রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে ভারত, বামেদের মতই বা কী

উত্তেজনার পারদ চড়ছে ক্রমাগত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি তাহলে সত্যিই দুয়ারে কড়া নাড়ছে? যে চেরনোবিল সাক্ষী ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তার সেই চেরনোবিলকে ঘিরে কি নতুন করে শুরু হতে চলেছে পরমাণু যুদ্ধ? যে মানুষটার কথার তুবড়িতে একদিন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ তার হাতেই এখন ঝুলে রয়েছে সমগ্র ইউক্রেনবাসীর ভাগ্য। কৃষ্ণসাগরের আকাশে এখন যুদ্ধের ঘনঘটা, আর তাতেই ঘুম উড়েছে আপামর বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানিয়েছেন অস্ত্র ছাড়তে তিনি রাজি নন। অর্থাৎ আত্মসমর্পণের আশা যেন ভুলেও না করেন পুতিন। দরকারে দেশের প্রতিটি মানুষ হাতে তুলে নেবে অস্ত্র। জেলেনস্কির পার্টির নাম ছিল ' সার্ভেন্ট অফ দ্যা পিপল।' যে মানুষটা লড়েছেন এমন একটা রাজনৈতিক দলের হয়ে যার নাম  জনগণের চাকর' সেই মানুষটা  দেশের দুঃসময়ে কি একা ছেড়ে যেতে পারেন দেশের মানুষদের? তারপরেও ভয় হয় ইউক্রেনের এই প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত বালির বাঁধের মতো ভেঙে পরবে না তো রাশিয়ার আক্রমণ এর সামনে?

" কেউ পাশে নেই। একাই লড়তে হচ্ছে আমাদের। ইউক্রেন ন্যাটোর অংশ হবে কিনা কাল থেকে আমি অন্তত ২৭ জন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। কেউ উত্তর দেয়নি। সকলে ভয়ে কুঁকড়ে আছে।" - এরকমই বক্তব্য ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান জেলেনস্কির। তাঁর বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে ইউক্রেনকে সাহায্য করতে অপারগ। পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবেই হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন - " এই হয়তো শেষ আমাকে জীবীত দেখছেন।" রাশিয়ার আক্রমণ থেকে নিস্তার পাচ্ছে না ইউক্রেনের হাসপাতাল বাই স্কুল, পুতিনের গোলার লক্ষ্য শিশু-বৃদ্ধ সকলে। পথে-ঘাটে সাক্ষী থাকতে হচ্ছে বিভিন্ন মর্মান্তিক দৃশ্যের। কোথাও প্রিয়জনকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তার কোন নিকটাত্মীয়, কোথাও বা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে ইউক্রেন সেনার দেহ। আবার কোথাও বাবা মাকে হারিয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে একরত্তি শিশু। সে জানেনা আর কোনোদিনও ফিরবে না তার বাবা-মা।

কৃষ্ণ সাগরের আকাশে ঘনিয়ে এসেছে যুদ্ধের কালো মেঘ।" রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়" - সাধারণ ভারতবাসী থেকে বিশ্বের সমস্ত মানুষ আজ চাইছেন যুদ্ধ বন্ধ হোক, পৃথিবীর বুকে বিরাজ করুক অপার শান্তি। সেইসঙ্গে ভারতবাসীর মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বহু প্রশ্ন। ভারতে এই যুদ্ধের কতটা প্রভাব পড়বে? সাধারণ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তকে কতটা মূল্য যোগাতে হবে এই যুদ্ধের কারণে? যুদ্ধ শুরু হতেই ইতিমধ্যে ধ্বস নেমেছে শেয়ারবাজারে। ভারতীয় শেয়ারের পরিমাণ কমেছে তিন শতাংশ। সেন্সেক্স নেমে গেছে ৫৫৪৭৭.৬৭ - এ। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে তেলের দাম। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই আশঙ্কা শুরু করেছেন মুদ্রাস্ফীতির। তাদের আশঙ্কা এর ফলে দামি হতে পারে পেট্রোল ডিজেল থেকে রান্নার গ্যাস অথবা কেরোসিন। না এখানেই শেষ হচ্ছে না ভারতবাসীর দুর্দশার পালা। যুদ্ধের ফলে দাম বাড়তে পারে ভোজ্যতেলেরও। রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয় দেশই সূর্যমুখী তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। অথচ এই দুই দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি বড়োসড়ো প্রশ্নের সম্মুখীন করছে তৈল বাজারকে। যুদ্ধ যতই এগোবে ততই স্থিতাবস্থা বজায় রাখা কঠিন হবে ভোজ্যতেলের বাজারে।

