রাশিয়ার মাস্তানির ঝাঁঝ আমাদের হেঁশেলে! গ্যাসের দাম ছাড়াতে পারে সব হিসেব

রাশিয়ার সঙ্গে  অপরিশোধিত তেলের সমস্তরকম বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা নামিয়ে এনেছে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে ব্রিটেনও। গত ৮ মার্চ সে দেশের বাণিজ্যিক সচিব কুয়াসি কুয়ার্তেং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। একই সুরে কথা বলতে শোনা গেছে ক্যানাডাকেও। ইউরোপের  অন্যান্য দেশগুলো এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি ঠিকই, কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানির ক্ষেত্রে তারা বিশেষ সুবিধেজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে নেই। কারণ একটাই,  রাশিয়া যে সমস্ত পাইপলাইনের মধ্যে দিয়ে ইউরোপকে তেল সরবরাহ করে, যুদ্ধের ফলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এমনটা হলে অচিরেই তেল সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়ার থেকে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ বন্ধ হলে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে ইউরোপ? দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই গোটা পরিস্থিতর প্রভাব কি ভারতের এলপিজি-র মূল্যের উপর এসে পড়বে?

‌গোড়াতেই দেখে নেওয়া যাক অপরিশোধিত  তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউরোপের কাছে রাশিয়ার বিকল্প কারা। এই মুহূর্তে গোটা ইউরোপে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে জার্মানি। রাশিয়ার  বিকল্প হিসেবে তারা দ্বারস্থ হতে পারে নরওয়ে, ইউকে, নেদারল্যান্ড বা ডেনমার্কের মতো দেশগুলোর। এদের মধ্যে রাশিয়ার পর ইউরোপে অপরিশোধিত তেল সরবরাহে নরওয়ের স্থান দ্বিতীয়। কিন্তু সেখানকার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে সামগ্রিকভাবে রাশিয়ার বিকল্প হয়ে ওঠার মতো অপরিশোধিত তেল তাঁদের কাছে নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাশিয়াকে বাতিল করে একা নরওয়ের উপর নির্ভরশীল হতে পারবে না জার্মানি। ইতালির মতো  দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোর  অবশ্য তেলের জন্য ‘ট্র্যান্স-অ্যানাটোলিয়ায়ন ন্যাচারাল গ্যাস পাইপলাইন’এর উপর নির্ভর করার মতো সুযোগ রয়েছে।  

যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আমেরিকা যদি ইরানের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে তাকে তেল সরবরাহের নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে বাজারে না নিয়ে আসে, তাহলে সমস্যা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র সমস্যার সমাধান খুঁজতে দ্বারস্থ হয়েছে জাপান এবং কাতারের। দুটো দেশকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইউরোপেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অপরিশোধিত তেল সরবরাহে সমস্তরকম সহযোগিতা করা। জাপান এও জানিয়েছে যে তারা সাধ্য মতো চেষ্টা করবে, কিন্তু উল্টো সুরে গাইছে কাতার। গত ২২ ফেব্রুয়ারি কাতারের জ্বালানি মন্ত্রী সাদ আল-কাবি জানান, এই মুহূর্তে তেল সরবরাহে রাশিয়ার বিকল্প হয়ে ওঠার মতো ক্ষমতা কোনও দেশেরই নেই। তিনি আরও বলেন, ইউরোপের প্রতি বছর গড়ে যতটা অপরিশোধিত তেলের প্রয়োজন পড়ে, তা সরবরাহ করা একা কাতারের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে বহু আগে থেকেই এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়ে রয়েছে। ইউরোপকে তারা ১০-১৫ % এর বেশি অপরিশোধিত তেল দিতে পারবে না।

রাশিয়ার থেকে প্রতি বছর ইউরোপ প্রায় ৩০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন অবশ্য অনেকটাই কম। রাশিয়ার থেকে প্রতি বছর তারা নেয় ১০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল। ইউনাইটেড কিংডমের ক্ষেত্রেও চিত্রটা এক। রাশিয়ার থেকে প্রতি বছর তাদের গড়ে মাত্র ৮ শতাংশ অপরিশোধিত তেলের প্রয়োজন পড়ে। অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র বা  ইউনাইটেড কিংডমের মতো দেশগুলো অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল নেওয়া আপাতত স্থগিত রাখলেও তাদের বিশেষ সমস্যা হবে না। কিন্তু, যুদ্ধের কারণে বাকি ইউরোপের শিয়রে সঙ্কট দেখা দিয়েছে।  নতুন একটা সম্ভবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তেলের জন্য ইউরোপ যেহেতু কাতারের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়েছে, সেহেতু ধরে নেওয়া যেতে পারে, নিজেদের বিপুল প্রয়োজন নিয়ে এবার তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দ্বারস্থ হবে। এর ফলে ভারতও সমস্যার মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে।

নিজেদের বার্ষিক প্রয়োজন মেটাতে ভারতকে প্রায় ৮৪ শতাংশ অপরিশোধিত তেল বাইরের দেশগুলোর থেকে আমদানি করতে হয়। ইউরোপের নিরিখে বিচার করলে পরিমাণটা ৫০ শতাংশেরও বেশি। তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর অবস্থাও তার থেকে সুবিধেজনক । বাংলাদেশকে প্রতি বছর স্রেফ ২১ শতাংশ অপরিশোধিত তেল  আমদানি করতে হয়। পাকিস্তানের প্রয়োজন মাত্র ২৪ শতাংশ। ২০২১ এ ভারত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর থেকে প্রায় ৫২ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে। আফ্রিকার থেকে তার আমদানির হার ১৫ শতাংশ। এ ছাড়াও মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র-র কাছ থেকে ১৪ শতাংশ তেল  আমদানি করতে হয়েছে তাকে। ফলত লক্ষ করা যাচ্ছে, ভারতে-র অপরিশোধিত তেলের প্রয়োজন মেটাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই তার একমাত্র আশা ভরসা। এখান থেকেই সমস্যার চরিত্রটা খানিকটা বুঝে নেওয়া যায়। যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে এবার ইউরোপও যদি নিজের সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভর করে, তাহলে টান পড়বে ভারতের ভাগে। এর ফলে অবধারিতভাবে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি হবে। কারণ, ভারত এতদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের কাছ থেকে যতটা অপরিশোধিত তেল নিয়েছে, তাতে হঠাৎ যদি ইউরোপ দখল বসায়, তাহলে সরবরাহের পরিমাণ কমবে। এরপর ভারতকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্যের বিনিময়ে নিজের জন্য তেল সংগ্রহ করতে হবে। ফলত, একলাফে অনেকটা বেড়ে যাবে এলপিজির দাম।

পেট্রোল আর ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হয়রানি চলছেই। তার উপর এলপিজির দাম বাড়লে এবার কোপ পড়বে সাধারণ মানুষের রান্নাঘরে। এ ছাড়াও উঁকি দিচ্ছে আরেকটা সম্ভবনা। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত ভারত কোনও পক্ষ নেয়নি। নিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই হয়ত সে খানিকটা নীরবতা পালন করেছে। কিন্তু এলপিজি-র মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে কি এবার ভারত পরোক্ষভাবে যুদ্ধের অংশীদার হয়ে উঠবে?

More Articles