জ্বালানির জ্বালায় এবার নাভিশ্বাস, ভোট আর যুদ্ধের মূল্য দেবে প্রতিটি ভারতীয়?

উত্তর প্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন মিটলেই এক লাফে অনেকটা বাড়তে পারে পেট্রল, ডিজেলে-র দাম, এমনটাই আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। গণনা পর্বের শেষে এবার সেই আশঙ্কাই কি সত্যি হতে চলেছে? একদিকে পেট্রল, ডিজেলে-র ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির সম্ভবনা, অন্যদিকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এলপিজি-র সঙ্কট। সব মিলিয়ে কতটা নাজেহাল অবস্থায় পড়তে হতে পারে সাধারণ মানুষকে?

 গত সেপ্টেম্বর থেকে ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে থমকে ছিল জ্বালানির দাম। এর অন্যতম কারণ ছিল আসন্ন নির্বাচন। কিন্তু এবার এক ধাক্কায় তার মূল্যবৃদ্ধি ঘটার সম্ভবনা দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিককালে আইসিআইসিআই সিকিউরিটিজ যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, আগামী ১১ দিনের মধ্যে লিটার পিছু ১২ টাকা করে দাম বাড়তে পারে পেট্রল ও ডিজেলে-র। তাঁরা এও জানিয়েছেন যে এতদিন জ্বালানির দাম এক জায়গায় থমকে থাকার ফলে খুচরো ব্যবসায়ীরা যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন তা পূরণ করতে গেলে প্রতি লিটারে ১২ টাকার বেশি  মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজন।

গত বছর জুনে দিল্লি-তে পেট্রলের দাম ছিল ৯৭ টাকা ৭৬ পয়সা প্রতি লিটার, ডিজেল ছিল ৮৮ টাকা ৩০ পয়সা প্রতি লিটার। জুলাই-তে পেট্রলে-র দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০১ টাকা ৮৪ পয়সা প্রতি লিটারে, ডিজেল হয় ৮৯ টাকা ৮৭ পয়সা প্রতি লিটার। অগাস্টে ভারতের রাজধানীতে পেট্রলে-র দাম ছিল কিছুটা নিম্নমুখী। কিন্তু ডিজেলে-র ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে প্রায় পাঁচ পয়সা। একই চিত্র দেখা যাচ্ছে ভারতের অন্যান্য মেট্রো শহরগুলিতে। জুনে কলকাতায় পেট্রলে-র দাম ছিল ৯৬ টাকা ৬৩ পয়সা প্রতি লিটার, ডিজেল ছিল ৯১ টাকা ১৫ পয়সা প্রতি লিটার। জুলাই-তে কলকাতায় লিটার পিছু পেট্রলে-র দাম বাড়ে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা, ডিজেলে-র দাম বাড়ে ২ টাকা ১৭ পয়সা। সেপ্টেম্বরে কলকাতায় পেট্রলের দাম কিছুটা কমলেও ডিজেলের  দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর পরেরে মাস থেকেই শুরু হয় ভোটের প্রস্তুতি, ফলত ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে পেট্রল, ডিজেলের দাম এক জায়গায় থমকে যায়।

ইতিমধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব-বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১৩০ ডলারেরও বেশি। গত ১৩ বছরের হিসেবে এ মূল্যবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ বলে মনে করা হচ্ছে।  কিন্তু ভারতবর্ষে নির্বাচনের ফলে এখনও পর্যন্ত তার কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যায় নি। আর সেটাই চিন্তার, কারণ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ভোটের ফল প্রকাশের পর এবার রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে পেট্রল ও ডিজেলে-র। সমস্যায় পড়তে হবে সাধারণ মানুষকে। যদিও তার সঙ্গে সঙ্গে এমনটাও মনে করা হচ্ছে যে তেল কোম্পানিগুলো তেলের দাম এক ধাক্কায় বাড়াবে না। দৈনিক প্রায় পঞ্চাশ পয়সার গড় হিসেবে তা বাড়ানো হবে। বর্তমানে পেট্রল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় বিরোধীদের একাংশ তোপ দাগছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দিকে। এনসিপি-র মুখ্যপাত্র মহেশ তাপাসে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম যখন কম ছিল তখন মোদী সরকার সাধারণ মানুষকে মূল্যবৃদ্ধি থেকে মুক্তি দেয়নি, ফলত এখন তেলের দাম বাড়ানোর কোনোরকম নৈতিক অধিকার তার নেই।

পেট্রল, ডিজেলে-র মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ-পরিস্থিতির ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এলপিজি-র সঙ্কট। প্রায় গোটা ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের অন্যতম উৎস হচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু যুদ্ধের ফলে এই সরবরাহের কাজে নানান ধরনের বাধা-বিপত্তি আসছে। তার উপর জো বাইডেনে-র সরকার রাশিয়া থেকে তেল এবং গ্যাস আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা নামিয়ে এনেছে। রাশিয়া-র অর্থনীতিকে ঘোরতরভাবে ধাক্কা দিতেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে করে অবশ্য ইউ এস এ-র বিশেষ ক্ষতি হবে না, কারণ এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতে তাদের দেশ থেকে অপরিশোধিত তেলের রপ্তানি হয় সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে ইউ এস এ রাশিয়া থেকে মাত্র ১০ শতাংশ অপরিশোধিত তেলের আমদানি করেছে। ফলত দেখা যাচ্ছে অপরিশোধিত তেলের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাশিয়া-র  উপর সমস্তরকম নিষেধাজ্ঞা  নামিয়ে আনার মতো স্বনির্ভরশীলতা ইউএসএ-র রয়েছে। যদিও, বাকি ইউরোপের ক্ষেত্রে এমন নিষেধাজ্ঞার ফল হতে পারে মারাত্মক। গত বছর ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোকে রাশিয়া-র থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে হয়েছে। রাশিয়া-র উপর নিষেধাজ্ঞা নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে তারা বাইডেনে-র সঙ্গে সুর মেলালে তাদের তেল সরবরাহের অন্যতম সূত্র বন্ধ হয়ে যাবে।

সমগ্র পরিস্থিতিতে ভারতও খুব একটা সুবিধেজনক অবস্থানে নেই। বাইরের দেশগুলো থেকে ভারতে-র প্রায় ৮৫ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়। তার মধ্যে রাশিয়া একাই রপ্তানি করে ৮ শতাংশ। মূলত এই কারণেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়া-র সঙ্গে অন্যান্য দেশগুলির কলহের প্রভাব পড়তে পারে ভারতে-র অর্থনীতিতে। আগামী এপ্রিল থেকে ভারতে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে গ্যাসের দাম। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ মনে করছে গ্যাসের দাম ৬.১৩ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ১০ ডলার। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে সঙ্কট দেখা দেবে সাধারণ মানুষের জীবনে। ভারতে যে রান্নার গ্যাস ব্যবহার করা হয় তার দাম যদি হঠাৎ করে বেড়ে যায় তাহলে সমস্যা পড়বেন  অনেকেই।

অতিমারির পর বিশ্ব-অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা  করছিল, কিন্তু বাঁধ সাধল রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক স্তরে কোনোরকম ডামাডোল হলে ভারতের পক্ষে খুব বেশিদিন তার সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলা মুশকিল এবং দিনের শেষে তার সমস্ত প্রভাব এসে পড়বে সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগারে। একে করোনার ভয়, তার উপর মূল্যবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের হিমশিম অবস্থা যেন আর কাটতেই চাইছে না।   

More Articles