পুকুর থেকে পাওয়া গিয়েছিল নরকঙ্কাল, সন্ধের পর এই রাজবাড়ির আশপাশে আসে না কেউই

বাহুবলীন্দ্র রাজবংশের একটি গুপ্তকক্ষ আছে। সেটি মাটির নিচে অবস্থান করছে। সেই কক্ষের দেওয়ালে বিভিন্ন আকৃতির কুলুঙ্গি দেখা যায়।

ঘরের ভিতর ঘর

তার ভিতরে ঘর

 

এমনই একটি প্রচলিত ধাঁধা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। ময়নাগড় রাজপ্রাসাদ ঠিক এমনই। বাইরে থেকে দেখতে একতলা মনে হলেও, আসলে প্রাসাদটি দ্বিতল। অদ্ভুত দেখতে এই ময়নাগড় রাজপ্রাসাদ। সাধারণত আমরা জানি, ঘরের ওপর ঘর, তার ওপরে ঘর। কিন্তু এই রাজপ্রাসাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উল্টো। ঘরের নিচে ঘর, তার নিচে ঘর। এমন একটা প্রাসাদ, রাজপ্রাসাদের নিচেতেই রয়েছে। এই বিষয়টি জানতেন না বর্তমান রাজপুরুষদের কেউই।সংস্কারের সময় জানা গেল, প্রাসাদের নিচে আরেক প্রাসাদের অস্তিত্ব। পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নাগড় রাজপ্রাসাদের এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ না করলে বোঝাই যায় না যে, এটি একটি দ্বিতল প্রাসাদ এবং এর নিচে আরও একটি প্রাসাদ রয়েছে। ঘরের মধ্যে পনেরোশো শতাব্দীতে তৈরি পুরনো শ্যামসুন্দর জিউ-র মন্দির এবং ষোলোশো শতাব্দীতে তৈরি পুরনো লোকেশ্বর মন্দির রয়েছে। এই লোকেশ্বর শিব খুব জাগ্রত দেবতা বলে স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস। নিত্যপুজোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রতি সোমবার এই মন্দিরে সাধারণ মানুষের ঢল নামে।মনস্কামনা জানিয়ে মানুষ পুজো দেয় মন্দিরে। এই শিবমন্দিরটি আধুনিক কালে নির্মিত হলেও এর পূর্ব দিকের ভিত্তি-সংলগ্ন দেওয়ালের পাদদেশে আছে উৎকৃষ্টমানের টেরাকোটার কাজ। হয়তো সেগুলো কাছাকাছি কোনও মন্দির থেকে সংগ্রহ করা। টেরাকোটাগুলির মধ্যে রয়েছে পতাকাধারী মুসলমান সৈনিক, অশ্বারোহী শিকারী, নৌকোবিলাস, হার্মাদ রণতরী ইত্যাদি। বাহুবলীন্দ্র রাজবাড়ির পূর্বদিকে রয়েছেন এই স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ। এখানে যে শিবলিঙ্গটি রয়েছে সেটি প্রায় চোদ্দ থেকে পনেরো ফুট নিচে অবস্থান করছে। পূর্বে রাজাদের রাজত্বকালে কংসাবতী নদী পর্যন্ত সুড়ঙ্গপথ এখান দিয়েই তৈরি হওয়ার কারণে, কংসাবতীতে অতিরিক্ত জলোচ্ছাস হলে শিবলিঙ্গ জলে ডুবে যায়। এই মন্দির ও শিবলিঙ্গ মহারাজা লাউসেনের আমলে তৈরি হয়। অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর পূর্বে। আমরা সকলেই জানি, শিবঠাকুরের মানসকন্যা হলেন মনসা। এই লোকেশ্বর মন্দিরের পাশেই আছে একটা সুবৃহৎ মনসা গাছ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, গাছটির গুঁড়িতে প্রাকৃতিক নিয়মে তৈরি হয়ে রয়েছে একটা শিবলিঙ্গ।

