকে ঘিরে আছেন কালো পোশাক পরা মোট পাঁচজন দেহরক্ষি। ব্যপার দেখে তো সকলের চক্ষু-চড়কগাছ। সাহিত্যিকের মান বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত হাজির হলেন মাসলম্যান! অনেকেই অবশ্য মনে করছেন ফেসবুকে-র ঘটনার সঙ্গে এর  কোনও সম্পর্ক নেই। বইমেলায় দেবারতি-র অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য পাঠক-পাঠিকাদের লম্বা লাইন পড়ে। তাকে সামাল দিতেই বাউন্সারের ব্যবস্থা করতে হয়। কারণ যাই হোক, বইমেলায় জনপ্রিয় সাহিত্যিকের বাউন্সার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো ঘটনা  বিরল। বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় লেখক-লেখিকার অভাব নেই। তবে বইমেলায় তাঁদের নিরাপত্তা দিতে বাউন্সারের প্রয়োজন এর আগে পড়েনি।

দেবারতি-র ঘটনার জের কাটতে না কাটতেই সংবাদমাধ্যমের শীর্ষস্থান দখল করলেন অভিনেত্রী রুপা দত্ত। বছর দুয়েক আগেই পরিচলক অনুরাগ কাশ্যপে-র বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিলেন রুপা। গত শনিবার সন্ধেবেলায় বইমেলা-র কয়েকজন পুলিশ লক্ষ করেন যে তিনি বেশ কিছু টাকার ব্যাগ ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের সন্দেহ হয়। রুপা-র ব্যাগ খুলে তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে আরও কিছু মানিব্যাগ উদ্ধার করা হয় এবং সঙ্গে পাওয়া যায় প্রায় ৭৫,০০০ টাকা। এরপরেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিধাননগর উত্তর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই পুলিশকে নিজের আসল পরিচয় দেন অভিনেত্রী রুপা দত্ত। তাঁর কাছ থেকে একটা ডায়রিও উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে তিনি নিজের কেপমারির যাবতীয় তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে রেখেছেন।

তবে এসব কুশ্রীর পাশেই রয়েছে  মানবিক গল্পও। তরুণ কবি তন্ময় ভট্টাচার্যের ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায় রুনু মল্লিকের গল্প। কলকাতা-র নাকতলা অঞ্চলের বাসিন্দা ৬৩ বছরের রুনুদেবী। বাপ-মা মরা নাতিকে নিয়ে তাঁর অভাবের সংসার। যতদিন বইমেলা চলেছে ততদিন তিনি কলকাতা-র এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছেন কিছু পয়সা রোজগারের আশায়। মেলার মানুষজনের কাছে পসরা হিসেবে মেলে ধরেছেন নিজের হাতে লেখা চার পাতার বই। না, কোনও প্রকাশনা সংস্থাই সে বই প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেনি। তিনি নিজেই পাতার পর পাতা জেরক্স করে, তারপর সেগুলোকে জুড়ে তাকে সাজিয়ে তুলেছেন। চার পাতার মধ্যে তিন পাতা জুড়ে কবিতা, এক পাতায় গল্প। বইয়ের মূল্য মাত্র পাঁচ টাকা। শুধু সাহিত্যচর্চা করে সংসার চলে না রুনু দেবীর। একমাত্র নাতির মুখ চেয়ে আরও নানান ধরনের কাজ তাঁকে করতে হয়।

গল্প-কবিতার কাগজকে সঙ্গে করে তাঁর এই একক লড়াই মনে করিয়ে দেয় কবি সঞ্জয় খাসকেল বা অক্ষয়চাঁদে-র কথা। আজ থেকে বছর দশেক আগেও কলকাতা-র যাদবপুর অঞ্চলে হাতে কিছু জেরক্স করা কবিতার কাগজ নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে দেখা যেত সঞ্জয়বাবু-কে। হয়ত এইট-বি বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন কলেজ ফেরত কোনও পড়ুয়া। এমন সময় সঞ্জয়বাবু তাঁর সামনে গিয়ে হাজির হতেন। মাত্র দু টাকার বিনিময় তাঁর হাতে তুলে দিতেন নিজের সদ্য জেরক্স করা কবিতার কাগজ। কালে কালে দু টাকা থেকে সেই কাগজের দাম বেড়ে হয়েছিল দশ টাকা। অক্ষয়চাঁদ অবশ্য কবিতার পুর্নাঙ্গ  বই প্রকাশ করতেন। তাদের কোনোটার নাম ‘মালকোষ’, কোনোটা আবার ‘হংসধ্বনি’। কলকাতা বইমেলা যখন মিলনমেলা প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হত, তখন তিনি পায়ে হেঁটে গোটা মেলা চত্তর ঘুরে বেড়াতেন। কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে জোর গলায় ফিরি করতেন নিজের কবিতার বই। এ ছাড়াও তাঁকে দেখা যেত নন্দন চত্তরে। কোনও আগ্রহী পাঠক এগিয়ে এসে বই কিনলে তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলতেন, তারপর ফের পেশাদারি ভঙ্গিতে বই ফিরি।

সঞ্জয় খাসকেল বা অক্ষয়চাঁদকে আজ মনে রাখেননি অনেকেই। দিস্তে দিস্তে লেখার ভিড়ে এমন কত কবিই তো মরে গেছেন ‘চুপি চুপি একা একা।’ হয়ত রুনু মল্লিককেও আর কয়েক মাস পরে ভুলে যাবেন মানুষ। তবু, এ বছর বইমেলায় নানান অপ্রত্যাশিত ঘটনার মাঝে তিনিও নিজের জন্য কিছুটা জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর ভাষা-জড়ানো  লড়াইটাকে কুর্ণিশ। 

More Articles