জেলা ভাঙার যুক্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে কান্নাচাপা আবেগ

Nadia Divide: একবার ভেঙেছে দেশ, তার জ্বালা মেটানোর মতো বার্নল এখনও এসে পৌঁছায়নি! আবার ভাঙছে, আরও একবার পুড়ছে তবে হৃদয়?

রিফিউজি! ছিন্নমূল! বাঙাল -- কতই না সম্বোধন!

আজ হঠাৎ করেই মনে পড়ছে বাংলা ভাগের স্মৃতি। মনে পড়ছে, 'মোদের কোনও দ্যাশ নাই, মোদের কোনও ভাষা নাই... '-এর মতো শব্দবন্ধদের। আজকে ২০২২-এ দাঁড়িয়েও এই পঙক্তি ভীষণই প্রাসঙ্গিক। দেশ হারানোর ইতিহাস বয়ে চলে যুগ থেকে যুগে। এ যেন নদীর চলন! উৎখাত হওয়ার যন্ত্রণা, শুকনো রক্তের গন্ধ চাপ চাপ হয়ে লেগে থাকে শরীরে। আমরা যারা ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭-এর পার্টিশন কিংবা '৭১-এর দেশভাগ দেখিনি, তারা আজ কাঁটাতারহীন অদৃশ্য দেখাতে ভাগ হতে দেখছে বাঙালির আবেগকে। আমি লেখক নই, তাই শব্দের মায়াভাষ্য বোনার সাধ্য নেই। তবে এই মফস্বলে বেড়ে ওঠা, নদিয়ার এক সাধারণ মেয়ে। যার কাছে তার নিজের জেলার প্রতিটা বিখ্যাত জায়গা কিংবা একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামও আপন। যার হদিশকে-ই বা রেখেছে! শহরতলির সেই মেয়ের দেখার চোখ যে সম্পদের থেকেও ধনী তা হলফ করে বলা যায়। বলবো, সেই নদিয়ার কথা--- যতটা সম্ভব সহজ করে বলবো কারণ সব্বাই তো সবই জানে! তবুও এই লেখা তিমির বিলাসি হিসেবে নয়, কবির কথা অনুযায়ী তিমিরবিনাশী হতে চেয়ে। কিন্তু পেরেছি কতটা!

রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নতুন করে আরও কয়েকটি জেলা ঘোষণা করেছেন।  কতবারই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে দেশ, ভেঙে গেছে আবেগেভরা হৃদয় -- তার খোঁজ কে-ই বা রেখেছে? মনে পড়ছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ছড়ার দুটো পঙক্তি  -

'তেলের শিশি ভাঙল বলে/খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো।'

না, এবার ভারত ভাঙেনি কিন্তু ভেঙেছে নদিয়া জেলা। আমাদের প্রাণের নদিয়া। কত ব্যঞ্জনা, কত বিশেষণ দিয়ে বোঝানো এই নদিয়া আপামর নদিয়াবাসীর কাছে কতটা। এখানকার বিশিষ্ট মানুষেরা কলম ধরবেন, মিটিং-মিছিল করবেন; কেউ পক্ষে, কেউ বা বিপক্ষে করা বলবেন কিন্তু আমরা যারা একেবারে আটপৌরে তাদেরও তো অনেক শব্দ আছে, ভাষা আছে, আছে প্রকাশ ভঙ্গি। নদিয়া ভেঙে নদিয়া ও রানাঘাটে ভাগ হলে প্রশাসনিক দিক সামলাতে সুবিধা হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে---সবই বোঝে মস্তিষ্ক। তবুও ওই যে মস্তিষ্কের 'ম' আর মনের 'ম'-এর মধ্যে রয়েছে তফাৎ। ভেঙে গেলে, ভাঙবে মানুষের আবেগও তখন যন্ত্র আর মানুষের ভেদ বোঝাতে আবার প্রয়োজন হবে ধনঞ্জয় বৈরাগীর কিংবা কিশোরের। শাসকের রক্ত চক্ষুকে কটাক্ষ করে, তাদের মারের মুখের উপর দিয়েই সে ফুল এনে দেবে। মুক্তধারার বাঁধ ভেঙে দেবে অভিজিৎ!

