ওজোন পর্দার ক্ষতে শুশ্রুষার পলি, সেরে ওঠো বসুন্ধরা...

কিছুদিন আগে এত খারাপ খবরের মধ্যেও এক দুর্ধর্ষ খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। ২০৬০ সালের মধ্যে আন্টার্টিকায় হওয়া ওজোন স্তরের ফাটল সম্পূর্ণ ভাবে মেরামত হতে চলেছে। যে ফাটল সামগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎকে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, আমাদের ঠেলে দিয়েছিল এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে, তা জুড়বে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে। এই ছিদ্র হওয়া এবং তার মেরামত হওয়ার যে কাহিনি, তার একটা ইতিহাস আছে। সেদিকে আজ চোখ রাখাটা জরুরি, কারণ ওজোনের সমস্যা যদি মিটেও যায়, বিশ্ব উষ্ণায়ণের মতো রাক্ষসের সামনে এখনও অনেকটাই অস্ত্রহীন দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা।

মতো  সালটা ১৮৩৯, সি এফ শনবেইন নামের এক কেমিস্ট হঠাৎ এক অদ্ভূত গন্ধ পেলেন বাজ পড়ার পর। তার পর বিষয়টা তদন্ত করার পর তিনি খোঁজ পেলেন এক রাসায়নিকের এবং তার নাম দিলেন ওজোন। এই নামের জন্ম হল গ্রিক শব্দ ওজেইন থেকে, যার অর্থ "To Smell"। তারপরে আবিষ্কার হল ওজোন এমন এক মৌল যার তৈরি হয় তিনটি অক্সিজেন অ্যাটম দিয়ে। এই মৌলকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরেই শুধু পাওয়া যায়।  সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ওজোন শুধু মাত্র রসায়নবিদদের গবেষণার বিষয় হয়েই রয়ে গেলো।

এবার আমরা একটু এগিয়ে আসি। ১৯৩০ সাল। দু'জন পদার্থবিদ (জি এম বি ডবসন ও এস চ্যাপম্যান) ঠিক করলেন যে সূর্য থেকে আগত আলোকরশ্মিকে তাঁরা পরীক্ষা করবেন। বসানো হল যন্ত্র এবং একটি গ্রাফ যা কোন ধরনের আলোকরশ্মি কতটা পরিমাণে আমাদের কাছে এসে পৌঁছচ্ছে তার হিসাব রাখবে। আসলে সূর্য থেকে যত ধরণের আলোকরশ্মি নির্গত হয় তার খুব কমই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। যে আলোগুলি আমাদের চোখেই পড়ে না তাদের বোঝাই ছিল এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য।

তাঁরা যখন পরীক্ষা শুরু করলেন এবং দেখলেন আলোর দিকে, তখন তাঁরা খুব অদ্ভূত একটি বিষয় লক্ষ্য করলেন। ওই আলোকরশ্মি গুলির মধ্যে UV-B একেবারেই উপস্থিত ছিল না। সেটা কী ভাবে সম্ভব? কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা দুটি বিষয়কে নিয়ে তুল্যমূল্য বিচার শুরু করলেন। একটি কারণ তাঁরা মনে করলেন যে, আমাদের সূর্য কোনো প্রকার UV-B আলোকরশ্মি নির্গত করে না বা আমাদের বায়ুমণ্ডলে এমন কিছু আছে যারা UV-B কে বাধা দিচ্ছে। ততদিনে বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন যে, এই পৃথিবীতে একটিই রাসায়নিক আছে যা এই কাজ করতে পারে। তা হল ওজোন। সারা পৃথিবী জানল আমাদের বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তরের অস্তিত্বের কথা।

 কিন্তু এই নিয়ে এত মাতামাতি করা কেন? প্রশ্ন ওঠে। তখন বিজ্ঞানীরা জানান যে, এই UV-B আমাদের ত্বকের জন্যে অসম্ভব প্রকারের ক্ষতিকর। এই আলোকরশ্মির সংস্পর্শে আসা মানেই ত্বকের ক্যান্সার হওয়া এবং সেই থেকে মৃত্যু। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন এই ওজোন নামক রাসায়নিক আমাদের পৃথিবীতে প্রাণস্পন্দনকে বাঁচিয়ে রাখতে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই অনুযায়ী তাঁরা আরও গবেষণার কাজ শুরু করলেন।

১৯২৮ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত চলল  পর্যবেক্ষণ। পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দনকে বাঁচিয়ে রাখতে ওজোন স্তর কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা প্রমাণিত হল। কিন্তু এই পুরো কর্মকান্ডই ছিল বিজ্ঞানীদের জ্ঞান পিপাসা মেটানোর জন্যে। কৌতূহল হল সবথেকে বড় চালিকাশক্তি যা আমাদের মানবজাতিকে গুহাতে আগুন জ্বালানো থেকে মঙ্গল গ্রহে রোভার চালানো পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। যাই হোক, তখনও পর্যন্ত বিষয়টা শুধু মাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকার একটি প্রবন্ধতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই চিত্রটা পাল্টে যায়।

