উন্মুক্ত শৌচাগারে নিগ্রহের শিকার, কতটা নিরাপদ বাংলাদেশের মেয়েরা?

খোলা বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়ে ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরী ও নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। দিন হোক রাত হোক, জল বয়ে আনতে হয় দূর থেকে।

শৌচাগারের ভূমিকা আধুনিক জনজীবনের ব্যক্তিগত পরিসরে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় সব ঘরে শৌচালয় থাকলেও গ্রামের দিকে তা থাকে একটু বাইরের দিকে। শুচিতা ইত্যাদির বোধ থেকেই এই ধরনের অভ্যাস দেখা যায়। অপর দিকে শহরাঞ্চলের নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়িতেও সংলগ্ন বাথরুম। আজকাল হাইজিন নিয়ে সচেতন অনেকেই। কিন্তু এর বাইরেও এক বিরাট অংশ বস্তি অঞ্চল। নিম্নবিত্তদের বাসস্থান। শহর তাদের চিলতে জায়গা ছেড়েছে। আলাদা করে চিহ্নিত একটুকরো বেড়াজালের মধ্যে বেঁধে রাখতে চেয়েছে তাদের জীবন। গায়ে গায়ে লাগা ছোট ছোট বাড়ি বা ঝুপড়ি, অপরিচ্ছন্নতার চূড়ান্ত, তারই মাঝে উন্মুক্ত গোসলখানা। কতটা যুক্তিযুক্ত এই ব্যবস্থা?

সম্প্রতি বাংলাদেশে এক জরিপে এমন প্রশ্ন উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, এই ধরনের খোলা বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়ে ঢাকার এই ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরী ও নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। দিন হোক রাত হোক, জল বয়ে আনতে হয় দূর থেকে। টয়লেটে, বাথরুমে দরজায় খিল নেই, ওপরে ছাদ নেই। কাজেই যৌন নিগ্রহের ঝুঁকি থাকে সারাক্ষণ।

১১ জুন, ঢাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত একটি সংবাদ সম্মেলনে এই জরিপের ফলাফল ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। সংস্থার ওয়াশ স্পেশালিস্ট এসএম তারিকুজ্জামান এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন পাঠ করেন। তাতে বলা হয়, ২০২২-এর জানুয়ারিতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ গার্লস ফর ইকনমিক অপরচুনিটি অ্যান্ড সেফ স্পেস 'ই গ্লস' নামে একটি মডেল প্রকল্প শুরু করে। ধলপুর, মালেক মেম্বার কলোনি, আইজি গেট কলোনি এবং ম্যাচ কলোনি— ঢাকা শহরের এই চারটে অঞ্চলে ১৫ খানা বাথরুম তৈরি হয় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (পিএসটিসি) যৌথ উদ্যোগে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ তার নীরব মোদি ও বিজয় মাল্য-দের নিয়ে কী করছে?

পাশাপাশি এই অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে, বিশেষভাবে মেয়েদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। ৪১৭ জন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সি মেয়েদের প্রশ্ন করা হয়। ১২টি বিশেষ দলীয় আলোচনাও হয়। এই সমীক্ষার পরিচালনার জন্য এবং সামাজিক মাধ্যমে একই সঙ্গে প্রচার চালানোর জন্যে বিওয়াইএস নামে একটি যুব সংগঠন উপরোক্ত দু'টি সংগঠনকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।

