ভারতের শেষ গ্রাম, এখান থেকেই নাকি স্বর্গের শুরু...

মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস হচ্ছে ভারতের শেষ গ্রাম ভিজিটের উপযুক্ত সময়।
 

পৃথিবী গোল না কি চ্যাপটা এই নিয়ে দুটো ঘরানা নিজেদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার পৃথিবীর শেষ কোথাও তা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি, আর পাওয়া গেলেও তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সে যাই হোক, পৃথিবীর শেষ নাই থাকতে পারে কিন্তু ভারতের আছে। বহু বিচিত্রময় এই ভারত। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিল্প সবকিছুর সমাহার। রহস্যের শেষ নেই এই দেশকে ঘিরে। ভারতের প্রতিটি গ্রাম, শহর, রাস্তা আর মন্দির নিয়ে আছে অজস্র গল্প, পৌরাণিক কাহিনি। ভারতে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ আসেরপ্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এর একটা বড় অংশই অবশ্য যায় উত্তরাখণ্ডে, সৌন্দর্য আর পবিত্রতার অশেষ ভাণ্ডার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরাখণ্ড। উত্তরাখণ্ড বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেদারনাথ মন্দির, বদ্রীনাথ মন্দির, জলপ্রপাত, পাহাড় আরও কত কি। কিন্তু সেইসব কিছুকে ছাপিয়ে এই উত্তরাখণ্ডের আরেক বৈশিষ্ট্য হল এই রাজ্যেই অবস্থিত ‘ভারতের শেষ গ্রাম’। দেশের শেষ গ্রাম শুনে অনেকেই চমকে উঠতে পারেন। আখ্যান অনুযায়ী লোকবিশ্বাস, এই গ্রাম থেকেই নাকি স্বর্গে যাওয়া যায়। উত্তরাখণ্ডের এই গ্রামটির নাম মানা গ্রাম। এরপরেই ভারত চিন সীমান্তের শুরু।

মানা অবস্থিত উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত মানার ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে গেছে সরস্বতী নদী। বদ্রিনাথ থেকে মানা গ্রামের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। সরকারি ভাবে মানা গ্রাম যেহেতু ভারতের শেষ গ্রাম আখ্যা পেয়েছে তাই, সেখানকার বিভিন্ন দোকানে লেখা আছে ‘ভারতের শেষ চা ও কফি কর্নার’, ‘ভারতের শেষ দোকান’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অত্যন্ত দুর্গম এই গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ৩৫০-৪০০ জনের মতো। অধিকাংশই দারিদ্র সীমার নীচে, উপার্জন বলতে পর্যটন মরশুমে বদ্রীনাথে কুলির কাজ করা এবং হোটেলগুলোতে সাময়িক ফাই ফরমাশ খাঁটা। মে থেকে সেপ্টেম্বরের দিনগুলোতে গেলে গাঁয়ের লোকেদের সঙ্গে ইয়াকে চড়তে পারেন পাহাড়ের ঢালে। ছোট্ট গ্রামটিকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে পবিত্রতার ছোঁয়া। তিব্বত সীমান্তের এই অঞ্চলটা নন্দাদেবী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অন্তর্ভুক্ত। ফলে এখানে গেলে প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়।

এখানকার বাসিন্দারা হিন্দি কমই জানেন, কথা বলেন গাড়োয়ালি ভাষায়। মূলত এরা জডস ও বোথাস সম্প্রদায় ভুক্ত। পূর্বে এই সম্প্রদায় তিব্বতিদের সাথে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে বদ্রীনাথ মন্দিরের হিন্দু সংস্কৃতির সাথে যুক্ত। মানা গ্রামের আনাচ কানাচ ঘুরলে জানা যায় ১৯৯৯ সালে চীনা সৈনিকরা তিব্বত বর্ডার দিয়ে আচমকা ভারতে ঢুকে পড়ে। চীনা সৈনিকরা ভারতের গোবিন্দঘাট পর্যন্ত চলে আসে। সেই সময় মানা গ্রামের যুবক ও মহিলারা চীনা সৈনিকদের গতিবিধি ভারতীয় সেনাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ওই সময় চীনা সৈনিকরা প্রায় তিন দিন ধরে দখল করেছিল ভারতীয় ভূখণ্ড। গ্রামবাসীদের সাহায্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে চিনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

