দেবী চৌধুরাণী থেকে ফুলনদেবী || ‘অপরাধ’ জগতে চাবি ওদের হাতের মুঠোয়

ভারতবর্ষ থেকে বাংলা অপরাধ জগত যখনই উঠে আসে সিনেমায় বা সাহিত্যে, মোটামুটি প্রধান চরিত্র হিসেবে আমরা যাদেরকে দেখি, তারা সবাই মূলত পুরুষ। অন্যান্য জগতের মতো এ জগতেও পুরুষের রমরমা বাজার। লড়াকু, খুনি বা ভিলেন চরিত্রে মহিলাদের দেখতে এখনও অভ্যস্ত নয় ভারতের সমাজ। মিতিন মাসির মতো ‘ভদ্র’ গণ্ডির গোয়েন্দা চরিত্র উদযাপন করাই যায়, কারণ সে পিতৃতন্ত্রের কাছে বিপজ্জনক নয়। বরং ‘অপরাধ’ জগতের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের সহায়ক। কিন্তু নারীচরিত্র যদি এই বাঁধা ধরা মূল্যবোধের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদ হয়ে ওঠে? একদল পুরুষের সঙ্গে ওঠে, বসে, যৌন সংসর্গ করে নিজের ইচ্ছামত?। অথচ ভারতের অপরাধের ইতিহাসে এমন কিছু নাম জড়িত রয়েছে যা সিনেমা, সাহিত্য মায় বিশ্বের পিতৃতন্ত্রকে পাল্লা দিতে পারে।

দেবী চৌধুরাণী নামটির সঙ্গে প্রায় প্রত্যেক বাঙালিই পরিচিত। ঔপনিবেশিক শাসনের পর্যায় থেকে ঠগি, ডাকাত ইত্যাদির নথি বেশ সহজলভ্য। নিজের হক বুঝে নেওয়া শাসকের চোখে তখন বেশ গুরুতর ‘অপরাধ’। অবশ্য তখনও জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি। ফলত ‘স্বদেশী ডাকাত’ এরা নন। আঞ্চলিক সমস্যার প্রতিরোধে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে কৃষক বিদ্রোহ হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও ডাকাতি হতেও দেখা যাচ্ছে। ইংরেজরা প্রায়শই তাই ডাকাতি আর বিদ্রোহ গুলিয়ে ফেলত। কিন্তু ডাকাতি আর বিদ্রোহে বেশ কিছু পরিষ্কার পার্থক্য রয়েছে। ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ তাই নিয়ে প্রচুর বিতর্ক। বিশেষত ‘আনন্দমঠে’ যেভাবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে তা অত্যন্ত সমস্যাজনক। গত শতকের সাতের দশকের পূর্বের ইতিহাসও জাতীয়তাবাদী প্রভাব এড়াতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহ নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন। তোলেন তৎকালীন ‘ডাকাত’ বর্গটি নিয়েও। কিন্তু দেবী চৌধুরাণী এমন একটি ক্ষেত্র বহুযুগ ধরে পাঠ্য বইয়ের বাইরে, ‘ভদ্র’ সমাজের বাইরেও যার ইতিহাস মানুষের মুখে মুখে রয়ে গিয়েছে আজও। পশ্চিমবঙ্গের তিন প্রান্তে দেবী চৌধুরাণীর খোঁজ মেলে। তার মধ্যে ইতিহাসের সবথেকে কাছাকাছি হল জলপাইগুড়ি। গোশালায় দেবী চৌধুরাণী কালী মন্দির, শিকারপুর চা-বাগানে ভবানী পাঠকের মন্দির, বেলাকোবা-রাধামালি রোডে মন্থনী মন্দির–প্রত্যেকটির সঙ্গেই দেবী চৌধুরাণীর নাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এই মন্থনী বাংলাদেশের মন্থনা থেকে এসেছে বলে মনে করেন অনেকে। মন্থনা তথা পীরগাছার জমিদার শিবচন্দ্রের পত্নী ছিলেন জয়দুর্গা। লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের রিপোর্ট, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্টস অফ বেঙ্গল-রংপুরে শিবচন্দ্র, জয়দুর্গা এবং ভবানী পাঠকের নাম পাওয়া যায়। শিবচন্দ্র মারা যাওয়ার পর জয়দুর্গা তার জমিদারির কৃষকদের নিয়ে নতুন অর্থনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। উপন্যাসের দেবী সিং কিন্তু বাস্তবেও ছিল। ইংরেজদের প্রতিভূ দেবী সিং-এর বিরুদ্ধেই ছিল এই বিদ্রোহ। রংপুরের তিস্তা অববাহিকা এবং জলপাইগুড়ির করলা অববাহিকা জুড়ে ছিল দেবী জয়দুর্গা চৌধুরাণীর কর্মকাণ্ড। নারী ডাকাতের এই দেবীতে রূপান্তরিত হওয়া লক্ষ্যনীয়।