 বাংলার জনপ্রিয় লোকগাথার নায়ক লাউসেনের স্মৃতিধন্য এই ময়নাগড় কংসাবতীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। দ্বীপের মধ্যে দ্বীপ হল ময়নাগড়, ধরাছোঁয়ার বাইরে লোকচক্ষুর অন্তরালে আশ্চর্যভাবে লুকিয়ে থাকা দ্বীপ হল ময়নাগড়। এই রাজপরিবারের কুলদেবতা হলেন পাঁচশো বছরের পুরনো শ্যামসুন্দর জিউ। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্যামসুন্দর রাসযাত্রা শুরু হয়। শ্যামসুন্দর জিউ-র রাসযাত্রা নৌকো করে হয়। সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে এটি একটি বিরল ঘটনা।রাসপূর্ণিমার সন্ধ‍্যায় জমকালো সাজে, রাজঘাট দিয়ে নেমে সুসজ্জিত নৌকোয় চড়ে ঘোরে শ্যামসুন্দর জিউর প্রতিরূপ। এই রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে আতসবাজি, আলোর মালা, শঙ্খ ঘণ্টা, খোল-করতাল বাজিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে হিন্দু-মুসলিম, সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। অনির্বচনীয় সেই দৃশ্য। রাসপূর্ণিমায় উৎসব চলে আটদিন ধরে। শ্যামসুন্দর জিউর মূর্তি ভোর তিনটের সময় মন্দির থেকে বের হয়ে কালিদাসের জলে নৌকায় চড়ে রাসমঞ্চে ভোর পাঁচটায় পৌঁছয়। দুপুর দুটো পর্যন্ত ভক্তদের পুজো গ্রহণ করে সেই মূর্তি পুনরায় মন্দিরে দ্বিপ্রাহরিক ভোগ গ্রহণের জন্য ফিরে আসে, আট দিন ধরে এই নিয়ম কার্যকরী হয়।

ময়নাগড়ের রাজারা পূর্বে ছিলেন উৎকলবাসী। তাই জগন্নাথ দেবের নিয়ম মেনেই এখানে শ্যামসুন্দর জিউ-র ভোগ রান্না হয় সম্পূর্ণ কাঠের জ্বালে এবং মাটির উনুনে। এখানে একটি কাঁঠাল গাছ আছে, যার বয়স ২০০ বছর। অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪২ সালে। প্রবল ঝড়ে ময়নাগড়ের প্রায় সমস্ত গাছ মাটি থেকে উপড়ে পড়ে যায়, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই গাছটির কোনও ক্ষতি হয়নি। আয়লা, ফণী, আমফান, ইয়াশ- বর্তমানে ধেয়ে আসা কোনও ঝড়েই এই গাছটির কোনও ক্ষতি হয়নি। আরও একটি রহস্য হলো, গাছটি ক্রমশ মাটির তলায় বসে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে হয়তো এটি 'বনসাই'-তে পরিণত হবে।

 

এই রাজবাড়ির পিছনের অংশ প্রায় ধ্বংসের মুখে। সামনের অংশ এখনও কিছুটা অটুট রয়েছে। এই বাড়িটির আসল বৈশিষ্ট্য হলো, এর নিচে আরও একটি প্রাসাদ বর্তমান। এই বাড়িটির গঠনশৈলী অদ্ভুত ধরনের। সিঁড়ি দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে, একদিকে ষোলোটি সিঁড়ি এবং অন্যদিকে মাত্র চারটি ধাপ উঠলেই দ্বিতলে পৌঁছনো যায়। এই রাজপরিবারের রানিদের জীবন খুব একটা সুখকর ছিল না, একপ্রকার বন্দিদশা কাটাতেন তাঁরা। বাইরের জগতের সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্ক থাকত না এবং কোনও অবস্থাতেই তাঁদের বাইরে আসার অনুমতি ছিল না।

