আমাদের 'বিট', আমাদের 'কয়েন'

বিট ও কয়েন, বিটকয়েন। দ্বন্দ্ব সমাস। 

তা, দ্বন্দ্ব তো বটেই, একদম বানান থেকেই, দু-দুবার দ এর নীচে ব বসাতে ভুল তো হবেই, আর বিজয় মাস্টারমশাই বাজখাঁই গলায় পাড়া কাঁপিয়ে বলে উঠবেন 'গবেট', আর তার পরেই বিট, লালরঙা ইংলিশ টু বেঙ্গলি অভিধান ফুঁড়ে নন্টে-ফন্টে-কেল্টুদার সুপারিনটেনডেন্টসম বি-ই-এ-টি হয়েই দুড়ুদ্দুম পিঠের ওপর অ্যায়সা ঝাঁপতাল, কোথায় লাগে শিভামণি! বিজয় মাস্টারমশাইয়ের প্যাঁদানির হাত আলোর চেয়েও দ্রুতগামী–বালি চক্রবর্তীপাড়ার প্রাচীন প্রবাদ; নইলে বিশুদার মতো মাঠ কাঁপানো সেন্টার ফরোয়ার্ড, যে একজন-দুজন-তিনজনকে অবলীলায় কাটিয়ে গোলকি-কেও স্টেপ ওভারে উল্টোদিকে ফেলে পার বিকেল ডজনখানেক গোল দেয়, সেও কিনা দুপুরবেলা বাড়ি থেকে নিখোঁজ! খোঁজ খোঁজ, গেলো কই, শেষে বালি সুইমিং সেন্টারের মাঠে। তিনকাঠি চেনার মতোই খুব চেনা ভবিষ্যত, তিনটে স্কেল পিঠে ভাঙবে স্কেলার-ভেক্টার রাশি গুলিয়ে ফৌত হওয়া ভৌতবিজ্ঞান হোম-ওয়ার্কে‌র আফটারম্যাথে। অগত্যা ঘাসে উদাস একাকী শুয়ে বালির বেবেতো। নিকুচি করেছে এই সংসারের, সবটাই অফসাইড!

এই চেনাতম ভার্ব, বিট, অন্যসাজে নাউন হয়েও ছিলো, আমাদের দিনগুলোর গায়ে তখন মাধব বস্ত্রালয়ের জামা। সে বিট আদতে স্রেফ নুন, তবু সেই ব্ল্যাকসল্ট পেয়ারায়-কাঁচা আমে-কুলে-কালোজামে মিশলেই তার জৌলুস যেন কোহিনুর, আর প্রেজেন্সটাই এমন অমোঘ আর খানিক নিষিদ্ধ, সাধে কি বলতাম কালো জগতের আলো! এহেন ম্যাজিকাল বিটনুনেরও এক দাদা ছিলো, ইমপ্যাক্টে এককাঠি বাড়া, কাচের বয়ামে রাখা সেই সমুদ্রের মতো প্রবল ডিজায়ার বিক্রি হতো টিফিনে গেটের ওপারে, তার নাম কারেন্ট নুন। চোখ কুঁচকে মুখ ভেঙচে জিভের ডগায় একটা ছোঁয়াচ, সে অনুভূতিকে ভোল্টে অ্যাম্পিয়ারে মাপতে যাওয়ার মতো বুরবক ছিলাম না কখ্খনো, শুধু একদিন কে যেন বললো অ্যাসিড থাকে ওতে, নাড়িভুঁড়ি গলে যাবে সব। ব্যাস, অমনি পেটজোড়া ভয়ের ব্যথা নিয়ে রামনবমীর মাঠ পেরিয়ে ঝুনু ডাক্তারের হোমিওপ্যাথি ডিসপেনসারিতে, সেখানে শিশি থেকে দু-তিন বুন্দ অমৃত আর হাই পাওয়ারের চশমার ওপার থেকে কমফর্টিং নিদান, 'কিস্যু হয়নি যাও ফুটবল খ্যালোগে যাও..'

আর সেই খেলা বড় সাবধানে, বাঁচিয়ে, লক্ষ্মীর ভাঁড়ে না লাগে যেন বল। ওখানেই সাজানো নিজস্ব ঝুলন, ব্যক্তিগত এল-ডোরাডো, ফি হপ্তায় একটা একটা করে নানা সাইজের কয়েন, আমাদের সবটুকু অলীক মুঠোয় ভরার পাসপোর্ট সেইসব কয়েন যেন আলোর চাকতি, দশ কুড়ি পঁচিশ পঞ্চাশ লেখা– অনেক রেখেছি, আরেকটু আলো জমলেই পুরো প্যাকেট পার্লে পপিন্স আর ক্যাম্বিস ব্যাটের গ্রিপ আর দুদিকে দুরকম রঙওলা ক্যারম-স্ট্রাইকার। 'একটু নস্যি এনে দিবি বাবন' বলামাত্র পিসিমার সাদা থানের কোঁচা থেকে বের হয়ে, কদাচিৎ কোনো মঙ্গলবার ফ্যাক্টরির অফ-ডে'র বিকেলে রফি'র গান শুনে বাবার মুড ভালো থাকলে, সরস্বতী পুজোর চাঁদা তুলতে গিয়ে আমাদের 'কিং অফ দ্য জাঙ্গল' ননা'দার ইন্ধনে, আনন্দ-লোভ-চুরি-ভয়-লজ্জা সবকিছুর অমোঘ রিয়্যাকশনের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে জমা হওয়া মাল্টিপল চাঁদের সেই ঝনঝনানি বলে দিতো, কয়েন তো ছিলোই, এক টাকা না হোক একেবারে, তবু সে অকুলান ষোলোআনা ভরা।

