সাহিত্যের পাতা থেকে বাস্তব, মহিলা গোয়েন্দারা সর্বত্র বিরাজমান

কথায় বলে যে রাঁধে সে কি চুল বাধে না? তা আমাদের বিন্দিপিসী অথবা সদু ঠাকুমা একদিকে যেমন সংসারের খুঁটিনাটি সামলাতে সিদ্ধহস্ত তেমনই অপরাধীদের তত্ত্বতালাশের ক্ষেত্রেও তাদের জুড়ি মেলা ভার। কেউ যেমন কাঁথা সেলাই করতে করতেই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সমাধান করেছেন রহস্যের, তেমনি কেউ আবার সংসার সীমান্তে দশটা - পাঁচটার ডিউটি করার পরও হয়ে উঠেছেন পোড়খাওয়া গোয়েন্দা।

অবশ্য বাংলা সাহিত্যের তুলনায় বিদেশি সাহিত্য এক্ষেত্রে বহুগুণে এগিয়ে, অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের বহু পূর্বেই বিদেশি সাহিত্য আগমন ঘটে মহিলা গোয়েন্দার।১৮৪১ সালে প্রকাশিত হলো অ্যালান পো - র ' দ্যা মার্ডার ইন দ্যা রু মর্গ।' এটিই প্রথম বিদেশি মহিলা গোয়েন্দা কাহিনী হিসেবে সমালোচকদের একাংশের সমর্থন পেলেও এ নিয়ে মতভেদও যথেষ্ট। অনেকের মতে অ্যালান পোর পূর্বে ক্যাথরিন ক্র প্রকাশ করেন - ' দ্যা অ্যাডভেঞ্চারস অফ সুজান হপ্লি, অর সার্কামস্টান্সসিয়াল এভিডেন্স। অবশ্য ক্র - র গল্প আদৌ কতটা আদর্শ গোয়েন্দা কাহিনীর অ- আ - ক- খ মেনে রচিত সে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ গল্পটির অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের অভিমুখ নিয়েই পাঠক মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য। তবে বিদেশি সাহিত্যই কি আমাদের প্রথম মহিলা গোয়েন্দা উপহার দিল? গোয়েন্দা কাহিনীর সমঝদাররা এক্ষেত্রে সহমত পোষণ করলেও বিতর্কের অবসান কিন্তু ঘটছে না। কারণ ঋকবেদে সরমা বলে কুকুরের দেখা মেলে, যার সাহায্যে খোঁজ মেলে গরু চোরদের। কিন্তু কুকুরের নাম হঠাৎ সরমা কেন? তাকে কি তাহলে মহিলা গোয়েন্দার আদলেই গড়তে চাওয়া হল? এ প্রশ্নটা কিন্তু যথেষ্ট যুক্তিসংগত।

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা কাহিনি এক সময় যেন ছিল একপ্রকার দুয়োরানী সন্তান। মেইনস্ট্রিম সাহিত্য দীর্ঘদিন ধরে বেশ খানিকটা বাঁকা চোখে দেখে এসেছে গোয়েন্দা গল্প বা উপন্যাসকে।১৩৩৯ বঙ্গাব্দে শরদিন্দু বাবুর হাত ধরে হাজির হল এক পুরোদোস্ত বাঙালি গোয়েন্দা - ব্যোমকেশ বক্সী। মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, প্রেম, দাম্পত্য, যৌনতা এই সমস্তকিছুকে সঙ্গী করে যাত্রা শুরু করল ষোলো আনা বাঙালিয়ানায় মোড়া এক গোয়েন্দা। বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীর সে এক অভূতপূর্ব জয়যাত্রা, যার সাক্ষী আট থেকে আশির বাঙালি পাঠকসমাজ। ব্যোমকেশের পর সত্যজিৎ রায় নিয়ে এলেন 'ফেলুদা' - কে। সঙ্গী হল জটায়ু এবং তোপসে। সালটা ১৯৬৫। ডিসেম্বরের শহরে কল্লোলিনী তিলোত্তমার মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে সত্যজিৎ রায় কড়া নাড়লেন ২১ নম্বর রজনী সেন রোডে। সৃষ্টি হল আর এক কালজয়ী গোয়েন্দা চরিত্র - ' ফেলুদা।' ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির মধ্য দিয়ে বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীর বৃত্তটি যেন সম্পূর্ণ হলো। কারণ এর আগে গিরিশচন্দ্র বসুর ' সেকালের দারোগা কাহিনী ' প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ' দারোগার কাহিনী ' এবং পরবর্তী সময়ে শরৎচন্দ্র দেবের ' গোয়েন্দা কাহিনী ' তারসঙ্গে নীহাররঞ্জন  গুপ্তের কিরীটি চরিত্রটিও সেভাবে হালে পানি পায়নি। সেদিক থেকে ব্যোমকেশ এবং ফেলুদার কাহিনীর মধ্য দিয়ে বাংলার গোয়েন্দা কাহিনী সর্বপ্রথম সাবালক হয়ে উঠলো।

