রেলে যাত্রার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে এই মটন কারি, আজও জিভে জল আনবে

১৯০০ এর দশকের গোড়ার দিকে ফ্রন্টিয়ার মেইলে পরিবেশন করা প্রথম কয়েকটি খাবারের মধ্যে একটি, রেলওয়ে মাটন কারি। অনেকে বিশ্বাস করেন, এটি ছিল বিখ্যাত কলকাতার মাংস ঝোল (মটন কারি) যা ওয়াজেদ আলি শাহের মাটন কোর্মা দ্বারা অনুপ্রা...

ছুটির দিনে বাড়িতে মাংস হবে না, ভাবা যায় না। কচি পাঠার তুলতুলে মাংসের ঘ্রাণে ভরে যায় আমাদের রবিবারগুলি! সে লুচি-মাংস হোক কিংবা গরম ভাতের সঙ্গে, ওই মাংস টা চাই। কিন্তু আমাদের সবার প্রিয় যে কষা মাংস না হলে আমাদের চলে না তার পেছনেও রয়েছে এক চলমান ইতিহাস। চলমান বলার কারণ এই মাংস রান্নাই হত চলমান অবস্থায়। আমরা রেলওয়ে মটন কারির কথা বলছি। যার হাত ধরে মটনের এত ভরভরন্ত সংসার সেই কারির পিছনে ছিল ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস আর ভারতীয় বাবুর্চির বুদ্ধি।

রেলওয়ে মটন কারি বলতেই আমাদের চোখের সামনে সেই ব্রিটিশ আমলের ট্রেনের কামরার ছবি ভেসে ওঠে। ১৯০০ এর দশকের গোড়ার দিকে ফ্রন্টিয়ার মেইলে পরিবেশন করা প্রথম কয়েকটি খাবারের মধ্যে একটি, রেলওয়ে মাটন কারি। অনেকে বিশ্বাস করেন, এটি ছিল বিখ্যাত কলকাতার মাংস ঝোল (মটন কারি) যা ওয়াজেদ আলি শাহের মাটন কোর্মা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ সালে ভারতে রেল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিল। তাদের ট্রেনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ফ্রন্টিয়ার মেল। সেই সময়ে একে রোলস রয়েসের সাথে তুলনা করা হত। সেই যুগেও দাঁড়িয়ে এই ট্রেনে ছিল আধুনিক সুবিধা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও নিজের আত্মজীবনীতে এই ট্রেনের উল্লেখ করেছেন। ট্রেনের ভিতরে ঠাণ্ডা রাখার জন্য এই ট্রেনের বাইরে ওপরের অংশে বরফের চাই রাখার ব্যবস্থা ছিল। এই ফ্রন্টিয়ার মেলের গতায়ত ছিল ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে। এই ট্রেনের প্যান্ট্রি কারেই জন্ম হয়েছিল মটন কারির।

এটা সেই আমলের কথা, যখন প্রতিটি দূরপাল্লার ট্রেনে থাকত সুসজ্জিত ডাইনিং কার, নিখুঁত ইউরোপিয় কায়দাতেই৷ মাথায় পাগড়ি এবং দুধসাদা পোশাকের ওপর কোমরবন্ধ আঁটা খানসামারা এসে টেবিলে টেবিলে খাবার সার্ভ করতেন৷ আর রেল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্তা এবং পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য থাকত আরও এলাহি আয়োজন৷ তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব সেলুন-কার থাকত, যে কামরায় বাবু-বিবির শোওয়ার ঘরের লাগোয়া থাকত বসার ঘর, রান্নাঘর এবং ব্যক্তিগত পরিচারক ও ভৃত্যদের আলাদা ঘর৷ ১৯০৩ সালের প্রথম দিকে মেল এবং এক্সপ্রেস ট্রেনে ডাইনিং কার চালু হয়। এর আগে সকাল, দুপুর আর বিকেলের খাবারের জন্য বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামত।

রেলওয়ে মটন কারি নিয়ে একটি মজার প্রচলিত গল্প আছে। একবার এক ব্রিটিশ সাহেব রাত্রেবেলা রেলের ক্যান্টিনে যান কিছু খাবারের আশায়। তখন ট্রেনের সকলের খাবার কমপ্লিট শুধু ট্রেনের বাবুর্চিরা তাদের নিজেদের জন্য বেঁচে যাওয়া মটন রান্না করছে। রান্না হচ্ছিল, কলকাতার ঝাল ঝাল কষা মাংস। সেই সময় সেখানে সাহেব উপস্থিত হয়ে খাবারের আবদার করেন। বাবুর্চিরা সাহেব কি খেতে চান জিজ্ঞেস করায়, তিনি মাংস রান্নার দিকে তাকিয়ে বলেন তিনি ঐ কষা মাংস খাবেন। বাবুর্চি  পড়ল মহা বিপদে। সাহেবরা অল্প ঝালের খাবার খান কিন্তু এই মাংস তো ঝালে টয়টম্বুর। সাহেবকে সে কথা বললেও তিনি ওটিই খেতে আবদার করেন। শেষে দেখা যায়, শত ঝাল সত্ত্বেও সাহেব সেই মাংসটি খেয়ে নেন এবং ওই সামান্য পদটি তার ভীষণ ভালোও লেগে যায়। তিনি বাবুর্চিদের বলেন এরপর থেকে যখনই এই ডিশ রান্না হবে তখন যেন একটু অল্প ঝাল দিয়ে তা রান্না করা হয়। এরপর থেকে তিনি যখনই ট্রেনে উঠেছেন বাবুর্চিরা তার কথা মাথায় রেখে পরবর্তীকালে সেই ঝোলে একটু মিষ্টি ভাব আনার জন্য টক দই এর ব্যবহার শুরু করে। এইভাবেই শুরু হল ‘রেলওয়ে মটন কারি’র যাত্রা। 

আরও পড়ুন-পদ্মা সেতু আবেগে কাঁপছে বাংলাদেশ! কেন নাশকতার ভয় হাসিনার মনে?
 

