মানুষ তবুও ঋণী মানুষেরই কাছে!

সে প্রায় কুড়ি বছর আগেকার কথা। ভয়, ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ– এই সবকিছু একজোট হয়ে সদ্য সদ্য ঘটে গেছে নাইন ইলেভেন। ধ্বংসস্তূপ সরানোর সঙ্গে সঙ্গেই বুকের ভেতর চলে আসছে কান্না, সে কান্না দ্রুত বদলে যাচ্ছে চোয়াল শক্ত হওয়া প্রতিশোধস্পৃহায়। মানুষ কঠিনতম আঘাত করেছে মানুষকে, তাই ফিরিয়ে দিতে হবে সেই আঘাত। সারা পৃথিবী থেকে একের পর এক সলিডারিটি-র বার্তাও আসছে, 'পাশে আছি আমেরিকা'। 

আফ্রিকার কিমেলি নাইয়োমা- ও ফিরে এসেছেন দেশে। নিউইয়র্কে ডাক্তারি পড়ছিলেন নাইয়োমা, নাইন-ইলেভেন ঘটার সময় সে শহরেই ছিলেন তিনি। আফ্রিকান তো বটেই, নাইয়োমা-র এক বিশেষ পরিচয়ও আছে এর পাশাপাশি– তিনি একজন মাসাই। কেনিয়ার সুবিস্তৃত অরণ্যের মাঝে তাঁর গ্রাম, সভ্য নাগরিক জীবন থেকে অনেক দূরে। বংশানুক্রমিক ভাবেই মাসাইরা অসাধারণ যোদ্ধা, কিন্তু তাঁরা শান্তিপ্রিয়– অচেনা অজানা মানুষকে যথাযোগ্য অতিথির সম্মান দেওয়াই তাঁদের রীতি। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁরা না হতে পারেন, কিন্তু জীবনের পাঠশালায় তাঁরা জাতিগত ভাবেই প্রাজ্ঞতায় উত্তীর্ণ। 

নাইন ইলেভেনের কথা তেমনভাবে জানতেন না মাসাইরা। নাইয়োমা নিউইয়র্ক থেকে ফিরে আসার পর, তাঁর মুখ থেকে সারা গ্রাম জানতে পারলো– কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে পৃথিবীর এক দূরতম প্রান্তে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই মাসাইদের দর্শন– তার অন্যথা হলো না এবারেও। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হল, এই ভয়াবহ দিনে পাশে থাকতে হবে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার, যে দেশ এতদিন আশ্রয় দিয়েছে তাদের ঘরের ছেলে নাইয়োমাকে। 

কিন্তু, পাশে আছি বার্তার পাশাপাশি কী উপহার পাঠানো যায়? মাসাইরা অরণ্যের সন্তান, পাশ্চাত্য সভ্যতার ছোঁয়া তাদের দৈনন্দিন জীবনে লাগেনি এখনও– তাঁদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, সেটাই তাঁরা বেছে নিলেন উপহার হিসেবে, গরু। গরু মাসাইদের কাছে স্রেফ একটা প্রাণী নয়, গরু তাঁদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। প্রতিটি গরুর আলাদা আলাদা নামকরণ করেন মাসাইরা, কথা বলেন তাঁদের সাথে। আরণ্যক জীবনে গরুর থেকে আর কোনোকিছুই তাঁদের কাছে বেশি দামী নয়। তাই ঠিক হলো, চোদ্দটি গরু তাঁরা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে পাঠাবেন। 

কেনিয়া-তানজানিয়া সীমান্তের কাছে এনুসাইন গ্রামে, তৎকালীন আমেরিকান অ্যাম্বাসাডর উইলিয়াম ব্র্যানকিক-এর হাতে গরুগুলোকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দিলেন মাসাইরা। দিনটা ছিলো দু'হাজার দুই সালের পয়লা জুন। এর সঙ্গে দেওয়া হলো মাসাইদের নিজস্ব জুয়েলারি ও পবিত্র লাল কাপড়। এই অসাধারণ উপহারকে 'সহানুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ' বলে বর্ণনা করলেন ব্র্যানকিক। 

যদিও, গরুগুলোকে নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে খানিক ফাঁপরে পড়েছিল আমেরিকা। নানা রকম মতামত উঠে এলো আলোচনায়– কেউ বললো ওগুলোকে বেচে দেওয়া হোক, কেউ বললো জাহাজে করে আমেরিকায় নিয়ে এসে সেন্ট্রাল পার্ক চিড়িয়াখানায় রাখা যাক বরং! এই দোলাচলেই কেটে গেল আরো তিনবছর। শেষমেষ, দু'হাজার পাঁচ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত আবার এলেন এনুসাইন-এ। ঘোষণা করলেন, গরুগুলো এখানেই থাকবে, এই গোসম্পদ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে এনুসাইনের শিশুদের লেখাপড়া করার খরচ চালানো হবে। এই ফান্ড যাতে চলতে থাকে, তাই চোদ্দটা হাইস্কুল স্কলারশিপ-ও ঘোষণা করা হলো। মাসাইরা খুশি হলেন, আর আমেরিকাও জানালো, এই অসাধারণ উপহারগুলোকে ব্যবহার করার এর থেকে ভালো উপায় আর হতে পারতো না। 

