পেট চালাতে 'এমএ পাশ তন্ময়'-র ভরসা লটারির দোকান, বড় স্বপ্নটা এখনও অটুট

অতীতে একাধিক পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি না মেলায় অবশেষে লটারির দোকানটি প্রধান ভরসা তাঁর। কেন এই অবস্থার সম্মুখীন এই যুবক, চলুন দেখে নেওয়া যাক।

ভাগ্য কাউকে  প্রাসাদ থেকে রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে, আবার কাউকে 'জিরো' থেকে 'হিরো' করে তুলতে পারে।  আজ আমাদের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে এমন এক যুবক, যার জীবনে সংগ্রামের ইতিহাস শুরু থেকেই চলে আসছে; জীবন একাধিক জোয়ার ভাঁটার সাক্ষী থাকলেও বর্তমানে নতুন আলোর সন্ধানে যাত্রা শুরু করেছে এই যুবক এবং সেই পথে সঙ্গী তাঁর নিজস্ব দোকান। দোকানের নাম- এমএ পাশ লটারিওয়ালা তন্ময়।

দোকানের নাম শুনলে আশ্চর্য লাগতে পারে, কিন্তু বর্তমানে ঠিক এহেন এক দোকানের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে মুর্শিদাবাদের নওদা নামক এলাকায়। সেই যুবক তন্ময়ের জীবন কাহিনিই আমরা তুলে ধরছি; কীভাবে জীবনের প্রতিটি পদে পদে সংগ্রামকে সঙ্গী করে একের পর এক জীবন যুদ্ধ জয় করে চলেছে সেটাই মূল বিষয়বস্তু। একটি লটারি টিকিটের দোকান খুলে জীবন চালাচ্ছেন মুর্শিদাবাদের যুবক তন্ময় চুনারি। অতীতে একাধিক পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি না মেলায় অবশেষে লটারির দোকানটি প্রধান ভরসা তাঁর। কেন এই অবস্থার সম্মুখীন এই যুবক, চলুন দেখে নেওয়া যাক।

ছোটবেলা থেকে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলেছে নওদার এই যুবক। বাল্যকালে বাবা, মা, দাদা এবং বৌদি সহ সুখের সংসার হলেও সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় আচমকাই তাদের জীবনে নেমে আসে বিপত্তি! হঠাৎ একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তন্ময়ের বাবা। এরপরেই মা, দাদা এবং বৌদিকে নিয়ে একপ্রকার দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয় ছোট তন্ময়কে। সেই সময় সংসার চালানোর জন্য স্কুল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো রকম উপায়ই ছিল না তার কাছে এবং অবশেষে স্কুলছুট তন্ময়কে একটি সাইকেলের দোকানের কাজ করতে হয় বলেও জানা গিয়েছে। সারাদিন দোকানে কাজ করার মাধ্যমে যে পয়সা অর্জন করত, তাতেই চলে যেত সকলের সংসার। তবে তার এই সংগ্রাম মাঝেই আবার তন্ময়ের দাদা মুর্শিদাবাদের আমতলা বাজারে খুলে ফেলে একটি লটারির দোকান এবং এরপরেই পুনরায় একবার স্কুলে ভর্তি হয় সে। যদিও পড়াশোনা করার পাশাপাশি দিনের অধিকাংশ সময় রাজমিস্ত্রি, রংয়ের কাজ এবং দিনমজুর হিসেবে কাজ করেই কোনোক্রমে পয়সা জোগাড় করতে হত তাকে। উদ্দেশ্য একটাই, "অভাব-অনটনের মাঝে কোনোমতে সংসার চালানো।" সারাদিন কাজের পরিশ্রম, সে সবের মধ্যেই  স্কুল পাশ করে সে। পরবর্তীতে যতীন্দ্র রাজেন্দ্র মহাবিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলার ডিগ্রিও অর্জন করেন; শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে বাংলা নিয়ে এমএ পাশ করেন তন্ময়। তবে এত ডিগ্রি অর্জন করলেও তার কপালে জোটে কেবল অবহেলা।