সময়,১৯৭৬ এতদিনে গোটা পৃথিবী জেনে গিয়েছিল ওজোন স্তরের গুরুত্ব, এবং এই পর্দাটা না থাকলে পৃথিবী যে মঙ্গল গ্রহের পরিণতি পাবে সেটা মোটামুটি বিজ্ঞান চর্চা করা সব মানুষ বুঝতে শুরু করেছিল। ওজোনের সঙ্গেই বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছিলেন এক নতুন ধরণের রাসায়নিক নিয়ে। সিএফসি বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বন। এটি এমন একটি রাসায়নিক যার বহুল ব্যবহার আছে, এবং এর সবচেয়ে বড় গুণ হল এটি মানুষের কোনো ক্ষতি করেনা। এছাড়াও এটি বানানো ছিল সহজ, খরচ ছিল কম। চুলের স্প্রে থেকে শুরু করে রেফ্রিজরেটর, হাজার হাজার জিনিষে শুরু হল এর ব্যবহার।

কিছুদিনের মধ্যেই সিঁদুরে মেঘ দেখলেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণাগারে তাঁরা দেখলেন যে এই সিএফসি ধ্বংস করছে ওজোনকে। কিন্তু তখনও তাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য ছিল না যাতে প্রমাণ হয় যে এই রাসায়নিক আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। শুরু হল গবেষণা, বিশ্বের অনেক দেশই এই কাজে এগিয়ে এল। কিছু দেশ তো কোনও তথ্য প্রমাণ হাতে আসার আগেই সিএফসি-কে নিষিদ্ধ করে দিলো।

কিন্তু বিষয়টা এত সহজ ছিল না। সিএফসির ব্যবহার অনেক ধরণের পণ্যের উৎপাদনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্যবসায়ীরা সব রকম প্রকারে এই তথ্যকে চেপে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন। তার মধ্যে ছিল সরকারকে টাকা দেওয়া, ভুয়ো গবেষণাপত্র লেখানো, এবং সবথেকে ভয়ঙ্কর ছিল এই বিপদকে সম্পূর্ণ ভাবে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫, সিএফসির উৎপাদন ও ব্যবহার বিনা বাধায় চলতে থাকে। ১৯৮৫ সালে কুড়িটি দেশ এক জায়গায় হয় এবং শুরু হয় ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির কাজ। একই সময়ে ব্রিটিশ আর্কটিক সার্ভে জন স্যাঙ্কলিন নামে এক বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করে। তার কাজ ছিল আন্টার্টিকার গত ৩০ বছরের নথি বিশ্লেষণ করে সেখানকার ওজোন স্তরের বিষয়ে জানা। সমস্ত তথ্য চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেন ১৯৮১ সালের পর থেকে ওই স্থানে ওজোন স্তর দশ থেকে কুড়ি শতাংশ করে কমতে থেকেছে।

১৯৮৫ সালে নেচার  পত্রিকা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে, যা গোটা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দিয়েছিল। জানা যায় যে, আন্টার্টিকার ওজোন স্তরে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে। নাসাও সেই বছরের আগষ্ট মাসে জানায় যে, তার উপগ্রহ চিত্রেও একই ছবি ধরা পড়েছে। সেই উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়ে ভয়াবহ সব চিত্র। ওজোন স্তরের পঞ্চাশ শতাংশের ও বেশি সেই চিত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বলা যেতে পারে, মানবজাতির জন্যে তা ছিল রেড অ্য়ালার্ট। বিজ্ঞানীরা আর এক মুহূর্তও দেরি করেননি। তাদের বিশ্বাস ছিল, যদি তাঁরা মানুষকে বোঝাতে পারেন যে সবার অস্তিত্ব সঙ্কটে তাহলে তারা ঠিক বুঝবেন।
কোনও রাখঢাক না করে তাঁরা সরাসরি বিশ্ববাসীদের জানালেন, সিএফসি নিষিদ্ধ না হলে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাব। গোটা পৃথিবীতে আলোড়ন শুরু হয়, চূড়ান্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সবাই এবং চাপের মুখে বাধ্য হয়ে সিএফসি সব থেকে বেশি যে কুড়িটি দেশ উৎপাদন করে তাঁরা এক জায়গায় হন, তৈরি হয় মন্ট্রিয়েল প্রোটোকলের ফ্রেমওয়ার্ক। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ তে রাষ্ট্রপুজ্ঞে, ইতিহাসে প্রথমবার, এবং এখনো পর্যন্ত ওই একবারই প্রত্যেকটি সদস্য দেশ, যার সংখ্যা সেই সময়ে ছিল ১৯৮, তাঁরা এই চুক্তি মানতে রাজি হন, এবং সিএফসি-সহ একশোটি রাসায়নিক নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

আজ, আমরা  জানতে পারছি, আর কয়েক দশকের মধ্যেই ওজোন স্তরের ছিদ্র সম্পূর্ণ ভাবে মেরামত হয়ে যাবে। এটা ঠিকই যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যা ওজোন স্তর মেরামত করার চেয়ে অনেক বেশি জটিল, কিন্তু এটাও ঠিক যে ওজোনের সঙ্গে লড়াইয়ে সব তরফেই গা ছাড়া ভাব দেখা গিয়েছিল। বিজ্ঞানীদের কথা বুঝে, মানুষের চাপের সামনে দাঁড়িয়ে বিরল এক সন্ধিক্ষণে পৃথিবীর সব দেশ একজোট হয় এবং রক্ষা করে মানবজাতিকে।

আজ আবারও সময় এসেছে সেই বিরল ঐক্য ফিরিয়ে আনার, সবাই মিলে একজোট হওয়ার। আমরা যদি আগে পেরে থাকি, তাহলে এখনও পারব, সমস্যা যতই জটিল হোক।  

More Articles