কলকাতার গর্ব মার্বেল প্যালেসের অন্দরটা কেমন! জানলে চোখ কপালে উঠবে

একের পর এক সাজানো দোকানঘর। সামনে ভিড় করেছেন অজস্র মানুষ, ভ্যান-রিক্সা আর ঠেলাগাড়ি। অহরহ শোনা যাচ্ছে ফেরিওয়ালার ডাক। থিকথিকে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলে আশেপাশে দেখা যাবে বেশ কিছু মুখরোচকের দোকান। কোথাও বিক্রি হচ্ছে পুরি-সবজি, কোথাও আবার ক্লাব কচুরি। ছোট ছোট শালপাতার চ্যাঙারীতে কচুরি আর চানার তরকারি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কর্মব্যস্ত মানুষ। বড়বাজারের মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে এখন দুপুরের বিরতি। তাই একটু যেন ভিড়। আর এই ভিড় ঠেলে সরু রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোলেই শেষে রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার সুবিখ্যাত মার্বেল প্যালেস। আমীর খুসরো বলেছিলেন, ‘অগর ফিরদৌস বর রুয়ে জমিন অস্ত, হমীন অস্ত, হমীন অস্ত, হমীন অস্ত’, অর্থাৎ ‘যদি স্বর্গ সত্যিই কোথাও থেকে থাকে, তাহলে তা এখানে, এখানে, এখানে।’ স্বর্গ সত্যিই কখনও কখনও আসমান থেকে জমিনে নেমে আসে। মার্বেল প্যালেসকে দেখলেই তার চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যাবে।

উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের কথা। ইংরেজ অধ্যুষিত ভারতবর্ষ জুড়ে তখন নানান কর্ম কাণ্ড ঘটে চলেছে। চারটার্ড আইন নবায়িত হওয়ার ফলে ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ঘটছে পরিবর্তন। বাংলার গভর্নর জেনারেল গোটা ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল হয়ে উঠেছেন। এমন সময় রাজেন্দ্র মল্লিক নামে এক ধনী ব্যবসায়ী খাস কলকাতার বুকে তৈরি করলেন পেল্লায় এক প্রাসাদ। প্রাসাদের নাম রাখা হল ‘মার্বেল প্যালেস’। কলকাতায় সে সময় নানান কারুকার্জ শোভিত প্রাসাদের অন্ত ছিল না। শহরের দক্ষিণভাগে ইংরেজরা থাকতেন। তাই সে অংশের নাম ছিল ‘ওয়াইট টাউন’। কিন্তু কলকাতার উত্তরভাগ ছিল প্রধানত ‘নেটিভ’ অধ্যুষিত। আর এমন ‘নেটিভদে’র মধ্যে পায়রা ওড়ানো, লাখ টাকায় বেড়ালের বিয়ে দেওয়া বনেদিবাবুরও অভাব ছিল না। তাঁদের বাড়ি-ঘরের যে সমস্ত চিহ্ন শহরের এদিক-ওদিক আজও ছড়িয়ে আছে, সে সব দেখলেই আন্দাজ করে নেওয়া যায় কী প্রাচুর্যের মধ্যে দিন যাপন করতেন তাঁরা। কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক প্রাচুর্য দিয়েই তো দৃষ্টিনন্দন কারুকার্জ গড়ে ওঠে না, তার সঙ্গে প্রয়োজন পড়ে শৈল্পিক প্রাচুর্যের। মার্বেল প্যালেসের দেওয়াল জোড়া প্রতিটা নকশার মধ্যে দিয়ে এমন শৈল্পিক প্রাচুর্যের পরিচয়ই পাওয়া যায়।

বাঁকানো লোহার গেটের এপার থেকেই দেখা যায় আগাগোড়া নিও-ক্লাসিকাল নকশায় মোড়া মার্বেল প্যালেসকে। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে ফোয়ারার বাগিচা। ফোয়ারার ঠিক মধ্যিখানে দেবী নেপচুনের মূর্তি। এ ছাড়াও লম্বা পাথুরে জলাধারকে ঘিরে আছেন শীত, বসন্ত, গ্রীষ্মের নানান প্রতীকী মূর্তি। এককালে ফোয়ারা দিয়ে জল গড়াত অষ্টপ্রহর। দৃশ্য দেখে মনে হত যেন কোনও বেহেস্তের বাগান। আজ সে সব দিন গিয়েছে। ইদানিং কালে বিশেষ কোনও উৎসব না হলে ফোয়ারা বন্ধই থাকে।