এছাড়াও ডাকাতির এই ক্ষেত্রটিতে ‘ব্যান্ডিট কুইন’ ফুলন দেবী, সীমা পরিহার, পুতলিবাঈ, সরলা জাটভের মতো মহিলারা রয়েছেন। ফুলন দেবীর গল্প মোটামুটি সকলেরই জানা। কীভাবে অত্যাচারের গর্ভে জন্মে রাজনীতির মঞ্চ অবধি যাত্রা তাঁর। সীমা পরিহারের যাত্রাপথও অনেকটা এক। ১৩ বছর বয়সে লালা রাম ও কুসুমা নিয়ান কর্তৃক অপহৃত। ধীরে ধীরে ডাকাতির পথ বেছে নেওয়া ছাড়া তার আর উপায় থাকে না। রাজনীতির মঞ্চে উঠে এসেছেন তিনিও। তিনিই প্রথম ভারতীয় নারী যিনি নিজের বায়োপিকে নিজে অভিনয় করেছিলেন। ‘উন্ডেড–দ্য ব্যান্ডিড ক্যুইন’ নামের সে ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল।

বেবি পাটনকর ছিল এক সময় মুম্বইয়ের অত্যন্ত কুখ্যাত নামগুলির মধ্যে একটি। আশির দশকে এই দুগ্ধ-ব্যবসায়ী মহিলা গাঁজা এবং ব্রাউন সুগার বেচতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়ে। গাঁজা, ব্রাউন সুগারের পর মেফিড্রোনের ব্যবসা। মহারাস্ট্রের সবথেকে বড় এম ডি বিক্রেতা হয়ে ওঠেন বেবি। প্রচুর সম্পত্তি, টাকাপয়সা। সেন্ট্রাল মুম্বই, লোনাভালা এবং পুনের রিয়েল এস্টেটেও সেই টাকা লগ্নি করেছিলেন তিনি। ২০১৫ নাগাদ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন পাটনকর। তদন্তকারীরা তাঁর ২২টি অ্যাকাউন্ট থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধার করেছেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। পুনের কাছে মালাভিতে একতি বাংলোও ছিল তাঁর। অপরাধের ইতিহাসে এই মহিলা ড্রাগ-ডিলার নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছেন।

মুম্বইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের কথা উঠলেই আরো কয়েকজন নারীর কথা এসে পড়ে অবশ্যম্ভাবী ভাবে। রেশমা মেমন ও শাবানা মেমন তাদের মধ্যে অন্যতম। কুখ্যাত ব্ল্যাক ফ্রাইডে-র সঙ্গে জড়িত এই দুজন নারী যথাক্রমে টাইগার মেমনের স্ত্রী ও শ্যালিকা। ইন্টারপোল এদের ধরার জন্যে উদগ্রীব। কিন্তু এখনও নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছেন তারা। শোভা আইয়ার এমন আরেকজন গ্যাংস্টার যার বিরুদ্ধে রেড কর্নার নোটিশ জারি করা হয়েছে। বছরের পর বছর তাকে ধরার চেষ্টা চলছে, কিন্তু এখনও রাষ্ট্রের আয়ত্তের বাইরে শোভা। অর্চনা বালমুকুন্দ শর্মা বাবলু শ্রীবাস্তবের দলে ভিড়ে দীর্ঘদিন অপহরণের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অর্চনা এখনও হাওয়ায়। তবে সন্দেহ করা হয় বিদেশে এই দলেরই কোনও অংশ দেখাশোনার ভার রয়েছে তার উপর। এছাড়া রয়েছেন সামাইরা জুমানি, অঞ্জলি মকন, বেলা আন্টি, জেনা বাঈয়ের মতন চরিত্রেরা। অপরাধের জগতে এই যাবতীয় নামগুলি অত্যন্ত পরিচিত। শুধু তাই না বহু দুর্ধর্ষ গ্যাংস্টার, মাফিয়া এদের যথেষ্ট মান্য করে। ভয় পায়। এমন এক অবস্থানে এরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। হতে পারে সমাজ এদের জায়গা দেয়নি, পিতৃতন্ত্র এদের ওপর অত্যাচার করেছে, এদের ঠকিয়েছে, কিন্তু দিনের শেষে প্রতিরোধের স্বরটি নিজের মতো করে হলেও খুঁজে নিয়েছেন এইসব নারীরা। নিজের ক্ষেত্রটিতে নিজেকে ক্ষমতায়িত করেছেন। শত চেষ্টা করেও তাদের কিন্তু দমিয়ে রাখা যায়নি।

 

More Articles