দিনভর মোবাইলে টেক্সট ? পিঠে নিচ্ছেন ১০০ কেজির বোঝা, সতর্কতা চিকিৎসকদের

সুসেন: অবশ হয়ে যা্চ্ছে ডান হাতটা। নুডল সমেত চামচটাও তুলতে পারছে না বছর ষোলোর স্নেহা। দিন সাতেক ধরে অভিষেকের কনুইয়ে চিনচিনে ব্যথা। এমন সব নানা উপসর্গ নিয়ে নিত্যদিন ভিড় বাড়ছে শহরের হাসপাতালে। রোগীদের পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা বলছেন, স্নায়ুর অসুখ। মাত্র বছর ষোলো -সতেরোয় এই পরিস্থিতি? সূত্র খুঁজতে গিয়ে ‘ভিলেন’ চিনতে পেরেছেন ডাঃ চন্দ্রশেখর কুণ্ডর মত অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞরা। তালুবন্দী স্মার্ট ফোন। করোনা আবহে বন্ধ স্কুল-কলেজ। মোবাইলেই চলছে পড়াশোনা। বাইরে যাওয়া যখন কার্যত বন্ধ সে সময়েই গোপন আততায়ীর মত শরীরে ছোবল মারছে এই ধরণের উপসর্গ। ঘরবন্দি কিশোর-কিশোরীর মোবাইল আসক্তির মাশুল দিচ্ছে স্নায়ু।

দিনভর মোবাইলে টেক্সট ? পিঠে নিচ্ছেন ১০০ কেজির বোঝা, সতর্কতা চিকিৎসকদের

চিত্র ঋণ : Google

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, স্মার্ট ফোনে রাত-দিন আঙুলের নাড়াচাড়া, শরীরের মারাত্মক অসুখ নিয়ে আসছে। পিয়ারলেস হাসপাতালে্র অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সোমনাথ দে-র কথায়, মোবাইল ব্যবহারে তিনটি আঙুলের ওপর চাপ পড়ে সবচেয়ে বেশি। বুড়ো আঙুল আর তর্জনি দিয়ে টাইপ/স্ক্রল চলে সারাদিন। আর হাতের সবচেয়ে ছোট আঙুলটা মোবাইলটা হাতের তালুতে ধরে রাখার সাপোর্ট দেয়। এই তিন আঙুলের মাধ্যমেই শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিন স্নায়ুর চলাচল। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে ওই স্নায়ুগুলোয় চাপ পড়ছে। একসময় তা স্থিতিস্থাপকতা হারাচ্ছে। তাতেই বাসা বাঁধছে অসুখ।

ডাঃ শান্তনু বসু মল্লিকের মত চিকিৎসকদের বক্তব্য, সারাক্ষণ মোবাইলে লিখলে বুড়ো আঙুল, তর্জনির অতিরিক্ত ব্যবহার হয়। আঙুল দুটির কাছাকাছি থাকা স্নায়ুর ওপরে বাড়তি চাপ পড়ে। এর জেরে প্রথমে আঙুল অসাড় লাগে। তারপর থেকে শুরু হয় কনুইয়ে চিনচিনে ব্যথা। ডাক্তারি পরিভাষায় এ সমস্যার নাম কিউবিটাল টানেল সিনড্রোম। ছাত্র-ছাত্রীদের মোবাইল ব্যবহারের সময়সীমা জানতে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এক গবেষণা চালিয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ। সেই গবেষণার তথ্য বলছে, কলেজে পড়া ছাত্ররা দিনে অন্ততপক্ষে দেড়শোবার নিজের মোবাইল চেক করে। লকডাউন আবহে তা দ্বিগুণ হয়েছে বলেই মত অভিভাবকদের। অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অনেকেই বলছেন হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে দীর্ঘক্ষণ হাতে কোনও সাড় থাকছে না। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে নাম্বনেস। বুড়ো আঙুল আর তর্জনির ভিতরকার ‘মিডিয়ান’ আর ‘রেডিয়াল’ নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলেই এমনটা হয়। অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দ্রশেখর কুণ্ডর কথায়, শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নন, চিকিৎৎসার জন্য স্নায়ুরোগীর তালিকায় রয়েছেন প্রবীণ-মধ্যবয়স্করাও।

