বাংলাদেশে যেভাবে ফিরে এল ইলিশের সুদিন

একবিংশ শতাব্দীতে আবার ফিরে এসেছে ইলিশের সুদিন। বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টন।

 

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার ভারতের কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন জেলা সিরাজগঞ্জের সুধী সমাজের নিমন্ত্রণে। সেসময় সিরাজগঞ্জের ইলিশ মাছ, আকার ও স্বাদে ছিল সারা বাংলাদেশে বিখ্যাত। জাতীয় কবির সম্মানে, নিমন্ত্রণে রাখা হয় ইলিশের মহাভোজ, যেখানে রান্না করা হয় ইলিশ দিয়ে নানা পদের খাবার। কিন্তু নিমন্ত্রণে কবি অল্প খাওয়ার পরই আরও খাওয়ার অপারগতা জানালেন। আয়োজকরা বেশ চিন্তায় পরে গেলেন এবং মনে মনে ভাবলেন, রান্না কি তবে পছন্দসই হয়নি? কাজী নজরুল ইসলাম তখন তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, “রান্না অসাধারণ হয়েছে কিন্তু এর থেকে বেশী খেলে শরীর থেকে ইলিশের সুবাস বের হলে পরে যদি ক্ষুধার্ত বেড়াল তেড়ে আসে, এই ভয়েই ইলিশ খেতে অধমের অপারগতা।"

লোকমুখে কথিত, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে জাতীয় কবির এরকম মন্তব্যই বলে দেয়, রুপোলি ইলিশের স্বাদ কতটা অনন্য।

ইলিশ মাছের কাঁটা নিয়ে 'ইলিশ মাছের ত্রিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি' এরকম একটি ছড়াও রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে হাজার ধরনের মাছের লাখো বরণ অথচ হাজারও মাছকে টেক্কা দিয়ে বাঙালি পাড়ায় গড়ে উঠেছে বহু পুরনো ইলিশ সংস্কৃতি। ইলিশের রয়েছে কয়েকশো প্রকার রান্নার বৈচিত্র্যও। তাই তো ভোজনরসিক বাঙালিদের স্বাদে, বর্ণে ও গন্ধে কোন মাছ সেরা, জিজ্ঞেস করামাত্রই এককথায় বলে ফেলবেন, 'কোন মাছ আবার, ইলিশ মাছ।' ইলিশ শুধু জাতীয় মাছ নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বের এক নিবিড়তম অংশও বটে। 

ইলিশ নিয়ে বাংলাদেশিদের মাতামাতিটা কবে থেকে শুরু তা ঠিক বলা না গেলেও আটের দশকের শুরুতে দেশে ইলিশের সবথেকে বেশি রমরমা অবস্থা ছিল। তখন প্রায় বিশ শতাংশ ইলিশ মাছের উৎপাদন হতো। মাছের রাজা ইলিশ বাঙালির সেরা ঐতিহ্য। কিন্তু কেন এই ইলিশ বাংলায় সেরা, এটা জানতে একটু পিছনের দিকে ফিরে যেতে হবে।

প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে একটি শ্লোক আছে 'সর্বেষামেব মৎস‍্যেনাম ইল্লিশ শ্রেষ্ঠ উচ্চতে'। সহজ বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, সব মাছের সেরা মাছ হচ্ছে ইলিশ। উৎপত্তিগতভাবে 'ইলিশ' নামক শব্দেই এই মাছ কতটা রাজরসিক বোঝা যায়। সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা 'ইলীশ' শব্দের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে হয় ইল+ঈশ, 'ইল' মানে জলের মধ্যে আর 'ঈশ' হলো শাসক বা রাজা। প্রকৃতপক্ষে, জলের রাজা 'ইলিশ' নামের আবির্ভাব এভাবেই। বাঙালিদের 'মেছো বাঙাল' উপাধির জন্যও কিন্তু ইলিশের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত।

ইলিশ বাংলাদেশের একটি শস্য। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টারের তথ্যমতে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর মোট মাছ উৎপাদন হয় প্রায় ১৮০ মিলিয়ন টন, যার মধ্যে প্রায় ০.৭৫ মিলিয়ন টন উৎপাদন ইলিশ মাছের‌। তবে ইলিশের সিংহভাগটাই উৎপাদন হয় বাংলাদেশে, যার পরিমান ০.৫৩ মিলিয়ন টন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইলিশের ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, "দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ মোট জিডিপির ১ শতাংশ।" ইলিশ মাছের উৎপাদন ও প্রজননে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ লাখেরও বেশি মানুষ সরাসরি জড়িত এবং আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ নানা ইলিশ-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন । এসব কারণেই কবি বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে 'জলের উজ্জ্বল শস্য' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আবহমান বাংলার খাদ্য-সংস্কৃতিতে মাছ তথা ইলিশের অতি-উচ্চ আসন, কিন্তু হাজার বছরের চর্চারই ফল । এমনকী, বাঙালির মৎস্যপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত । অথচ নয়ের দশকে কিছু অতি মুনাফালোভী মহাজন ও জেলেদের কারেন্ট জাল ব্যাবহারের কারণে সেই ইলিশের উৎপাদনে ধস নামে, যা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাত-আট ভাগে নিয়ে আসে। মা ইলিশ ও জাটকা নিধনের ফলে ইলিশের স্বাভাবিক প্রজনন এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন। পরে ইলিশ সংরক্ষণে ও জাটকা-ধরা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সেসময়, নয়ের দশকে বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি টেলিভিশন বিটিভিতে ইলিশ বাঁচাতে একটি সচেতনতামূলক প্রচারমূলক টেলিভিশন ক্যাম্পেন শুরু হয়। সাদেক আলি ও মাস্টার সাহেব- দু'টি চরিত্রের ছড়ায় ছড়ায় বর্ণিত জনপ্রিয় ক্যাম্পেনটি জাটকা ধরা বন্ধ রোধে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করে। প্রমোশনাল ছড়াটির লাইনগুলো ছিল, 'মাছের গুষ্টি দেখাও ফাল, লগে আনছি কারেন্ট জাল, কপালের ফের কি আর করা, আণ্ডা-বাচ্চাসহ পড়বা ধরা, ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকা, কারেন্ট জালে আটকা, ইলিশ মাছের পোনারে, টেকার খবর শোনা রে।'