মেয়েদের প্রশ্ন করা হয়, কী জাতীয় গোসলখানা ব্যবহার করতে হয় তাদের? এই প্রশ্নের উত্তরে ওই এলাকার ৯৮ শতাংশ মহিলাই জানান, তাঁরা খোলা বাথরুম ব্যবহার করতে বাধ্য হন। এই জাতীয় গোসলখানার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশে নারীদের জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে। বাকি সমস্ত স্নানাগার ব্যবহার করে থাকেন পুরুষরাও। সর্বোচ্চ ৭০ জন এবং সর্বনিম্ন ২০ জন এক একটি গোসলখানা ব্যবহার করেন। ফলে এই জাতীয় বাথরুমের গড় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪৫ জন। ফলে অপরিচ্ছন্নতা তো রয়েইছে, তার সঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তার অভাব। প্রায় প্রত্যেক নারীই জানিয়েছেন, স্নানাগারে তাঁদের নিরাপত্তাহীনতার কথা। পাশেই রয়েছে উঁচু দালানকোঠা। এদিকে বাথরুমের ছাদ নেই। ফলে ছবি বা ভিডিও তোলার মতো ঘটনা ঘটে অহরহ। ৬৮.৬ শতাংশ কিশোরী এবং যুবতী প্রস্রাবাগার ব্যবহার করতে গিয়ে যৌন হিংসার শিকার হয়েছেন। ফলে রাতে তারা স্নানাগার বা প্রস্রাবাগারে যেতে রীতিমতো ভয় পান।

অপরিচ্ছন্নতা ও অব্যবস্থার কারণে রয়েছে আরও ভোগান্তিও। চার-চারটে কলোনির কোনও বাথরুমেই স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলানোর, ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলার ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেই। ফলে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। নানা রকমের অসুখের শিকার হন মেয়েরা। যৌন হিংসার কথা বলতে গিয়ে এইসব বাথরুম ব্যবহারকারী মহিলারা জানিয়েছেন যে,  তাদের ব্যবহার্য জল আনতে হয় অনেকটা দূর থেকে। ফলে অনেক বেশি সময় লাগে, এবং প্রায়শই সন্ধ্যা হয়ে যায়– একথা বলছেন প্রায় ৫৮.৭ শতাংশ নারী। সন্ধে হয়ে যাওয়ার পরে বাথরুমে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেখা গিয়েছে ৩৮.২ শতাংশ কিশোরী ও যুবতী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এই বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়ে ৭৯.২ শতাংশ মৌখিক হিংসার এবং ১৩.৪ শতাংশ যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।

প্ল্যান ইন্টারন্যশনাল বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যববস্থাপক মানিককুমার সাহা বলেন, গোটা বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত বস্তি এলাকা রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি। স্থান সংকুলানের অভাব তো রয়েইছে, উপরন্তু সিউয়েজ লাইনের প্রতিকূল অবস্থাও রয়েছে। আর এই অঞ্চলে গোসলখানা ব্যবহার করতে গিয়ে যৌন হিংসার সবথেকে বেশি শিকার হন কিশোরী ও যুবতীরা। ব্যক্তিগত পরিসরের ধারণাই যেন এখানে নেই। ফলে পুরুষ ও নারীদের একই সঙ্গে স্নান সারতে হয়। ফলে নিগ্রহ অনেক সহজ হয় পুরুষদের ক্ষেত্রে। একের অর এক হিংসার ঘটনা ঘটে চলে।

কী নারী, কী পুরুষ, কী রূপান্তরকামী– প্রতিটি মানুষের কাছে বাথরুম একটি নিভৃততম কোণ। সেই নিভৃত পরিসরের সুযোগ থাকা প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই জরুরি। জরুরি মানুষের মধ্যে প্রাইভেসির বোধ নির্মাণ। মানিক সাহা বলেন, “ঢাকার ৪টি কলোনিতে আমরা আমাদের প্রকল্পের আওতায় ১৫টি গোসলখানা নির্মাণ করেছি, যার মধ্যে ২টি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। আমরা আশা করি, কিশোরী ও নারীরা এগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাবে কিছুটা হলেও।” তবে তাঁর মতে বাথরুমের চাহিদার তুলনায় এ ক'টি অতি-সামান্য। “নীতিনির্ধারক মহলকে আমরা এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাই, যেন আমরা সবাই একত্রে এই সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানে কাজ করি। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের বাজেটে কীভাবে এই ইস্যুকে গুরুত্ব দেওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতেও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।”

 

More Articles