ইউক্রেনে দাপাচ্ছে রাশিয়া, সত্যিই কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি আমরা?

সাল ১৯২৫, হিটলার তার আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্ফে লিখলেন, অস্ট্রিয়া জার্মানির অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং তাকে জার্মানির সঙ্গে পুনরায় মিলিত করতেই হবে। ১৯৩৮-এ সেই কাজ সেরে ফেললেন তিনি, বিনা রক্তপাতে নিজের জন্মস্থানকে তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ফেললেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বললেন জার্মানির বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কিন্তু তার পরের এক বছর ধরে কি ব্যবস্থা নেবেন তা বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি।

সেপ্টেম্বর ১, ১৯৩৯। জার্মানি আক্রমণ করল পোল্যান্ডকে। তাদের অভিযোগ, পোল্যান্ডে জার্মান বংশোদ্ভূতদের ওপর পোলিশ সরকার অত্যাচার করছে, এবং পোল্যান্ড গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জার্মানিকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনও শুরু হয়ে যায়নি। যুদ্ধ বলব? না শুধু মাত্র রুশ আগ্রাসন বলব? সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। প্রয়োজন এটাও বোঝা, আমরা, পৃথিবীবাসীরা কি আরো একটি বিশ্বযুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে?

সবার আগে প্রয়োজন ইউক্রেন এবং রাশিয়ার ইতিহাস বোঝা। এই ইতিহাস কিন্তু বরাবর সংর্ঘষের ছিল না। আজ থেকে এক হাজার বছরের ও পিছনে যেতে হবে আমাদের এই ইতিহাস বুঝতে। স্থান? কিভ, আজকের ইউক্রেনের রাজধানী। প্রথম স্লাভিক রাজ্য কিভিয়ান রুসের একেবারে কেন্দ্রে ছিল আজকের কিভ, এবং সেই স্থানেই জন্ম হয় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের। ১৯৮৮ সালে সেই রাজ্যের রাজপুত্র প্রথম ভ্লাদিমির খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং ভ্লাদিমির পুতিনের কথায়, সেই মুহূর্ত থেকেই এই দুই দেশের সত্তা এক হয়ে যায়।

কিন্তু পুতিনের এই দাবির সঙ্গে ইতিহাসের বিশেষ মিল পাওয়া যায় না। গত দশ শতক ধরে ইউক্রেনের মাটি বহুবার হানাদারদের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। তেরোর শতকে মঙ্গোলরা তৎকালীন কিভিয়ান রুস আক্রমণ করে, ষোলোর শতকে পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ার বাহিনী আক্রমণ করে, সতেরোর দশকে পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ার বাহিনীর সাথে এই অঞ্চলের দখল নিয়ে যুদ্ধে নামে রাশিয়ার জার বাহিনী। যুদ্ধ শেষে জমির ভাগ বাটোয়ারা হয়, পূর্ব অংশ যায় জারের বাহিনীর হাতে, পশ্চিম যায় পোল্যান্ডের কাছে।

তার একশো বছরের ও বেশি সময় পর ১৭৯৩ সালে রাশিয়া ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ ভাবে দখল করে নেয়। শুরু হয় রুশিফিকেসন প্রক্রিয়া। ইউক্রেনিয়ান ভাষা নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং সেখানকার মানুষদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়।

তখনও ইউক্রেনবাসী কিছুই দেখেননি। তাদের আসল পরীক্ষা শুরু হয় বিশ শতকে, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তির আগে এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের শিকার হয় তাঁরা। বহু মানুষের জীবন চলে যায়, শেষ হয়ে যায় হাজার হাজার পরিবার। তিরিশের দশকে অত্যাচার আরো অন্য মাত্রায় নিয়ে যান জোসেফ স্তালিন। যৌথ চাষ ব্যবস্থায় চাষিদের অন্তর্ভুক্ত করানোর জন্যে দুর্ভিক্ষের পরিকল্পনা করা হয়, এবং খেতে না পেয়ে মৃত্যু হয় লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনবাসীর। তারপর স্তালিন হুকুম দেন, যাতে রুশ এবং অন্যান্য সোভিয়েত ইউনিয়নের বাসিন্দারা ইউক্রেনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন, তাকে জনবহুল করেন।