মানা নিয়ে পৌরাণিক কাহিনি

এই মানা গ্রামকে নিয়ে রয়েছে বহু পৌরাণিক কাহিনি। এই মানা গ্রামের বাচ্চারা এবং সেখানকার লোকজন এমনভাবে মহাভারতের কাহিনী বর্ণনা করেন যে, তা শুনলে মনে হয় তারা ধরেই নিয়েছেন যে, কোনও এক প্রাচীন কালে দেব দেবীরা তাদের প্রতিবেশী হিসেবে এখানে বসবাস করত। গ্রামের রাস্তা দিয়েই যেতে যেতে চোখে পড়বে ব্যাস গুহা যেখানে বসে একসময় মহাঋষি ব্যাসদেব চারটি বেদ সংকলন করেছিলেন এবং প্রথম মহাভারতের বর্ণনা করেন। এইসব পৌরাণিক কাহিনিই মানাকে অনন্য করে তোলে। কিন্তু কী কী দেখা যাবে এই মানায়?


রহস্যময় সরস্বতী নদীর আখ্যান

সরস্বতী নদীর নামকরণ হয়েছিল প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর নামানুসারে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই নদীর তীরে বসেই রচিত হয়েছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। নদীটি গুপ্ত গামিনী বা অদৃশ্য নদী নামেও পরিচিত কারণ এটি তার উৎপত্তিস্থল থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে প্রবাহিত হয় এবং তারপরে মানার কেশব প্রয়াগে অলকানন্দায় মিলিত হয়। ভীষণ গর্জন, তীব্র জলোচ্ছ্বাস, আর মোহময়ী সৌন্দর্য-- এই হচ্ছে সরস্বতী নদী। বলা হয়, মহাভারত রচনা করার সময় সরস্বতী নদীর গর্জন তার রচনায় বাধা সৃষ্টি করলে তিনি এই নদীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার জন্য।


ভীম পুলের ইতিহাস


সরস্বতী নদী ভীম পুলের কাছে অবস্থিত একটি পাথর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু এখানে নদীর স্রোত সংকীর্ণ হলেও সেই স্রোতের আওয়াজে কানে তালা লেগে যায়। কথিত আছে, পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদী স্বর্গারোহণ যাত্রাকালে এই নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে দ্রৌপদী ভয় পেয়েছিলেন। তখন ভীম একটি পাথর নিয়ে সরস্বতী নদীর ওপর ফেলে দেয় যাতে সকলে পারাপার করতে পারে। সেই পুলই ভীম পুল নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক সেতু নয়, আবার অতিপ্রাকৃতিকও নয়!

 

ভীমশিলা পেরিয়ে সরু পাথর ফেলা রাস্তা উঠে গেছে স্বর্গের দিকে। এই পথে অনেকটা গেলে পরে বসুধারা ফলস। সেখান থেকে আরো কতদূর জানি না, সতপন্থ তাল পেরিয়ে একটা জায়গা আছে যেখানে রাস্তা আর নেই। এই কি তাহলে স্বর্গ? না, বলা হয়, এই পাহাড়ের শেষে আসতে আসতেই পর্বতের দুর্গমতায় এক এক জায়গায় একে একে দ্রৌপদী, অর্জুন, নকুল, সহদেব ও ভীমের পতন হয়। অর্জুনের পতন হয় চক্রতীর্থে। শুধু যুধিষ্টির ধর্মরূপী সারমেয়কে সঙ্গে করে এই পথের শেষ সীমায় এসে পৌঁছন। সেখান থেকে তিনি সশরীরে স্বৰ্গরথে আরোহন করেন।