এ ছাড়াও আছে কোরিন্থিয়ান স্তম্ভ শোভিত টানা লম্বা বারান্দা। প্রত্যেক স্তম্ভের গায়ে গায়ে লাগানো নানান ধাঁচের সাদা পাথরের মূর্তি। বাঙালির বসতবাড়ি থেকে বারান্দা অচিরেই বিদায় নিয়েছে। কলকাতা শহর জুড়ে গজিয়ে ওঠা হাল ফ্যাশনের ফ্ল্যাটবাড়িতে শোবার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া এক ফালি বারান্দা হয়ত থাকে, তবে তা ব্যবহার করা হয় প্রধানত ভিজে কাপড়-জামা মেলার প্রয়োজনে। একসময় মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে অবসরের অভাব ছিল না। আড়মোড়া ভাঙা দুপুরের পর সে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসত, তারপর সন্ধে নামত ধীরে। কালে কালে বাঙালি হাইটেক হয়ে উঠল। তার জীবনের ‘ভালোবাসার বারান্দা’-টুকুও দূরে সরে গেল। আজকাল এলইডি টিভি আর অত্যাধুনিক ডাইনিং সেটে সাজানো ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে বারান্দা বলে যাদের চালানো হয়, মার্বেল প্যালেসের সামনে  হয়ত তারা লজ্জায় মুখ লুকোবে।

এবার আসা যাক প্রাসাদের অফিসঘরের কথায়। বিশালাকৃতি সেই ঘরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখ যায় মাঝ দেওয়ালে। দেওয়াল জোড়া নানান মাপের পেইনটিং, অধিকাংশই বাড়ির আদিপুরুষদের। চোখে চমক নিয়ে যখন আপনি এ সমস্ত পেইনটিংয়ের সৌন্দর্য বিচারে ব্যস্ত, ঠিক তখনই আপনার চোখ সিলিঙের দিকে যেতে বাধ্য। ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতি’র কথা আমরা শুধু মান্না বাবুর গানেই শুনে এসেছি। চাক্ষুষ দেখবার আর সৌভাগ্য হয়নি। তবে মার্বেল প্যালেসের অফিসঘরের সিলিঙে ঝুলন্ত কাঠের  রাজকীয় ঝাড়বাতিখানা দেখে সে আক্ষেপটুকু হয়ত আর থাকবে না।

অন্দরমহলের হলঘরের সংখ্যা সাকুল্যে পাঁচটা। ছবির ঘর, রিসেপশনের ঘর, মূর্তির ঘর, ব্রিলিয়ার্ড খেলার ঘর আর ঠাকুর দালান। মাথায় রাখতে হবে এই বাংলাতেই ভারতীয় মহাকাব্যকে গ্রিক এপিকের ধাঁচে পুনর্লিখন করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। হোমারের ইলিয়াদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ এসে পড়েছিল দান্তে এবং তাসসোর প্রভাব। সে কাব্যে শিব বা রামের মতো দৈবিক চরিত্ররাও ছিলেন গ্রিক দেবতাদের মতো ‘বিধাতার অধীন’। মার্বেল প্যালেসের ঠাকুর দালানেও এমন সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের সন্ধান পাওয়া যাবে। ঠাকুর দালানে পা রাখলেই দেখা যাবে হাতে আঁকা বিরাট ম্যুরাল। ভারতীয় আর গ্রিক পুরাণের ছবি মিলিয়ে সেই ম্যুরাল যেন গল্প কথার মহাফেজখানা। কী নেই তাতে? একদিকে সগৌরবে বিরাজ করছেন লক্ষ্মণ, সূর্পণখার মতো রামায়ণের চরিত্ররা। অন্য দিকে রয়েছেন অ্যাপলো বা ডায়নার মতো গ্রিক পুরাণের কুশীলবরা। তারই মধ্যে সময় সময় চলতে থাকে পুজো-পার্বণ। দুর্গা পুজো থেকে আরম্ভ অরে কালী পুজো, কিছুই বাদ যায় না মার্বেল প্যালেসে। এ ছাড়াও নিয়মিত আরাধনা হয় গৃহ দেবতা জগন্নাথের।

যে কোনও সময়ে মার্বেল প্যালেসের অন্দরমহলে দাঁড়ালে শোনা যাবে রং-বেরংয়ের পাখিদের শিস। দোয়েল, ম্যাকাও, ময়না সহ আরও হরেক রকম পাখির বাস এ বাড়ির অন্দরে।  বাড়ির সদস্যরা নিয়মিত সে সমস্ত পাখিদের যত্ন নেন। রাজেন মল্লিকের ছিল চিড়িয়াখানার শখ। বহু দেশ ঘুরে নানান পশু-পাখি সংগ্রহ করে তিনি তাঁর বাড়িতেই তৈরি করেছিলেন একটা চিড়িয়াখানা। তার বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল বেশ কিছু পর্ক্যুপাইন, বেবুন, বার্কিং ডিয়ার, ইত্যাদি। সারা ভারতে খুঁজলেও হয়ত এমন ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার সন্ধান আর পাওয়া  যাবে না। মার্বেল প্যালেসে আজকের দিনেও সেই ঐতিহ্য বজায় রয়েছে। যদিও, সেখানে পশু-পাখির সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।

একসময় মার্বেল প্যালেসে বেশ কিছু ছবির শ্যুটিং হয়েছে। স্বয়ং উত্তম কুমারও নাকি এ বাড়িতে এসে শ্যুটিং করে গেছেন। এ ছাড়াও এসেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রাসাদের বাগানে বসে রবীন্দ্রনাথের ১২৫ তম জন্মদিনে তিনি গান গেয়েছিলেন। হেমন্তর উদত্ত কণ্ঠের সুরে মার্বেল প্যালেসে যেন সেদিন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

More Articles