জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী, চোখ ধাঁধানো এক ইন্দ্রজাল-জীবন

প্রেক্ষাগৃহ নিস্তব্ধ, একটা আলপিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যায়।  খানিকক্ষণ আগে পর্যন্ত মঞ্চের উপর ছিল চোখ ধাঁধানো ঝলমলে আলো। তারপর একটু একটু করে আলো কমে এলো, শান্ত হল চারপাশ। হঠাৎ হাড় হিম করা হাসির শব্দ, তার সঙ্গে মঞ্চের উপর পাক খেতে লাগল উড়ন্ত চেয়ার টেবিল। দর্শকদের চোখের পলক পড়ছে না। তাঁরা দেখছেন উইংস থেকে মহিলার বেশে একের পর এক নরকঙ্কাল বেরিয়ে আসছে। মরার খুলি উড়ে এসে মঞ্চের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা জাদুকরের মুখ থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সিগারেট। এমন সময় অবাক কাণ্ড। মরার খুলির দিকে জাদুকর ছুঁড়ে দিতে লাগলেন রাশি রাশি বালি। তারপর সে রূপান্তরিত হল এক অতীব সুন্দরী নারীমূর্তিতে। রোহমর্ষক এই ম্যাজিকের নাম ছিল 'ব্ল্যাক আর্ট' বা 'কালো জাদু'। স্রষ্টার নাম  গণপতি চক্রবর্তী। জীবনের সুদীর্ঘ সময় ব্যয় করে এমন অনেক জাদুর কৌশলই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। আজকের দিনেও সে জাদু ঘিরে জমাট বাধা বিস্ময় আর ফুরোয় না। 

মস্ত জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন মহেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কিন্তু ঐশ্বর্য তাঁর ভাগ্যে ছিল না। সম্পত্তি নিয়ে প্রবল শরিকি ঝামেলা, সকলেই নানান কারসাজি করে নিজেরটা বুঝে নিতে চায়। এই ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়ে নিজের পারিবারিক সম্পত্তির উপর সমস্ত অধিকার হারালেন মহেন্দ্রনাথ, তারপর সালকিয়াতে এসে তৈরি করলেন একটা বাড়ি। ঠাকুর দেবতার প্রতি মহেন্দ্রনাথের প্রবল ভক্তি ছিল।  পুজো-আচ্চা নিয়েই দিন কেটে যেত তাঁর। এ ছাড়াও তিনি সংগীতের সমঝদার ছিলেন। সময় অসময়ে তাঁর হাতে ফুটত  পাখোয়াজের মিঠে বোল। সালকিয়াতেই পরিবার পরিজন নিয়ে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিলেন মহেন্দ্রনাথ। এমন সময় ১৮৫৮ সালের নভেম্বরে  তাঁর ঘর আলো করে জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান। মহেন্দ্র আদর করে তার নাম রাখলেন গণপতি। 

ছোটবেলায় গণপতির দৌরত্ম্যের সীমা ছিল না । পড়াশুনোয় মন নেই বিন্দুমাত্র, দিনরাত শুধু সংগীত আর জাদুবিদ্যায় মজে থাকেন তিনি। মহেন্দ্র তাকে বকাঝকা করেন, শাসানি দেন, এভাবে চললে সম্পত্তির এক ভাগও তিনি দেবেন না তাঁকে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয় না। যত 'উদ্ভট' বিষয়ে তাঁর আকর্ষণ। ধরা যাক তিনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখলেন কোথায় একটা মাদারির খেল হচ্ছে, ব্যস, অমনি দাঁড়িয়ে পড়বেন তিনি। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁ করে দেখে যাবেন সেই খেলা। আশেপাশে কী ঘটে চলেছে তার দিকে তখন গণপতির বিন্দুমাত্র মন নেই। দর্জিপাড়ার রামানন্দ পালের 'নাট্য সমাজ'খানা বড়ই টানে তাঁকে। একদিন দ্বিধা দ্বন্দ ছেড়ে সেখানে গিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন এবং জাদুবিদ্যার প্রাথমিক তালিম নিতে আরম্ভ করলেন ক্ষেত্রপাল বসাকের কাছ থেকে। জওহরলাল ধরের কাছেও তিনি কিছু তালিম পেয়েছিলেন। 