সে আওয়াজ শুনতে শুনতেই জাম্পকাটে দু'হাজার একুশ, নতুন করে তৈরি হওয়া সমাসবদ্ধ পদটির খোঁজ করতেই গুগল ছুঁড়ে দেয় ইনফোঢেউ। মাইনিং, ব্লকচেইন আর ক্রিপটোকারেন্সি নেটওয়ার্কের মতো ভারি ভারি একগাদা শব্দ একজোট হয়ে, বুঝিয়ে ব'লে দেয় এই গল্প এক অমোঘ টেকনোলজিক্যাল ব্রিলিয়ান্সের, এই বিট আমাদের চেনা বিট নয়, এই কয়েন আমাদের চেনা খুচরো পয়সা নয়। সেই যে সাতোশি নাকামোতো মাইনিং এর প্রাইজ হিসেবে শুরু করলেন এই আশ্চর্য ডিজিটাল কারেন্সি, তারপর কতই না হাঙ্গামা হলো বেআইনি ফান্ড ট্রান্সফার নিয়ে, মাইনিং-এর জন্য যে ব্যাপক পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ হয়, সেকথা তুলে এনেও সমালোচনার ঝড় উঠলো দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু থামানো গেল না সেই উড়ান, বরং এই দু'হাজার একুশের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে বিটকয়েনকে মান্যতা দিয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলেছে একটা ছোট্ট মধ্য-আমেরিকান দেশ– এল সালভাদোর। হাজার প্রতিবন্ধকতা আর রাষ্টশক্তির চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করেই বিটকয়েন ক্রমশ জাঁকিয়ে বসেছে পৃথিবীর অর্থনীতির গতানুগতিকতায় এক আশ্চর্য রেনেসাঁ হয়ে, ডিজিটাল অ্যাসেট হিসেবে তুঙ্গে উঠেছে চাহিদা, ইন্টারনেটে খুঁজলে সহজেই জেনে ফেলা যায় সেই নিযুত ডলারের নিখুঁত লেজারের সবটুকু গল্প, যে গল্প সাফ ব'লে দেয় বিটকয়েনের অধীনতা নেই কোনো ব্যাঙ্ক, কোনো রাষ্ট্রশক্তির পায়ের তলায়।

আর সে উড়ান জানতে জানতেই আশ্চর্য অতন্দ্রে ভাবি, সেই স্বাধীনতাটুকুই তো চাওয়া আর পাওয়া ছিল আমাদেরও। কারোর অধীনে নয় আমাদের সেই মায়াবী ক্রান্তিকাল, প্রথমে পাত্তা না পাওয়া ছোট্ট,  আর তারপর একের পর এক হেমন্ত এলো আর চলে গেলো পরপর, আমরা বড়ো হলাম কেমন যেন ম্যাজিকের মতো, গুরুত্ব বেড়ে গেল জীবনের। 

কত দিন কাটলো, তবু স্মৃতির দিকে তাকালেই, ভালোবাসার কঠোর শাসনে পাওয়া সেই অপার শাসনহীনতার হাওয়া বয় ফের, রাবুণে দুরমুশের মত স্মৃতি এসে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ভেঙে দেয় সর্বস্ব; বিজয় মাস্টারমশাইয়ের মার থেকে পালিয়ে বিটনুনে বাতাবিলেবু মেখে চাখতে চাখতেই পকেট হাতড়ে শেষতম কয়েনটা টসের জন্য ওপরে ছুঁড়ে দিই, বিশুদা জিগ্যেস করে 'সাইড নিবি না সেন্টার', মওকা পেয়ে সাইড চেয়ে নিই তৎক্ষণাৎ, জুলপিতে দু-একটা সাদা পোঁচ লাগা আনফিট পৌরুষ নিয়ে নিরাপদে দাঁড়াই, দেখি গোলার মতো শট এসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে লক্ষ্মীর ভাঁড়, আর আকাশে আতসবাজির মতো ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ আলোর কয়েন, অনায়াস মিশে যাচ্ছে শেষ মিলেনিয়ামের শেষ কয়েকটা বছরের গায়ে।

সে আলো টাকার চেয়ে দামি। সোনার চেয়ে দামি। আমার মতো আরো অনেক আমি। সবাই মিলে আমরা। দ্বন্দ্ব সমাস। 

More Articles