কবি লিখেছিলেন, "পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন/ মানুষ তবু্ও ঋণী পৃথিবীরই কাছে''। এটুকুই থেকে যায়, এটুকুই প্রয়োজন হয় আশা হারিয়ে ফেলা মানুষের– একটু ধ'রে থাকা হাত, একটু ছোঁয়া– আছি, একসঙ্গে আছি। 

এরকমই নিজের গোটা জীবন অক্লান্তভাবে মানুষের পাশে থেকে গেছিলেন এক ভারতীয় গৃহবধু– সুলাগিট্টি নরসাম্মা। কর্ণাটকের টুমকুর জেলার এই মহিলা, কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই, সারা জীবনে কুড়ি হাজারেরও বেশি গর্ভবতী নারীদের সন্তান-প্রসবে সাহায্য করেছেন, পুরোটাই নিখরচায়, নতুন প্রাণকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য কখনো কোনও টাকা নেননি নরসাম্মা। কোনও মেডিক্যাল ফেসিলিটি ছাড়াই, সাবেকি কায়দায় নরসাম্মা প্রসব করাতেন, তাঁর মতো ধাই-মা স্মরণাতীত কালে পৃথিবী পায়নি। নিজে কখনো ইস্কুল যেতে পারেননি জীবনে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের নূন্যতম শিক্ষাটুকুও পাননি কখনও– কিন্তু এতে তাঁর মানুষের পাশে থাকা আটকায়নি। 

কোথা থেকে নরসাম্মা শিখলেন প্রসব করানোর সাবেকি 'টেকনিক', কিভাবে শুরু হলো তাঁর এই আশ্চর্য যাত্রা? একমাত্র তেলেগু ভাষায় কথা বলতে পারা নরসাম্মা এক ইন্টারভিউতে জানিয়েছিলেন, প্রসব করানোর সনাতনী পদ্ধতি তাঁর দিদিমার কাছে শিখেছিলেন তিনি, কিভাবে প্রসব করানোর সময় সুরক্ষিত রাখতে হয় মা ও সন্তান দুজনেরই জীবন। মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় নরসাম্মার, তাঁর নিজের-ও বারোটি সন্তান-সন্ততি। নিজের কুড়ি বছর বয়সে, উনিশশো চল্লিশ সালে প্রথম ডেলিভারি করান নরসাম্মা, নিজের কাকিমাকে সন্তান প্রসবে সাহায্য করে। সেই শুরু। তারপর থেকে নিজের গ্রাম ও জনগোষ্ঠী ছাড়াও বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে নরসাম্মার নাম, একের পর এক প্রসবে ডাক পড়তে থাকে তাঁর। লেখাপড়া না শিখেও, গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক ওষুধ তৈরি করা শিখে নেন নরসাম্মা। মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কেও বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন তিনি। লোকে বলতো, কোনো ডাক্তারি সরঞ্জাম ছাড়াই নরসাম্মা নাকি গর্ভে থাকা শিশুর নাড়ি-পরীক্ষাও করতে পারতেন। 

সম্পূর্ণ বিনি পয়সায় মানুষকে এই অমূল্য সেবা করতে করতেই, কর্ণাটকের গন্ডি পেরিয়ে নরসাম্মার নাম ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর জগতে। দু'হাজার তেরো সালে, তিয়াত্তর বছর বয়সে এসে, ভারত সরকারের তরফে দেওয়া ন্যাশনাল সিটিজেন অ্যাওয়ার্ড পান নরসাম্মা। ততদিনে তাঁর হাতে পৃথিবীর আলো দেখেছে প্রায় পনেরো হাজার শিশু। এর পরের বছর, কোনোদিন স্কুলের মুখ না দেখা নরসাম্মার হাতে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি তুলে দেয় টুমকুর বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৮ সালে ইহজগত ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে, ভারত সরকারের থেকে পদ্মশ্রী-ও লাভ করেন নরসাম্মা। 

এই সবকিছুই যেন গল্পের মতো শোনায়। এত যুদ্ধ, এত হিংসা চারিদিকে, এত রক্ত আর এত অন্ধকার, ভালো যা কিছু তা সব-ই যেন আমাদের কাল্পনিক লাগে। তবু তো সত্যি থাকে কিছু, এক গোলার্ধে বসে একদল মানুষ উপহার পাঠায় অন্য গোলার্ধের এক বিধ্বস্ত দেশের জন্য, নিজের জীবনে ক'ফোঁটা আলো এসে পড়লো তার তোয়াক্কা না করেই হাজার হাজার শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে যান কোনো এক সুলাগিট্টি নরসাম্মা। 

কবি বলে ওঠেন, 'বেঁচে থাকা নেহাত মন্দ না'..

 

 

More Articles