এছাড়া নয়ের দশকে একটি স্বনামধন্য কোম্পানির 'বাত্তির রাজা ফিলিপ্স, মাছের রাজা ইলিশ' ক্যাম্পেনটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় । এসব ক্যাম্পনের পাশাপাশি বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের বহুমুখী উদ্যোগে একবিংশ শতাব্দীতে আবার ফিরে এসেছে ইলিশের সুদিন। বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টন। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে যেখানে ইলিশ উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন । চলতি বছর, মানে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আনুমানিক ৬ লাখ ৫০ হাজার টন।

প্রত্যেক বছরের মার্চ-এপ্রিল- এই দু'মাস ইলিশ, জাটকা-সহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী। বাংলাদেশ ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছের গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসেন তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, “মা ইলিশকে যদি ডিম পাড়ার পরিপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়, তাহলে ২০০ গ্রামের একটি ইলিশ থেকে বছরে প্রায় দেড় লাখ ইলিশের বাচ্চা পাওয়া সম্ভব।" পদ্মানদীর ইলিশ নিয়ে গবেষণায় দেখা গিয়েছে ১৪০০ গ্রামের একটি ইলিশ যদি ডিম পাড়ার সুযোগ পায়, তাহলে বছরে প্রায় ১৬ লাখ ইলিশের বাচ্চা প্রজনন সম্ভব এবং একটি ইলিশ থেকেই আর্থিকভাবে ৭৬ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।

বর্ষা ঋতুতেই মূলত ইলিশের ভাব, প্রেম ও পরিণয়। বাংলাদেশে বর্ষাকাল তথা আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এই তিন মাসজুড়েই সিলভার ইলিশের মরশুম এবং বর্ষার শেষ অংশে আগস্ট মাস হচ্ছে ইলিশ ধরার সঠিক সময়। পরিচিত একটি ধাঁধা রয়েছে, “রুপার পাতে মারে ঘা, পানির বুকে ফেললো ঘা”- যেটার এককথায় উত্তর ইলিশ। চকচকে রূপোলি ইলিশের বসবাস বঙ্গোপসাগরে। আর ডিম পাড়তে সেই ইলিশ চলে আসে নদীর বুকে। বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ে। ইলিশ ও বর্ষায় বৃষ্টির মনোমুগ্ধকর ভাব দেখেই 'ইলশে গুঁড়ি' নাম হয়েছে প্রকৃতিময় এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির।

নদীর বুকে প্রজননের ধারাবাহিকতায় মা ইলিশের সমুদ্রে আর ফেরা হয় না, বহু ঘাট পেরিয়ে এক পর্যায়ে ধরা দেয় পদ্মা নদীর জেলের জালে এবং সেখান থেকে বাঙালির রান্না ঘরে। ইলিশ মাছ রান্নায় আসল স্বাদ পাওয়া যায় সমুদ্রের পানি নয়, মিঠে পানির ইলিশে। তাই ‌তো বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ইলিশের স্বাদ পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত বিশাল আকার ও স্বাদের জন্য।

ভারতের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার বিখ্যাত উপন্যাস 'পদ্মানদীর মাঝি’-তে লিখেছিলেন, "নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ, লন্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, নিস্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।"

ইলিশ উৎসর্গ ছাড়া অনেক পুজোই অসম্পূর্ণ। সরস্বতী ও লক্ষ্মীপুজোতে জোড়া ইলিশই শুভ। একটা সময় বাংলা দিনপঞ্জিকার নির্দিষ্ট কয়েক মাস, পূর্ণিমা, পূর্ণিমার পর দিন, অমাবস্যা এবং অষ্টমীর দিনগুলো-সহ বছরে প্রায় ৫২ থেকে ৭২ দিন মা ইলিশ ও ছোট ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ছিল স্বাদ এবং অশুভজনিত কারণে।

দুই বাংলার মধ্যেও রয়েছে ইলিশ নিয়ে প্রতিযোগিতা। ওপার বাংলার কারও কাছে গঙ্গার ইলিশ বেশি সুস্বাদু আবার অনেকেই স্বাদে ও গন্ধে এপাড়ের পদ্মার ইলিশকে শ্রেষ্ঠ ইলিশ বলে থাকেন।

বাংলাদেশের নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদও ইলিশের স্বাদ নিয়ে লিখতে বাদ রাখেননি । তাঁর মতে, “হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পিলারে ধাক্কা খেয়ে নাক বোঁচা হওয়া ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে বেশী।"

 

More Articles