ব্যাস গুহা

‌এই গুহায় বসেই ব্যাসদেব বেদের চারটি সংকলন করেন যা ‘ভাগবদ গীতা’ হিসেবে পরিচিত। এই গুহার ছাদটি দেখতে অনেকটা তালপাতার পাণ্ডুলিপির মতো। এই গুহার ভেতরে একটি পাথর আছে যা ব্যাস পুস্তক বলে পরিচিত। ওখানকার মানুষের ধারণা ঐ ব্যাস পুস্তক বছরের পর বছর ধরে গুহায় থাকার কারণে শিলায় রূপান্তরিত হয়েছে।


গণেশ গুহা

সত্যিই গুহা, কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে একটা মন্দির মাত্র। মন্দিরের ভেতর দিয়ে কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গুহায় ঢুকতে হয়, আর পুরোটাই পরিক্রমার সময় চার হাতেপায়ে হাঁটতে হচ্ছে। গুহার গায়ে অনেকে পয়সা আটকে রেখেছে। ভেতরে পাথুরে মূর্তি। এই গুহাও মহাভারতের সাথে যুক্ত। মহাভারত লেখার জন্যে গণেশকে আনানো হয়, ব্যাস বলবেন আর গণেশ লিখবেন। কিন্তু গণেশের এক মহা জেদ, বেদব্যাস বলতে বলতে থেমে গেলে গণেশ আর লিখবেন না। ২৪ হাজার শ্লোকের মহাগ্রন্থ, থামতে তো হবেই। তাই ব্যাসও দিলেন মোক্ষম চাল। প্রতিটি শ্লোক লেখার সময় গণেশকে বুঝতে হবে সেই শ্লোকের অর্থ, তারপর লিখতে হবে। এইভাবে লেখা হল কুরুপান্ডবের ইতিহাস। ওজনে সমস্ত বেদ, পুরাণ, রামায়ণের থেকেও বেশি ভারী, তাই নাম হল মহাভারত (মহা+ভারত)।

ভারতের শেষ দোকান

ইয়াকের দুধে তৈরি চায়ে চুমুক দিতেই গ্রাম ছাড়া ওই পাথরের রাস্তা ধরে আরোও কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার মেজাজ পাবেন। সঙ্গে চনমনে হয়ে উঠবে প্রাণ। আন্তর্জাতিক সীমান্তে বসে গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার অভিজ্ঞতা কোনওভাবেই মিস করা যায় না!


এই হল ভারতের শেষ গ্রামের কাহিনি। তবে গ্রামের নাম মানা হলেও সেখানে যেতে কিন্তু কারুর মানা নেই। প্রকৃতি তার দু হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। হিমালয়ের কোলে এক অপরূপ পাহাড় আর সবুজে ঘেরা এই গ্রামে এখন পর্যটকদের নিত্য আনাগোনা। সকলেই ছুটছেন দেশের শেষ গ্রাম দেখতে। এই গ্রামটি আদতে শান্তশিষ্ট, শহরের গর্জন থেকে দূরে। সঙ্গে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য এবং ট্রেকিং-এর অন্যতম স্থান। মানা থেকে বসুন্ধরা, মানা পাস কিংবা চরণপাদুকা পর্যন্ত ট্রেক করার আনন্দই আলাদা।

কী ভাবে যাবেন 

হাওড়া থেকে তিনটি ট্রেন দেরাদুন যায়। দেরাদুন না নেমে তার আগেই হরিদ্বার নেমে পড়ুন। আর জিপ ভাড়া করুন। আর একা হলে বদ্রীনাথের বাসে উঠুন। অথবা বিমানে দেরাদুন। দেরাদুন থেকে বদ্রীনাথের বাস পাওয়া যায়। অথবা শেয়ার জীপেও যেতে পারেন চামোলি পর্যন্ত। চামোলি থেকে সোজা বদ্রীনাথ। বদ্রীনাথ থেকে মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দূরেই মানা গ্রাম।


কখন যাবেন
মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস হচ্ছে ভারতের শেষ গ্রাম ভিজিটের উপযুক্ত সময়।

More Articles