রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ঠিক কী?

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলের পথে রাশিয়া। রুশ আগ্রাসনে বিপর্যস্ত হয়েও হাল ছাড়েনি ইউক্রেন। ইতিমধ্যেই দু-দেশের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যাই বিরাট। প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট এখন কেবল ইউক্রেনের বিরুদ্ধেই লড়ছেন তা নয়, নিজের দেশে প্রেসের স্বাধীন বহুমাত্রিক স্বরকে দমিয়ে দেওয়াও এখন পুতিনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

বিষয়টা ঠিক কেমন? দু একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা হবে কীভাবে সরকারের মতকেই সুকৌশলে প্রেসের ওপর আরোপ করছে রাশিয়া। ২৪ শে ফেব্রুয়ারি গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলির শিরোনাম ছিল রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু স্বয়ং পুতিন কিন্তু একে যুদ্ধ বলতে নারাজ। ফলে নিজের দেশের সংবাদমাধ্যমগুলির জন্য সরকারের কড়া নির্দেশিকা ছিল এই আক্রমণকে বলতে হবে ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন’। ভাবখানা এমন যেন ইউক্রেনের নিজের স্বার্থেই রাশিয়াকে এই যুদ্ধের দায়িত্ব নিতে হয়েছে।  সংবাদমাধ্যমকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে একের পর এক সংবাদসংস্থার ওপর নেমে এসেছে রাষ্ট্রের খড়গহস্ত। ১৯৯০ সালের সোভিয়েতে তৈরি হয় ‘ইকো অফ মস্কো’ রেডিও স্টেশন যা রাশিয়ান প্রেসের ইতিহাসে মুক্তচিন্তা এবং মুক্তস্বরের অন্যতম মাইলফলক। এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে রাশিয়ার প্রশাসন এই রেডিও স্টেশনটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার ‘টিভি রেইন’ বলে অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম নিজেদের অফিসে তালা ঝুলিয়েছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য।

২০২১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন রাশিয়ার সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ। রাশিয়ান সরকারের স্বাধীন মতামত দমনের নীতির সামনে বন্ধ হওয়ার মুখে তার সংবাদপত্র নোভেয়া গেজেট। এই প্রসঙ্গে দিমিত্রি স্পষ্ট জানিয়েছেন বর্তমান রাশিয়ায় যে সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাবে তার ওপরই নেমে আসবে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু। দিমিত্রি বলেছেন , "বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সরকারের মতে সংবাদ মাধ্যমগুলোর একমাত্র কাজ প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়া। যে মিডিয়া রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করতে অস্বীকার করবে তারই কণ্ঠরোধ করবে পুতিনের সরকার।" রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা আপনাকে অবশ্যই মনে করাবে হিটলার জমানায় নাৎসি জার্মানির প্রেসের কণ্ঠরোধের ঘটনা।

ইকো অফ মস্কো দীর্ঘদিন ধরেই পুতিনের এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছে। ইকো অফ মস্কোর সম্পাদক অ্যালেকসি ভেনেডিক্তব এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। আলেক্সি জানিয়েছেন মস্কো ক্রমাগত নিজেদের যুদ্ধের উপলক্ষ্যকে আড়াল করার চেষ্টা করে এসেছে। সংবাদ মাধ্যমের যাবতীয় ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ করছে মস্কোর হেড কোয়ার্টারস। এই গোটা যুদ্ধে ইকো অফ মস্কো সরাসরি একাধিক ইউক্রেনের সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার যারা সরাসরি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। হাতে কলমে প্রমাণ করে দেখিয়েছে এই যুদ্ধের বীভৎসতা। তারই মাসুল দিতে গিয়ে ১৯৯১ এর পর প্রথমবারের জন্য সম্প্রচার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে ‘ইকো অফ মস্কো’।

প্রায় একই ঘটনার শিকার টিভি রেইন। ২০১০ এ নাতালিয়া সিন্দেইয়াভা এবং ভেরা ক্রিচেভস্কায়ার হাত ধরে জন্ম হয় টিভি রেইনের। এরপর ধীরে ধীরে স্বাধীন ও নির্ভীক সাংবাদিকতার এক নতুন পরিসর তৈরি করে টিভি রেইন। শুধু তাই নয় উদীয়মান তরুণ সাংবাদিকদের আঁতুড়ঘর হিসেবে ও টিভি রেইন এক পরিচিত নাম। অতীতে ক্রেমলিন দখলের সময় ও রাশিয়ান প্রশাসনের অবাধ্যতার মূল্য দিতে হয়েছে এই সংবাদ চ্যানেলটিকে। কিন্তু কোনোভাবেই শাসক তার কণ্ঠরোধ করতে পারেনি। ২০১৪ সালে  শাসকের অবাধ্যতার ফলস্বরূপ কেবল নেটওয়ার্কের তালিকা থেকে বাদ পরে টিভি রেইন। কিন্তু তাও শাসকের সামনে মাথা নোয়ায় নি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। এইবারে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে আবার শাসকের কোপে পড়েছে টিভি রেইন। রাশিয়ান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটির তরফ থেকে জানানো হয়েছে ক্রমাগত রাশিয়া বিরোধী খবর সম্প্রচার, সাধারণ জনগণকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মদত দেওয়ার অভিযোগে এই সংবাদ সংস্থাটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নিষিদ্ধ হওয়ার মুহূর্তে ও শেষ লাইভে ও সিন্দেইয়াভা সহ টিভি রেইনের সমস্ত কর্মী রাশিয়ার এই যুদ্ধের তীব্র নিন্দা করেছেন। একের পর এক সংবাদ মাধ্যম যেভাবে নিষিদ্ধ করছে রুশ প্রশাসন তা নতুন করে পুতিনের ফ্যাসিস্ত চরিত্রকেই জনমানসে তুলে আনছে। আজকের রাশিয়ায় সংবাদমাধ্যমের মুক্ত কণ্ঠই যেখানে বারবার প্রশ্ন চিহ্নের মুখে সেখানে সাধারণ মানুষের বাক স্বাধীনতা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

More Articles