এই ইতিহাসটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ আজকের এই বিরোধের উৎস এই ইতিহাস। পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন দেখা গিয়েছে কারণ এই অঞ্চল সেই আঠারো শতক থেকে রাশিয়ার অধীনে। অন্য দিকে পশ্চিম অংশের দখল ঘোরা ফেরা করেছে অন্যান্য ইউরোপিয়ান শক্তিদের হাতে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের পর ইউক্রেন স্বাধীন তো হয়, কিন্তু পূর্ব এবং পশ্চিমকে এক করার কাজ খুব কঠিন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে অনেক ইউক্রেনবাসী গনতন্ত্র এবং ধনতন্ত্রে স্থানান্তরের বিষয়কে একেবারেই সমর্থন করেননি। ইউক্রেনবাসীর মধ্যে তৈরি হয় ফাটল, এক দল সোভিয়েত ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে এবং একদল সোভিয়েতের পতনে খুব খুশি। এই ফাটল আরো তীব্র হয় ২০০৪ সালে কমলা বিপ্লবের সময়ে, যেখানে বহু মানুষ ইউক্রেনের ইউরোপিকরণের দাবিতে পথে নামেন।

পুতিন মাঠে নেমে পরেন ২০১৪ তে, তার বাহিনী পৌঁছে যায় ক্রিমিয়ায় এবং দখল করে নেয় সেই অঞ্চল। এই সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচারা দিয়ে ওঠে, পূর্ব ইউক্রেনের লুহাস্ক এবং ডনেক্সে, রাশিয়া খোলাখুলি মদত দিতে থাকে তাদের। এই দুই অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন পুতিন যুদ্ধ শুরুর দু'দিন আগে। এই হল তার ইতিহাস।

আসা যাক বর্তমানে। পুতিনের দাবি, ইউক্রেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি তাঁরা কোনও ভাবেই মেনে নেবেন না, কারণ এতে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে, যেহেতু আমেরিকা এবং তার সাথীরা রুশবিরোধী এই অক্ষ দিয়ে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। জর্জিয়া এবং ক্রাইমিয়া নিয়েও একই বক্তব্য ছিল পুতিনের। ২০০৮ সালে জর্জিয়াকে আক্রমণ করে রাশিয়া, তাদের ন্যাটো অন্তর্ভুক্তি আটকে দেয়। ইউক্রেনের সাথেও তাঁরা ঠিক একই কাজ করতে চলেছে। এছাড়াও পুতিন বরাবরই বলে এসেছেন যে ইউক্রেন রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ, এই দুই দেশের আলাদা থাকার কোনো অর্থ তিনি খুঁজে পাননি। ইউক্রেনের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্বের কোনো প্রয়োজনই তিনি অস্বীকার করেন। তাছাড়া তার দাবি, ইউক্রেনের রুশভাষাভাষীদের অস্তিত্ব বিপন্ন, বিশেষ করে সেই পূর্ব ইউক্রেনের বাসিন্দাদের, যাদের কথা আগেই বলেছি।

আসা যাক ন্যাটো, আমেরিকা এবং বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার প্রশ্নে।

বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারেই নেই তা বলা চলে না, কারণ ন্যাটো প্রধান ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে তাঁরা বায়ু, জল এবং স্থল, তিন বিভাগেই সেনা মজুত করছেন তাদের সদস্য দেশ গুলিতে, বিশেষ করে পোল্যান্ডে। কিন্তু যতক্ষণ না ন্যাটো এবং রাশিয়া সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে ততক্ষণ আমরা আশা রাখতে পারি যে বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছেনা। আমেরিকা সরাসরি বলে দিয়েছে যে, তাঁরা রাশিয়ার সাথে মিলিটারি সংঘাতে যেতে চায় না, ব্রিটেনও তাই, এবং এই দুই দেশই অত্যন্ত কড়া আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে রাশিয়ার ওপর। তা সে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণব্যাঙ্ক গুলির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হোক, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাই হোক বা রাশিয়ান ধনকুবেরদের দেশে ঢুকতে না দেওয়াই হোক, তাঁরা মনে করছেন তাঁরা রাশিয়াকে হাতে নয় ভাতে মারবেন। জার্মানি ও রাশিয়ার থেকে গ্যাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