বাউন্ডুলে বলতে যা বোঝায় গণপতি ছিলেন ঠিক তাই। বড়লোক বাবার বাড়িতে সুখ স্বাচ্ছন্দের জীবন বেশিদিন সহ্য হল না তাঁর। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি ভাবছিলেন বাড়িতে থেকে জাদুচর্চা তাঁর হবে না, বেরিয়ে পড়া দরকার। তাঁর এই পরিকল্পনার কথা তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু মণীন্দ্রনাথ লাহাকে। মণীন্দ্রনাথ খানিক উৎসাহ দেখাতেই আর বিলম্ব নয়। দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি ছেড়ে। কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছুই জানেন না। চোখে শুধুই ম্যাজিকের নেশা। মণীন্দ্রনাথ অবশ্য বেশিদিন বাড়িছাড়া হয়ে থাকতে পারেন নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ঘরে ফিরেছিলেন। কিন্তু গণপতি আর ফেরেননি। এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে সময় কাটে তাঁর, মুর্শিদ আর মেলে না। এমতাবস্থায় তিনি ভিড়ে পড়লেন এক সাধু সন্ন্যাসীর দলে। তাঁদের সহকারী হিসেবে সেই দলেই তিনি থাকতেন এবং টুকটাক কিছু কাজ করে দিতেন। 

সাধুসঙ্গ গণপতির পুরোপুরি বিফলে যায় নি। তাঁদের কাছ থেকেই তিনি অল্প কিছু ভেলকির খেলা শিখে নিয়েছিলেন। তারপর কলকাতা যখন ফিরলেন তখন তিনি পরিপূর্ণ যুবক। তাঁর চেহারা দেখে তখন হঠাৎ করে কেউ আন্দাজ করতে পারবেন না যে এই ছেলেই বাল্যকালে তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে বেড়াত। গণপতির যখন ৩৫ বছর বয়স তখন তিনি চাকরি নিলেন প্রিয়নাথ বসুর 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে'। অবশ্য একে ঠিক চাকরি বলা চলে না, কারন কোনোরকম মাইনে তিনি পেতেন না। প্রিয়নাথের সার্কাসে গণপতির দায়িত্ব ছিল দুটো খেলা বা 'আইটেমে'র মাঝখানে অল্পবিস্তর কিছু কারসাজি দেখিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করার। ১৯০৮ সালে প্রিয়নাথ বসুর সার্কাস যখন সিঙ্গাপুর সফরে গেছিল তখন গণপতিও তাদের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন। ততদিনে তিনি বিশেষভাবে আয়ত্ত করেছেন অদৃশ্য হওয়ার খেলা। দর্শকরা দেখেন ছুঁচালো গোঁফওয়ালা যে যুবক দিব্যি তাঁদের সামনে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছিলেন, তিনি হঠাৎ করে কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেলেন। মনে মনে তাঁরা ভাবেন, 'এ কি অলৌকিক ব্যাপার নাকি?' নিছক গল্পকথা নয়, এ ঘটনা সত্যি। সে সময় অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে গণপতি আসলে অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত। 

আরও পড়ুন-বোল পাপিহে বোল রে থেকে গাঁটছড়া, লতাকে নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন সন্ধ্যার মা…