নদিয়া মানে তো কেবল কৃষ্ণনগর নয়। এই নদিয়ার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দ্যাশের বাড়ি, নাড়ির টান, শিকড়ের গন্ধ। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ-কাঁটাতার মানুষকে ভিটে ছাড়া করে। আজ এই জেলা ভাগ যেন আমাদের অস্তিত্বকে প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। জেলা ভাগের পাশাপাশি রক্তাক্ত হচ্ছে এই জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারত স্বাধীন হলেও, নদিয়ার নবদ্বীপ বাদ দিয়ে বাকি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপরেই নদিয়ার ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন রানি জ্যোর্তিময়ীদেবী। সেই লড়াইয়ের ফল স্বরূপ ১৮ অগস্ট স্বাধীনতা পায় নদিয়ার বাকি অংশ, কৃষ্ণনগর-রানাঘাট। এই জেলার প্রতিটা শহরে, মফস্বলে, গ্রামে, প্রান্তে-উপান্তে অজস্র স্মৃতি, ইতিহাস লেগে রয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের পীঠস্থান নদিয়া, তাকে কি এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়? মায়ের এক সন্তানকে কেটে দু-টুকরো করলে তাকে কি বাঁচানো যায়?

নদিয়া নিয়ে আমাদের অহংকারের, গর্বের সীমারেখা নেই। এখানে শান্তিপুরের গোস্বামী বাড়ির রাস, রাই-রাজা, বাবলার অদ্বৈত পাঠ, ফুলিয়ার তাঁত, কবি কৃত্তিবাস ওঝার ভিটে, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া, মাটির পুতুল, রাজবাড়ি, বারোদোল, গোপাল ভাঁড়,জলঙ্গী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার, কালীনারায়ণ পুর-পায়রাডাঙার চূর্ণী নদী, রানাঘাটের জয় গোঁসাই, চাকদহের হাট, বিধানচন্দ্র রায়ের স্বপ্নের শহর কল্যাণী। আর নবদ্বীপ-মায়াপুর নিয়ে আলাদা করে কী-বা বলবো, কলমের কালি ফুরাবে কিন্তু ইতিহাসে্য কথা ফুরাবে না। চাকদাহের হাট থেকে বল্লাল সেনের ঢিপি, বেথুয়াডহরি ফরেস্ট, গোরভাঙার বাউল-ফকির উৎসব, মাজদিয়ার শিবনিবাস--- এই সব, সব কিছুই তো আপামর নদিয়াবাসীর। সবই আমাদের, একে ভাগ করা যায়? চাইলেই কি বদলানো যায় ইতিহাস?

আমরা যারা পড়াশোনা কিংবা রুজিরুটির টানে পা রেখেছি তিল্লোতমা কলকাতাতে, খুঁজেছি কলকাতার কবিতা তারাও কিন্তু সপ্তাহ শেষে শেষ ট্রেনে হলেও ফিরতে চেয়েছি এই নদিয়াতে। শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর কিংবা শান্তিপুর লোকাল কাঁচড়াপাড়া পেরিয়ে কল্যাণী ঢুকলেই বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে, মনে হয় এই তো এসেই পড়েছি। নিজের জেলা শুরু আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা তারপরেই কেউ নেমে যাবে পালপাড়ায়, চাকদহ, রানাঘাট। কারও পথ কালীনারায়ণ পুর থেকে বেঁকে যাবে বীরনগর-তাহেরপুরের দিকে আবার কারও গন্তব্য হবে হবিবপুর, বাতনা কিংবা ফুলিয়া! কিন্তু সবাই ফিরব নিজের শিকড়ের কাছে, নদিয়াতেই। কৃষ্ণনগরে পা রাখলেই মনে পড়ে কাছেই সীমানগর বর্ডার, ওপারে যারা আছে তারাও বাংলাতেই কথা বলে। আমার মতো, আমাদের মতোই অনেকেরই পূর্বপুরুষের ভিটে। একবার ভেঙেছে দেশ, তার জ্বালা মেটানোর মতো বার্নল এখনও এসে পৌঁছায়নি! আবার ভাঙছে, আরও একবার পুড়ছে তবে হৃদয়?

More Articles