এবার প্রশ্ন হল এইভাবে কি রাশিয়াকে আটকানো সম্ভব হবে? পুতিন ২০১৪ এর পর থেকেই জানতেন যে যখনই তিনি আবারও ওই ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো হবে। তাই যথেষ্ট আঁটঘাঁট বেঁধেই তিনি যুদ্ধে নেমেছেন বলে জানা যাচ্ছে।রাশিয়ার কাছে এই মুহুর্তে ৬০০ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে, যা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সঞ্চয়। এছাড়াও রাশিয়ার জাতীয় দেনা খুব একটা বেশি নয়। পৃথিবীর খনিজ তেলের তেরো শতাংশ আসে রাশিয়ার মাটির তলা থেকে, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রায় চব্বিশ শতাংশ। রাশিয়া এই মুহূর্তে অনেক ক্ষেত্রেই শুধু স্বয়ং নির্ভরই নয়, যারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছেন তাঁরা কিন্তু আরো বেশি করে বিপদে পড়বেন, বিশেষ করে জার্মানরা।

১৯৯১ সালে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ইউক্রেনের কাছে সেই সময়ে সোভিয়েত প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়া পাঁচ হাজার পরমাণু অস্ত্র ছিল। কিন্তু দুর্বল অর্থনীতি হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে রাশিয়া ও আমেরিকা তাদের বাধ্য করে সেই অস্ত্রভাণ্ডার তাদের হাতে তুলে দিতে। ইউক্রেনের সুরক্ষার দায়িত্ব সেই দিন তিন মহা শক্তিধর রাশিয়া, আমেরিকা এবং ব্রিটেন নিয়েছিলো। আজ দেখুন, একজন তাদের আক্রমণ করে তাদের স্বাধীনতা বলপূর্বক, রক্তপাত ঘটিয়ে, ধ্বংসলীলা চালিয়ে, মিলিটারি শক্তি প্রয়োগ করে কেড়ে নিতে চাইছে, আর বাকি দুই দেশ দূর থেকে সমর্থনের বার্তা দিচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে। এই দেখে আর কোনো দেশ কখনও নিজেদের পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডার কে ধ্বংস করবে? আজকের পর পরমাণু অস্ত্রবিহীন পৃথিবীর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে চিরকালের জন্যে।

ন্যাটোর ভূমিকাও এখনও প্রশ্নের উর্ধে নয়। তাদের সংস্থাতে অন্তর্ভুক্তি নিয়েই সমস্যার সূত্রপাত,  ইউক্রেন তাদের জন্যে অনেক পা এগিয়ে আজ মহা বিপদে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ন্যাটোর কাছে বিশেষ দিশা নেই ওদের রক্ষা করার। ইতিহাস সাক্ষী, শান্তি রক্ষার নামে আজ পর্যন্ত সফল ভাবে যুদ্ধই লাগিয়ে এসেছে ৩০ দেশের এই সংগঠন।

আর রাষ্ট্রপুজ্ঞের কথা মনে হয় কারোর মাথাতেই আসেনা। কেনো আসবে? সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, তালিকা অনেক দীর্ঘ, এবং কোনো ক্ষেত্রেই এই সংস্থা কিছুই করতে পারেনি, আজও কেউ আশা রাখছেন না। আক্রমণকারী তো সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা পরিষদেরই স্থায়ী সদস্য।

আজ ইউক্রেন আক্রান্ত,  বলা যায় মানবতা আক্রান্ত, আক্রান্ত নিরপরাধ মানুষেরা, আক্রান্ত বিশ্ববাসীরা। শুধু পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা নয়, গোটা বিশ্ব জুড়ে মুল্যবৃদ্ধি এবং মন্দার আশঙ্কা, আবারও লক্ষ লক্ষ মানুষের গৃহহীন, উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা, আশঙ্কা পরিবেশের অপূরনীয় ক্ষতির।

ইউরোপের মাটিতে ১৯৪৫ সালের পর এত বড় যুদ্ধ লাগেনি, তাই এই একটা আশঙ্কাও অমূলক নয়। সবে মহামারীকে পিছনে ফেলে মানব সভ্যতা যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তখনই এক রাষ্ট্র নায়কের খামখেয়ালির, সাম্রাজ্যবাদের মাশুল আবারো দিতে হবে আমাদের। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অন্য দেশ যুদ্ধে নামলে আরো বড় মাপের যুদ্ধ হবে, আর রাশিয়া যদি সফল ভাবে ইউক্রেনের দখল নেয়, তাহলে সাম্রাজ্যবাদীরা আরো উৎসাহ পাবে, আর প্রমাদ গুণবে তাইওয়ান, কাজাকিস্তানের মত বহু দেশ, প্রমাদ গুণবে মানবতা।

More Articles