তিনশো প্রজাতির আম এক গাছে, বিস্ময়ের নাম ম্যাঙ্গোম্যান

সাতটি প্রজাতি জোড়-কলম করে শুরু করেছিলেন, ঝড় বন্যা সেই সব প্রাথমিক প্রচেষ্টার ফল কেড়ে নিয়েছিল। তাঁর কাছ শেখার কীভাবে নিষ্ঠা নিয়ে নিজের পথে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।

কলিমুল্লাহ খান ভারতের আমচাষের জগতে অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। তিনি এবং তাঁর বিখ্যাত আমগাছ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এক গাছে বহু রকম আম ফলিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন তিনি। আধুনিক হর্টিকালচারের প্রথপ্রদর্শক বলা যায় তাঁকে। আম উৎপাদন এবং কলম করতে অত্যন্ত দক্ষ তিনি। প্রায় একা হাতে উত্তরপ্রদেশের আমের জগতে বিপ্লব এনেছেন ভদ্রলোক। অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ এই বৃদ্ধের আমের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে এ জায়গায় পৌঁছতে সাহায্য করেছে বলা যায়।

বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম আম-উৎপাদন ক্ষেত্র। লখনৌ-এর কাছে অবস্থিত মালিহাবাদে কলিমুল্লাহ খানের বাস। বর্তমানে তাঁর বয়েস ৮০। সারা ভারতে তিনি ‘ম্যাঙ্গো ম্যান’ নামেই পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত আমগাছটির বয়েস ১২০ বছর। তাতে ৩০০ ধরনের আম ফলে। গাছটা এতটাই বড়, যে তার ছায়ায় জনা পনেরো লোকের একটা দল আরামে পিকিনিক করতে পারে। প্রতি শাখায় তার বিশেষ বিশেষ ধরনের আম। প্রতি শাখায় পাতাও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। কোনওটা চকচকে এবং হালকা রঙের, আবার কোনওটা গাঢ় সবুজ বা জলপাই সবুজ। আমগুলির গড়ন অদ্ভুত অদ্ভুত। কোনওটি চৌকো, কোনওটি ডিম্বাকৃতি, আবার কোনওটি বৃক্কাকৃতি, সবুজ, হলুদ, বাদামি, গোলাপি, রক্তবেগুনি–কতশত রঙ তাদের। মালিহাবাদে কলিমুল্লাহর বিরাট আমবাগান। মালিহাবাদ জায়গাটাই আমের জায়গা। ১০০০০ হেক্টর অর্থাৎ প্রায় ৪০ বর্গমাইল জমির উপর আমের বাগান রয়েছে এখানে। ভারতবর্ষ গোটা বিশ্বে সর্বোচ্চ আমের জোগান দিয়ে থাকে। প্রায় ১০০০টি ভিন্ন ভিন্ন জাতের আম ভারত থেকে বিশ্বের বাজারে যায়, এবং বিশ্বের মোট আম উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশই হয় ভারতে।

কলিমুল্লাহর ঠাকুর্দা যে বাইশ একর জমিতে চাষ করতেন, সেও ছেলের সাহায্যে সেই জনিতেই চাষবাস করে থাকে। তিনি হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেননি। তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেন চাকরির খোঁজে। খানেদের পরিবার তখন আর চারপাঁচটা সাধারণ আমবাগানের মতোই কিছু প্রচলিত জাতের আমচাষ করত। খানের যখন বছর পনেরো বয়েস, তখন এক বন্ধুর বাড়ির পিছনের দিকে কিছু সঙ্কর গোলাপ দেখে তিনি আশ্চর্য হয়েছিলেন। একই গাছে নানা ধরনের ফুল ফুটছে। আমের কলম করা নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার শুরু ঠিক এই পর্যায়ে। গোলাপ দেখে তাঁর মনে হয়েছিল একই গাছে এমন বিভিন্ন ধরনের ফলও তো তাহলে ফলানো যেতে পারে জোড়-কলমের মাধ্যমে। ১৭ বছর বয়েসেই তিনি জোড়-কলম করতে শুরু করেন। বিভিন্ন জাতের আমগাছের ডাল লাগান একটি আমগাছে। কিন্তু বন্যায় সেই গাছটি নষ্ট হয়ে যায়। ভদ্রলোক অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েন। ফের শুরু হয় তাঁর চেষ্টা। একগাছ থেকে ডাল কেটে অন্য গাছের গায়ে লাগানোয় হাত পাকান তিনি। লক্ষ্য করেন কত ডিগ্রি কোণে ডাল কাটা হচ্ছে, কী ভাবে কাটা ডাল সেই মূল গাছের কাটা অংশে জুড়তে হবে, কী ভাবে তা থেকে এক জোড়-কলম গাছ তৈরি হবে। ১৯৮৭ নাগাদ তিনি প্রায় একশো বছর পুরনো একটি গাছের গায়ে বিভিন্ন ডাল জুড়তে শুরু করেন। সারা পৃথিবী থেকে নানা জাতের নমুনা সংগ্রহ করতেন। চট করে পাওয়া যায় না এমন জাতের আমের দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। বর্তমানে খানের দাবি, এই গাছটিতে ৩০০ টিরও বেশি প্রজাতির আম ফলে। গাছটির নাম রেখেছেন আল মুকুয়ারার, অর্থাৎ ‘দৃঢ়সংকল্প’।