কিন্তু এত কিছুর পরেও ভারত এই যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের স্পষ্ট অবস্থান জানাচ্ছে না কেন? এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার প্রধানমন্ত্রী মোদী পুতিনকে ফোন করে ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে সংযত হওয়ার আবেদন করলেও তার কড়া অবস্থান জানাননি। মানবতা যেখানে প্রশ্নের মুখে সেখানে নয়াদিল্লির এই মনোভাব কি সমগ্র বিশ্বের কাছে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে না? আসলে সমগ্র বিষয়টির ভেতরে রয়েছে একটি জটিল সমীকরণ। আমেরিকা এবং রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই বিপুল অঙ্কের সামরিক চুক্তি রয়েছে মোদি সরকারের।২০১৮ সাল থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে গাঁটছড়া বেঁধেছিল ভারত। সে বছরই প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মিসাইল চুক্তি করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। পরবর্তী সময়ে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলারে। আমেরিকা প্রথম থেকেই ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত, ফলে তাদের সমর্থন করা মানেই রাশিয়ার চক্ষুশূল হওয়া। কারণ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের অন্যতম বড় কারণ এই ন্যাটো জোট। তবে আমেরিকাকে সমর্থন না করেও কিন্তু নিস্তার নেই, কারণ একদিকে যেমন বিপুল অংকের প্রতিরক্ষা চুক্তি চাপে রেখেছে মোদী সরকারকে অন্যদিকে চীন এবং পাকিস্তান উভয়পক্ষের বিরোধিতা করতে গেলে পাশে দরকার আমেরিকার মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রকে। ইতিমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক চুক্তি নিয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্য করেছে আমেরিকা এবং ভারতের। কারণ আমেরিকা চায়নি চিরশত্রু রাশিয়ার হাত ধরুক ভারত। তবে শুধুমাত্র রাশিয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাও মুর্খামির পরিচয় হবে ভারতের জন্য। ইউক্রেন ও রাশিয়াকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্বে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার সুযোগ নিয়ে চিন যদি ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে রাশিয়া কি আদৌ ভারতের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে? এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

শুধুমাত্র সামরিক চুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই ভারতকে নিয়ে এই জটিল সমীকরণটি। আমেরিকাকে চটালে তা ফ্রান্স এবং ইজরায়েলের মতো দেশের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। রাফাল চুক্তি অথবা সামরিক হার্ডওয়ার বা সফটওয়ারের চুক্তির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে ভারতকে। সামগ্রিকভাবে গোটা বিষয়টিতে আমেরিকা আশা করেছিল ভারত তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে, কিন্তু বাস্তবে ভারত অবলম্বন করেছে মধ্যপন্থা। রাশিয়া ভারতের এই স্বাধীন মতামতকে স্বাগত জানিয়েছে।

এ তো গেল বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া এবং ইউক্রেন সংক্রান্ত বিষয়ে ভারত সরকারের অবস্থান। এদেশের কমিউনিস্টরা কী বলছেন? যুদ্ধের নিন্দা করেছেন তারাও কিন্তু রাশিয়ার পক্ষে কথা বলতেও দেরি হয়নি তাদের। তারাও এক প্রকার বলতে চেয়েছেন পশ্চিমা দেশগুলোর অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক মনোভাবই ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

ভারতের এ অবস্থান কতটা প্রশংসার যোগ্য তার উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন হামলার নিন্দা করলেও ভোটাভুটি থেকে বিরত থেকেছে ভারত। ভারতের আজকের অবস্থান কি জো বাইডেনের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ালো? ভবিষ্যতে ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে দূরত্ব কি আরও বাড়বে জো বাইডেন এবং নরেন্দ্র মোদীর? উত্তর পেতে গেলে অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। ততদিন আমরা বরং প্রার্থনা করি যুদ্ধ নয়, পৃথিবীতে নেমে আসুক শান্তি। যুদ্ধবিমান থেকে মারণাস্ত্রের পরিবর্তে ঝরে পড়ুক শত শত গোলাপের পাপড়ি।

More Articles