তবে ফেলুদা বা ব্যোমকেশের প্রবল জনপ্রিয়তার পরেও একথা বলতে হয় বাংলা সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দা যেন ' ডুমুরের ফুল।' অবশ্য তার মানে এই নয় যে বাংলা সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দার ধারাটি নবীন। বিন্দিপিসী অথবা সদু ঠাকুমারও বহু পূর্বে কিন্তু মহিলা গোয়েন্দারা তাদের ' সিক্সথ সেন্স ' - এর পরিচয় দিতে শুরু করেছিলেন।১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে পথচলা শুরু হয় ' ভারতী ' পত্রিকার। এর ঠিক দশ বছর পরে ১২৯৪ - এর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হল নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ' চুরি না বাহাদুরি।' সেই শুরু তারপর ' গোয়েন্দা কৃষ্ণা' সিরিজ, ' কুমারিকা' সিরিজ অথবা নলিনী দাসের ' গন্ডালু' - এর মধ্য দিয়ে একের পর এক মহিলা গোয়েন্দারা জয় করে নিয়েছেন বাঙালি পাঠকের হৃদয়। এরপর অদ্রীশ বর্ধন লিখলেন গোয়েন্দা নারায়নীর কাহিনী। বাঙালি পাঠক যেন এক মুহূর্তে থমকে গেল। শরীরী হিল্লোলের মধ্য  দিয়ে সত্যকে খুঁজে ফেরার এ এক অনবদ্য প্রচেষ্টা। চিরন্তন নীতিবাগীশ মধ্যবিত্ত বাঙালির গালে নারায়নী কষিয়েছিল এক প্রবল থাপ্পড় - সত্যের জন্য শরীর যার কাছে তুচ্ছ। এরপর সুকুমার সেনের ' ইন্দুমতীর সংকট ' গজেন্দ্র মিত্রর ' হীরের টুকরো ' বা পরবর্তীকালে পান্ডব গোয়েন্দার বাচ্চু - বিচ্ছু, অথবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিনমাসি... এই দীর্ঘ পথচলার পরেও বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীর ক্ষেত্রে মহিলা গোয়েন্দাদের একেবারেই ব্রাত্য বলা যায় কি?


আজ এমনই এক গল্প বলব আপনাদের। অবশ্য ' গল্প হলেও সত্যি' ঘটনা এটা। গল্পের মিতিনমাসি আজ যেন নেমে এসেছেন বাস্তবের মাটিতে। গোয়েন্দা বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কোন এক পুরুষের প্রতিচ্ছবি। কে জানে হয়তো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ফল এটা। আসলে আমরা আধুনিকমনস্কতার বড়াই যতই করি না কেন কাজে অনেকাংশেই এখনও ফাঁকা আওয়াজ সে যেন প্রমাণিত হয় প্রতি পদে পদেই। তবে গোয়েন্দা মানেই যে পুরুষ -এই ট্যাবুকে ভেঙে দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের রজনী পন্ডিত। কিন্তু কে এই রজনী পন্ডিত?

১৯৬২ সালে মহারাষ্ট্রের পালঘরে জন্ম রজনী পন্ডিতের। ছোট থেকেই যেন রজনীর রক্তে ছিল টিকটিকিগিরি। বাবা ছিলেন সিআইডির আধিকারিক। বাবাকে দেখেই অনুপ্রাণিত হত একরত্তি রজনী। শুধুই কি গোয়েন্দা নাকি সত্যান্বেষী? অপরাধের ভেতর থেকে সত্যের আলোকে খুঁজে বের করাই যেন রজনীর জীবনের ব্রত। স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রজনী একসময় পা রাখল কলেজে। আর এখানেই গোয়েন্দাগিরিতে একপ্রকার হাতেখড়ি হয়ে গেল তার। কলেজের এক সহপাঠিনীকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে উদ্ধারের মধ্য দিয়ে গোয়েন্দাজগতে পা ফেলল সে। তারপর অক্লান্তভাবে রজনীশ সলভ করে গেছে অসংখ্য কেস। নিখুঁত পর্যবেক্ষণ, অনুমান ক্ষমতার মধ্য দিয়ে রজনী খুঁজে নিয়েছে একের পর এক ক্লু। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি - অপরাধী উঠে এসেছে জালে। গোয়েন্দাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ' হিরকানি অ্যাওয়ার্ড ' - এ সম্মানিত হয়েছে রজনী, এমনকি তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র। না রজনী শুধুমাত্র তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি তার অসামান্য ক্ষমতাকে। রজনী এখন গড়ে তুলেছে তাঁর নিজস্ব ডিটেকটিভ এজেন্সি। আজকের রজনী যেন প্রকৃত অর্থেই আমাদের কাছে মিতিনমাসি, ব্যোমকেশ অথবা ফেলুদা।

বাংলা সাহিত্যে নারী গোয়েন্দারা ফেলুদা ব্যোমকেশ এর মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারলেন না কেন? একি শুধু পাঠকদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফল? যদি তাই হয় তাহলে নারী দিবসের দিনে অবসান ঘটুক সে ভ্রান্ত চেতনার। নাকি কোথাও খামতি থেকে গিয়েছে মিতিনমাসি, কৃষ্ণা অথবা সদু ঠাকুমাকে নিয়ে লেখা গল্পগুলির বুননে? চরিত্র-চিত্রন বা প্লটিং- এর ক্ষেত্রেও বোধহয় ভুলচুক ঘটেছিল কিছু। কারণ যায় হোক না কেন, নারী দিবসের দিনে যেন বাংলা সাহিত্য খোঁজ পায় মিস মার্পেলের, সে যেন বেরিয়ে আসতে পারে সংসার নামক খাঁচা থেকে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারে দশভূজা। এই আশাবাদ নিয়েই নতুন ছন্দে পথচলা শুরু করুক জীবন।

তথ্যসূত্র
১. ' মেয়েরা যখন গোয়েন্দা ' - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২. ' ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি ' - সুকুমার সেন

More Articles