Moynagarh palace

বাহুবলীন্দ্র বংশের অন্যতম রাজা ছিলেন রাধা শ্যামানন্দ আর তাঁর রানির নাম ছিল অপূর্বময়ী। এখানকার রাজদরবারে মাঝে মাঝেই বসত বাইজি নাচের আসর। নর্তকী ছিলেন নামকরা বাইজি ময়নামতি। রানি অপূর্বময়ী কখনওই মেনে নেননি স্বাধীনতার নামে রাজাদের এই স্বেচ্ছাচারিতাকে। একদিন রাজা রাধাশ্যামানন্দ ছিলেন দুর্গের বাইরে। সেই সুযোগে রানি গিয়ে উপস্থিত হলেন ময়নামতির মহলে এবং ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে ফেললেন ময়নামতির নাকের নথ। হতচকিত ময়নামতি কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন রানির দিকে, তারপর প্রণাম করে বললেন, "আমার পরম সৌভাগ্য, এই পাপী চোখে প্রথম দেখলাম রানিমা-কে।" কিন্তু বাহুবলীন্দ্র রাজা রাধা শ্যামানন্দ এতটা সহ্য করতে পারেননি। অন্দরমহলের শত শত বছর ধরে সঞ্চিত মানমর্যাদার মাটিতে মিশে যাওয়া সহ্য হয়নি তাঁর। পরের দিন কারিগর এনে রাজদরবারের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র দরজাটি চিরতরে বন্ধ করে দেন তিনি, সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় রাজদরবারের সঙ্গে অন্দরমহলের যাতায়াতের একমাত্র পথ।

১৭৭৩ সাল, তখনকার রাজা জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্র ব্রিটিশ সরকারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করেন, ফলে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সৈন্যদল পাঠিয়ে দেন রাজাকে গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্যে।রাজা মাটির নিচের প্রাসাদে আত্মগোপন করেন, ইংরেজ সৈন্যদল তন্নতন্ন করে খুঁজেও রাজার হদিশ না পেয়ে ফিরে যায়।

এই রাজবাড়ির পিছনেই পুরনো রাজবাড়িটি রয়েছে, বর্তমানে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখন পরিবেশ-পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, সন্ধ্যার আগেই এখানে কেউ আসে না, গা-ছমছমে পরিবেশ, নানা অদ্ভুত আওয়াজ, কান্না ও গোঙানি এবং আরও বিচিত্র শব্দ পাওয়া যায় বলে জনশ্রুতি আছে। এর ঠিক পিছনেই আছে একটি পুকুর। এটি আগে ছিল অনেক বড় একটি দিঘি। এখন মজে গিয়ে ডোবায় পরিনত হয়েছে। যাঁরা রাজবিদ্রোহী বা বিভিন্নভাবে অপরাধী সাব্যস্ত হতো, তাঁদের এই পুকুরে ডুবিয়ে হত্যা করা হতো। বছর দুই আগে এই পুকুরটি সংস্কার করার সময় দু'নৌকো ভর্তি নরকঙ্কাল এই পুকুরটি থেকে উদ্ধার হয়।ময়নাগড় দুর্গটিকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে পরিখায় অসংখ্য কুমির ছাড়া থাকত, এছাড়া পরিখার পাড়ে কাঁটা বাঁশঝাড় এমনভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে রাখা হতো, যার ফলে শত্রুর লৌহ তির প্রবেশ করতে পারত না।

বাহুবলীন্দ্র রাজবংশের একটি গুপ্তকক্ষ আছে। সেটি মাটির নিচে অবস্থান করছে। সেই কক্ষের দেওয়ালে বিভিন্ন আকৃতির কুলুঙ্গি দেখা যায়। কোনওটি চৌকো, কোনওটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি, কোনওটি লম্বা। এখানে একটি সিন্দুক আছে, যেটা খোলা যায়নি বলে ঢালাই করে দেওয়া হয়েছে। জনশ্রুতি আছে এই ঘরটিতে জ্যোতিষচর্চা হতো। এখানে একটি সুড়ঙ্গ আছে, যার মুখটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সুড়ঙ্গ কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে কেউ জানে না।

More Articles