আমেরিকার যেমন ছিলেন হ্যারি হুডিনি, তেমনই বাংলার ছিলেন গণপতি। হুডিনির মতোই তিনি জটিল বন্ধনদশা থেকে সেকেন্ডের মধ্যে মুক্ত হতেন। তাঁর এই খেলার ছিল তিনরকমের নাম, 'ইলিউশন বক্স', 'ইলিউশন ট্রি' এবং 'কংস কারাগার'। ৫৫ বছর বয়সে গণপতি তৈরি করলেন নিজের দল, তারপর দেশ বিদেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। একদিন এক ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন এবং সরাসরি তাঁকে জিগেস করলেন, 'আপনাকে অমন মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলে আপনি যে মন্ত্র বলে সেগুলো ছাড়িয়ে বেরোন সেটা আমাকেও বলুন না।' গণপতি বললেন, 'বাপু হে, মন্ত্রের জোরে করে খাচ্ছি আমি, আর তুমি কিনা আমারই মন্ত্র নিয়ে আমার বাজার খেতে এসেছ? আবদার তো মন্দ নয়।' খানিকক্ষণ পর জানা গেল প্রশ্নকর্তা আসলে মাঝে মধ্যেই আইনের দড়িতে বাঁধা পড়েন। এর লোটা, তার ঘটি এসব চুরি করে আর কতদিনই বা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো যায়। তাই তিনি গণপতির কাছ থেকে তাঁর বন্ধনদশা থেকে মুক্ত হওয়ার গোপন মন্ত্রটা জেনে নিতে চান যাতে কারাগার ছাড়িয়ে ইচ্ছে মতো চোঁচা দৌড় দিতে পারেন। গণপতি বললেন, 'ওভাবে হয় না বাপ আমার। এ মন্ত্র দিনের পর দিন কসরৎ করে আয়ত্ত করেছি আমি। অত সহজেই কি সেটা তুমি শিখে ফেলবে ? বরং চাও তো কিছু টাকাপয়সা নাও, জীবনটা পাল্টানোর চেষ্টা করো।'

শুধু জাদুবিদ্যা প্রদর্শন করেই থেমে থাকেননি গণপতি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও যত্ন করে তার তত্ত্ব পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। 'যাদুবিদ্যা' নামক একটা বই লিখেছিলেন তিনি। তালিম দিয়েছিলেন প্রতুল চন্দ্র সরকার (পিসি সরকার সিনিয়র), দুলাল চন্দ্র দত্ত এবং দেবকুমার ঘোষালের (জাদুসূর্য দেবকুমার) মতো মানুষদের। এঁদের মধ্যে পিসি সরকারই পেয়েছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ ছাত্রের তকমা। গণপতির দর্শকদের তালিকা থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বাদ যাননি।।শান্তিনিকেতনে তাঁর 'ভৌতিক বাক্সের খেলা' দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তিনি। 

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণপতিও তাঁর বাবার রাস্তা অনুসরণ করতে লাগলেন। তাঁর মন গিয়ে পড়ল ঠাকুর দেবতার দিকে। অকৃতদার মানুষটা গড়ে তুলেছিলেন 'কিশোর মোহন কুঞ্জ' নামের একটা মন্দির। সেখানেই দিনের অধিকাংশ সময় তিনি ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। দিনটা ছিল ১৯৩৯ সালের ২০ নভেম্বর। তাঁর মন্দিরে সেদিন উৎসবের ধুম। হঠাৎ রাস্তা থেকে তাঁর কানে ভেসে এলো কোনও মৃত্যু পথযাত্রীর হরিধ্বনি। কেবল খানিকটা মুচকি হাসলেন গণপতি, তারপর রাধা গোবিন্দর মূর্তিকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঝলেন। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল এভাবে, আশেপাশের মানুষজন তাঁকে ডাকতে গেলেন। কিন্তু তিনি তখন কোথায়? মঞ্চে ভেলকি দেখানোর মতো করেই সকলকে শোকস্তব্ধ করে বাংলার জাদু সম্রাট তখন পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। 

তথ্যঋণ: 
শৈলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের লেখনী

উইকিপিডিয়া

More Articles