রেলওয়ে মটন কারিকে ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ বা ‘ফিউশন’ ডিশও বলা হয়। কারণ এই রান্নায় ব্যবহৃত লবঙ্গ, দারচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচ এইসব সেই সময় বিদেশি মশলা ছিল। আর দেশীয় মশলা ছিল – শুকনো লঙ্কা, জিরে, ধনে, এবং হলুদ। এই ছিল রেলওয়ে মটন কারির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এরপর এই ডিশ ট্রেন থেকে বড় বড় হোটেল এবং এখন আমাদের রান্নাঘরেও রান্না করা যায়। আগেকার দিনে ট্রেন চলত কয়লার সাহায্যে তাই কয়লার ঢিমে আঁচে সেই রান্নার স্বাদ আর গন্ধ ছিল অনবদ্য।

কষা মাংসের সাথে রেলওয়ে মটন কারির পার্থক্য

কষা মাংসের ক্ষেত্রে আমরা ঝাল, মশলা বেশি দিই এবং জল কম দিই যাতে মাংস ঝোল ঝোল না হয়। কিন্তু রেলওয়ে মটনের ক্ষেত্রে ঝাল আর মশলা কম পড়ে এবং তা একটু ঝোল ঝোল হয়। একবার বানিয়েই দেখতে পারেন এই রেলওয়ে মটন কারি। রেসিপিটাও রইল আপনার জন্য-

উপকরণ

খাসির মাংস, আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, টম্যাটো, টক দই, তেজপাতা, দারুচিনি, শুকনো লঙ্কা, গোটা গোলমরিচ, ছোট এলাচ, বড় এলাচ, লবঙ্গ, জয়িত্রী, গোটা জিরে, গোটা ধনে, গোটা মৌরি, গরম মসলা, কাশ্মীরি লঙ্কার গুড়ো, হলুদ গুড়ো, চিনি, নুন, সরষের তেল, নারকেলের দুধ।


রন্ধন প্রণালী

প্রথমে মাংসে দু কাপ জল দিয়ে বা মাংস অনুযায়ী জল দিয়ে সেদ্ধ করে নিন।

কড়াইতে সরষের তেল দিয়ে ওপরে বর্ণিত গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, জিরে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন।

এরপর একে একে পেয়াজ কুচি, আদা, রসুন বাটা, টম্যাটো কুচি দিয়ে নাড়তে থাকুন। তারপর নুন, হলুদ, লঙ্কা গুড়ো দিন।

খোসা ছাড়ানো আলু দিয়ে একটু উষ্ণ জল দিয়ে দিন। এই জলেই আলু সেদ্ধ হবে।

আলু সেদ্ধ হয়ে এলে আগে থেকে সেদ্ধ করা মাংসটা এর মধ্যে দিতে হবে।

এরপর ফেটানো টক দই আর নারকেলের দুধ দিয়ে দিতে হবে।

তারপর ২-৩ টে বড় আর ছোট এলাচ তার মধ্যে দিয়ে দিন এবং একটু নেড়ে নিন।

গ্যাস মিডিয়াম ফ্লেমে রেখে ১০ মিনিটের জন্য রেখে নিন।

১০ মিনিট বাদে ঢাকনা খুলে মাংস সেদ্ধ হয়ে এলে তৈরি রেলওয়ে মটন কারি।

বলা বাহুল্য যে সেই রাজ জমানা যেমন আর নেই, ভারতীয় রেলের সেই সুদিনও বহু বছর আগেই বিদায় নিয়েছে৷ এখন রেলযাত্রার সময় সাবধানী যাত্রী উপায় থাকলে বাড়ি থেকে খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যান৷ অনেকেই অভিযোগ করেন রেলের খাবার এখন মুখে দেওয়া যায় না, এতটাই বিস্বাদ৷  এমনকী অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এই খাবার খেয়ে এমন খবরও সংবাদ শিরোনামে এসেছে।৷ নানা কারণে দূরপাল্লার ট্রেনে আর আলাদা ডাইনিং কার বা প্যান্ট্রি কার থাকে না৷ সব মিলিয়ে রেল সফরের সেই দারুণ রোমান্টিকতা আজ বিলকুল উধাও৷

কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেই ভাবতে চাইছে ভারতীয় রেলের অধীনস্থ সংস্থা আইআরসিটিসি।  রেলদপ্তরের নিজস্ব রেস্তোরাঁ খোলার পরিকল্পনা করেছে এই সংস্থা যেখানে পাওয়া যাবে পুরোনো আমলের সেই সব অবিস্মরণীয় খাবার। যা গোরা সাহেবদেরকেও মুগ্ধ করেছিল। এখন দেখা যাক, সেই গুণমান আইআরসিটিসি ফিরিয়ে দিতে পারে কিনা।

More Articles