“এই আজব গাছটি শুধু গাছ নয়, এ গোটা আমবাগান, একটা ব্রহ্মাণ্ড” বলছিলেন খান। পাখি বা পোকার উৎপাতের ভয় করেন না তিনি। কাউকেই তাড়ানোর কথা ভাবেননি কখনও। প্রকৃতির জিনিস সবাইকে দিয়ে থুয়েই খেতে হবে বলে তাঁর বিশ্বাস। চাষের সময়ে খান ছেলেকে নিয়ে পেটিতে করে চাষের মাল বাজারে পাঠান, রফতানি করেন, কিন্তু আল মুকুয়ারারের ফল তাঁরা বিক্রি করেন না। বরং যে সব পর্যটক ঘুরতে আসেন তাঁদের বিনামূল্যে দান করে দেন সেইসব আম। শুধু জোড়-কলমই নয়, তিনি নতুন নতুন প্রজাতির আমও তৈরি করেন। গন্ধ এবং স্বাদের নানা সঙ্কর পাওয়া যায় তাঁর বাগানে। সে সবের নতুন নতুন আম। কোনোটির নাম নরেন্দ্র মোদি, কোনোটির নাম ঐশ্বর্য্য রাই, আবার কোনওটি সচিন তেণ্ডুলকর। “আমের নাম রেখেছিলাম বিখ্যাত ক্রিকেটার সচিন তেণ্ডুলকারের নামে, উনি শুনে খুশি হয়েছিলেন, আমাকে ফোন করে জানিয়েও ছিলেন সে কথা” বলেছিলেন খান। খানের সেই বাগান দেখতে বহু বিখ্যাত লোক আসেন। নানা সম্মাননাও পেয়েছেন ভদ্রলোক। ভারতের অন্যতম সেরা সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়া হয়েছে তাঁকে। লিমকা বুক অব রেকর্ডসেও উঠেছে তাঁর নাম। দুবাই এবং ইরানে জোড়-কলম করা শেখাতে গিয়েছেন আমন্ত্রণ পেয়ে। ১৯৯৯ সাল নাগাদ তিনি একটি আমগাছ তৈরি করেন ৫৪টিরো বেশি প্রজাতির আম দিয়ে। রাষ্ট্রপতি ভবনের লাগোয়া মুঘল গার্ডেনে রয়েছে সেই গাছ।

“আমি মারা যাওয়ার পরেও বহুদিন বেঁচে থাকব, এই সব আম, আমার নিজের হাতে তৈরি আমগাছগুলি মৃত্যুর পরেও আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমি বিশ্বাস করি আমার এই কঠিন পরিশ্রমের ফল পাবে সাধারণ মানুষ, এই ফল তাদের কাজে লাগবে।” বলেছিলেন কলিমুল্লাহ খান।  তাঁর কথায়,“প্রকৃতির সৌন্দর্য্য এই, সে দিয়েই যায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।” সাতটি প্রজাতি জোড়-কলম করে শুরু করেছিলেন, ঝড় বন্যা সেই সব প্রাথমিক প্রচেষ্টার ফল কেড়ে নিয়েছিল। তাঁর কাছ শেখার কীভাবে নিষ্ঠা নিয়ে নিজের পথে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। বর্তমানে ৩০ ফুটের তিনশো প্রজাতির আম বিশিষ্ট আমগাছটি তাঁরই সাফল্যের দলিল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা উঁচু করে।

More Articles