ছোট বয়স থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এত পরিশ্রম করলেও ভাগ্যে কেবল বঞ্চনাই জোটে তন্ময়ের। পড়াশোনা শেষ করে তার স্বপ্ন ছিল পুলিশ কিংবা ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দেওয়ার। সেই স্বপ্ন সফল করতেই রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল সহ অন্যান্য একাধিক পোস্ট এবং আর্মির পরীক্ষায় বসেন তিনি। তবে শুধু তাই নয়, ব্যাঙ্ক এবং রেলের পরীক্ষাগুলিতেও অংশগ্রহণ করে তন্ময়। এর মধ্যে বেশকিছু পরীক্ষায় written এবং শারীরিক পরীক্ষায় পাশ করলেও পরবর্তীতে চাকরি পাওয়া যায় না! কারণ অবশ্য এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি , তবে চাকরি না মেলায় একপ্রকার বেকার হয়েই ঘুরতে থাকেন তন্ময়। এর মাঝেই আবার জীবনে নেমে আসে অপর এক অন্ধকার!

পরিবার সূত্রে খবর, কয়েকদিন পূর্বে তন্ময়ের দাদা হঠাৎ মারা যায় এবং পরবর্তীকালে তার মা-ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে অসুস্থ মা এবং সংসারে বাকি সদস্যদের পেট চালানোর জন্য বর্তমানে একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে এই যুবক। স্বভাবতই আর কোন উপায় না পেয়ে বর্তমানে লটারি টিকিট বিক্রি করাই একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে তার; যার পেশাদার নাম এমএ পাশ লটারিওয়ালা তন্ময়। স্বভাবতই, এক্ষেত্রে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করলেও শেষমেষ দোকান খুলে বসে পড়ার ব্যাপারটি বেশ অবাক করে তুলেছে সকলকে আর এই খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পরই তার দোকানে ভিড় জমাতে শুরু করেছে এলাকার মানুষ। তবে লটারির দোকান খুলে নতুন আলোর সন্ধানে পাড়ি দেওয়া সেই তন্ময়ের গলায় ধরা পড়েছে আক্ষেপের সুর। তিনি বলেনন, "অতীতে রেল থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক, পুলিশ এবং আর্মির একাধিক পরীক্ষা দিলেও সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি। একাধিক পরীক্ষায় পাশ করলেও পাইনি চাকরির ডাক। পরবর্তীকালে আমি ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু করি কিন্তু সেখানে যে পরিমাণ টাকা রোজগার হতো, তাতে সংসার চালানো এক প্রকার মুশকিল হয়ে পড়ে আর এই মুহূর্তে আমার ব্যবসা শুরু করার ইচ্ছা থাকলেও পয়সার অভাবে তা সম্ভব হয়নি। তাই পরিবারের দিকে তাকিয়ে আমার কাছে বর্তমানে একটাই রাস্তা খোলা রয়েছে এবং তা হলো লটারির দোকান চালানো। এই লটারি টিকিট বিক্রি করে আপাতত ৩০০ টাকার কাছাকাছি উপার্জন করতে পারছি, তাতেই চলে যাচ্ছে সংসার।"

তবে বর্তমানের লটারির দোকান খুলে বসলেও নিজের আসল স্বপ্নকে সত্যি করার উদ্দেশ্যে কোনো খামতি নেই  এই যুবকের। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন পুলিশ কিংবা আর্মিতে যোগ দেওয়া। সেই কারণেই লটারির দোকানে সারাদিন পরিশ্রম করলেও প্রতিদিন দুটি বিষয় নিয়মমাফিক মেনে চলে তন্ময়। সকাল হলেই দৌড়ানো যেমন এক প্রকার অভ্যেসে পরিণত করেছে সে, ঠিক সেরকম ভাবেই দোকানের ভিতর সময় পেলেই বই পড়তে দেখা যায় তাঁকে। ফলে লটারির দোকানের পাশাপাশি ভবিষ্যতে দেশসেবার কাজে নিজেকে শামিল করার উদ্দেশ্যেই  হেঁটে চলেছেন এমএ পাস তন্ময়।

More Articles