ঘরবন্দি অবস্থায় সকলেই বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে সারাদিন মেসেজ আদান প্রদান করেছেন। যত কথা মোবাইলের মাধ্যমে বলছেন এত কথা তাঁরা সারাদিনে মুখোমুখি কারও সঙ্গে বলেন না। দীর্ঘক্ষণ মোবাইলে টাইপ করা থেকেই বাড়ছে পিঠের ব্যথা-সহ মেরুদণ্ডের নানা সমস্যাও। ডাঃ অমিতাভ ভট্টচার্যের মত বিশেষজ্ঞদের দাবি, মোবাইলে লেখার সময় আমাদের পিঠে অজান্তেই একটা বোঝা চেপে যায়। কীভাবে? চিকিৎসকের ব্যখ্যা, টেক্সট করার সময় সকলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ে। এতে মেরুদণ্ড একটা বিশেষ কোণে বেঁকে থাকে। আর তার ফলে মেরুদণ্ডে যে পরিমাণ চাপ তৈরি হয় তার ওজন প্রায় কুড়ি কিলোগ্রামের কাছাকাছি। কেউ দিনে পাঁচ ঘণ্টা টেক্সট করছেন মানে টানা পাঁচ ঘণ্টা একটা ২০ কেজির বোঝা ঘাড়ে নিয়ে রয়েছেন। মানে সব মিলিয়ে একশো কেজি। এই জন্য অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে পিঠের ব্যথার মত সমস্যা। কোভিডের কারণে সব কাজ হচ্ছে বাড়ি থেকে। অসম্ভব পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে মোবাইলের ব্যবহার। এজন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ, পিঠের ব্যথা ও স্নায়ুর রোগ থেকে মুক্তি পেতে অকারণে মোবাইল ব্যবহার করবেন না।

মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অতিরিক্ত সময় বার্তা পাঠানো, চ্যাটিং করার ফলে ঘুমের মধ্যেও এর প্রভাব পড়তে পারে। হতে পারে ‘স্লিপ টেক্সটিং’ সমস্যা।  এ সমস্যা হলে রাতে ঘুমের মধ্যে কাকে কী বার্তা পাঠানো হয় তা আর পরে মনে থাকে না। বার্তা পাঠানোর বিষয়টি মাথায় থাকে বলে ঘুমের মধ্যেও হাতের কাছে থাকা মুঠোফোন থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত নম্বরে বার্তা চলে যায়। মনোবিজ্ঞানী ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, দুশ্চিন্তা, কাজের চাপ আর মুঠোফোন নিয়ে অনেকের দিন কাটে। এমন অবস্থায় স্লিপ টেক্সটিং ঘটতে পারে। রাতে বিছানার পাশে মুঠোফোন না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

দিনভর মোবাইলে টেক্সট ? পিঠে নিচ্ছেন ১০০ কেজির বোঝা, সতর্কতা চিকিৎসকদের

চিত্র ঋণ : Google

ডাঃ সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত চক্ষু বিশেষজ্ঞরা আবার অন্য একটি সমস্যার দিকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে জানিয়েছেন, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে। যার ফলে মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত চোখ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে ফোন ব্যবহার করেন। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে এ দূরত্ব মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার। সংবাদপত্র, বই বা কোনো কিছু পড়ার ক্ষেত্রে সাধারণত চোখ থেকে গড়ে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্ব থাকে। চোখের খুব কাছে রেখে অতিরিক্ত সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে স্থায়ীভাবে আরও গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলতে যার গুরুতর ভূমিকা আছে। গবেষকেরা একে ‘এপিজেনেটিকস’ সংক্রান্ত বিষয় বলেন। এজন্য ডাঃ আগরওয়ালস হসপিটালের চিকিৎসক সুদীপ গুঁই দীর্ঘক্ষণ ধরে স্মার্টফোনে চোখ না রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। দৈনিক বেশ কিছুটা সময় মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বয়স বিবেচনার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন ওই চিকিৎসক।

মুঠোফোন ব্যবহারের ফলে কানের সমস্যা তৈরির বিষয়টি অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। হেডফোন ব্যবহার করে উচ্চশব্দে গান শুনলে কানের ভিতরের কোষগুলোর উপর প্রভাব পড়ে এবং যার ফলে মস্তিষ্ক অস্বাভাবিক আচরণ করে। একসময় বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার ফলে সবথেকে বেশি দেখা দেয় ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা। স্পষ্ট সতর্কবার্তা বিশিষ্ট ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডাঃ তরুণ পালিতের। যারা ঘুমাতে যাওয়ার আগে এ ধরনের প্রযুক্তি-পণ্য অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন তাদের শরীরে মেলাটোনিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে; যার কারণ প্রযুক্তিপণ্য থেকে নির্গত বিশেষ ধরণের উজ্জ্বল আলো। তার ফলে একটি পর্যায়ে ঘুমের মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয় এবং স্লিপ ডিজঅর্ডারের মত বিপজ্জনক ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই যদি সুস্থ থাকতে চান তাহলে মোবাইলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি করুন, যেন আমজনতার প্রতি শেষ সতর্কবার্তা শোনালেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ অরিন্দম বিশ্বাস।

তথ্যসূত্র - জনস্বাস্থ্য বার্তা, মার্চ, ২০১৭, সংবাদ প্রতিদিন - ১২ জুলাই, ২০২১, প্রথম আলো - ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

চিকিৎসকদের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া

More Articles