রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের লাভের গুড়টুকুর দিকে চেয়ে কারা?

গত কয়েকদিন ধরে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রেই ঘোরাফেরা করছে যুদ্ধের সহিংস ছবি। বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণে এক নতুন অধ্যায়ের ঘোষণা নিয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে রুশ সেনা। সামাজিক মাধ্যমগুলিতে পাওয়া যাচ্ছে তার নিত্যনতুন ধ্বংসাবশেষের চিত্র। বিশ্বের নানান দেশ থেকে ইউক্রেনের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানানো হলেও এ যুদ্ধে তাকে সরাসরি সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি কেউই। হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধবিরোধী মিছিল সংগঠিত করছেন রাশিয়া এবং জার্মানির মতো দেশগুলিতে। কথায় বলে 'history repeats itself'। সেই যুক্তিতেই যেন ইতিহাস নিজস্ব জমাপঞ্জি থেকে বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের নানান ঘটনাপ্রবাহ ফিরিয়ে দিচ্ছে তার পরবর্তী শতককে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশ কিছু ঘটনার কার্যকারণ সম্বন্ধে বুঝতে গেলে এই ইতিহাসের দ্বারস্থই হতে হবে আমাদের। 

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করছে হিটলারের সৈন্যরা। শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমগ্র পোল্যান্ড চলে আসছে জার্মানি এবং রাশিয়ার দখলে। এরপর হিটলার পরবর্তী ধাপের প্রস্তুতি পর্বের কথা মাথায় রেখে যুদ্ধে খানিক বিরতি দিচ্ছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলি পাঁচমাস ব্যাপী এই যুদ্ধবিরতি পর্বের নাম দেয় 'ফোনি ওয়ার' বা ছদ্ম যুদ্ধ। চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে অক্ষ আর মিত্র শক্তির অন্তর্বর্তী ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। অক্ষ শক্তির মধ্যবর্তী দেশগুলি ছিল জার্মানি, ইতালি এবং জাপান। মিত্রশক্তিতে ছিল রাশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন এবং ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা (ইউ এস এ)। অক্ষশক্তি এ যুদ্ধে নানাভাবে নিজেদের জয় সুনিশ্চিত করার পথেই হাঁটছিল, কিন্তু বিভিন্ন দিক থেকে তাদের উপর চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৪১ সালে 'অপারেশন বারবারোসা'য় রাশিয়ার কাছে হিটলার বড়সড় ধাক্কা খান। কম্যুনিজমের প্রতি তীব্র ঘৃণা হিটলারের ছিলই। এ ছাড়াও তাঁর ভয় ছিল যে কোনও মুহূর্তে রাশিয়া জার্মানি আক্রমণ করতে পারে।  এত কিছু ভেবেই হিটলার রাশিয়া দখলে অগ্রসর হন, কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতি। রাশিয়ার প্রচন্ড শীতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ব্যবস্থাপনা জার্মান সৈন্যদের ছিল না। অতএব রাশিয়া দখলের সুখ স্বপ্ন তাঁকে জলাঞ্জলি দিতে হয়।

'অপারেশন বারবারোসা' শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই পার্লহারবার আক্রমণ করে জাপানি বিমানবাহিনী, যার ফলে যুদ্ধের অন্যতম শরিক হয়ে ওঠে মার্কিন দেশ। কালক্রমে মিত্র শক্তির হাতে অক্ষ শক্তির পরাজয়ের পালা আরম্ভ হয়। ১৯৪৩ সালে ইংরেজ এবং মার্কিন সৈন্যরা সমবেতভাবে সিসিলি দখল করে। এর ফলে ইতালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক বেনিটো মুসোলিনির পতন ঘটে। এরপর জার্মানির দখল নেয় স্তালিনের লালসৈন্য। সেখানকার চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার শিয়রে সঙ্কট দেখে বাঙ্কারের ভেতর আত্মহত্যা করেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর যুদ্ধ শেষ হয় বটে, কিন্তু নিজের বিভীষিকার ছাপ রেখে যায় সর্বত্র। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে মার্কিন সৈন্যরা এটম বোমা নিক্ষেপ করে, যার দরুন মৃত্যু হয় এক লক্ষ চব্বিশ হাজারেরও বেশি মানুষের। নর্মান লো'র মতো ইতিহাসবিদরা এ ঘটনা কে সমগ্র বিশ্বযুদ্ধের সর্বাধিক বিতর্কিত ঘটনা বলে মনে করছেন। কিন্তু লো সাহেবের থেকে এক ধাপ এগিয়ে একে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ঘটনার আখ্যা দেওয়া চলে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জঠর থেকে জন্ম নেয় ঠাণ্ডাযুদ্ধ। মার্ক্স লিখেছিলেন 'ইউরোপ কমুনিজমের ভূত দেখছে'। এ ক্ষেত্রেও যেন কমুনিজমের সেই spectre বা ভূতের প্রতি খানিকটা ভীতি থেকেই  ইউরোপ এবং আমেরিকার বেশ কিছু দেশ এককাট্টা হয়ে উঠল। ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং লুক্সেমবুর্গের উদ্যোগে ব্রাসেলস চুক্তি আগেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এবার তাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হল ইউ এস এ, ক্যানাডা, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, আয়ের, ইতালি এবং নরওয়ের মতো দেশ। তৈরি হল 'নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গ্যানাইজেশন' বা ন্যাটো। স্তালিনের নেতৃত্বে রাশিয়া এ সময় বিশ্ব রাজনীতিতে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে তার সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হল মাও সে তুঙের চিন। স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশচেভের মতো নেতারা আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে কিছুটা উদ্যোগী হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা যায় সে গুড়ে বালি। ১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবা প্রত্যক্ষভাবে ঠাণ্ডা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। 'কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসে'র মধ্যে দিয়ে রাশিয়া এবং আমেরিকার জটিলতা তুঙ্গে পৌঁছয়। যদিও কেউই সম্মুখ সমরে নামে না। এর অন্যতম কারণ ছিল হিরোশিমা এবং নাগাসাকির আক্রমণ পরবর্তী নিউক্লিয়ার থ্রেট।

অ্যাটম বোমার পর আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় হাইড্রোজেন বোমা বানানোর। ১৯৫৭ সালে রাশিয়া প্রস্তুত করে এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্রখানা, যার নাম 'ইন্টার - কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল'। এই নিউক্লিয়ার অস্ত্রের এতটাই তেজ ছিল যে রাশিয়ার ভেতর থেকে নিক্ষেপ করলেও তা প্রায় গোটা ইউ এস এ'কে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। অবশ্য আমেরিকাও থেমে ছিল না। চটজলদি তারা ' অ্যাটলাস' নাম দিয়ে রাশিয়ান মিসাইলের এক বিকল্প তৈরি করে। নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা ভেবে ১৯৫৮ সালে শয় শয় মানুষ 'ক্যাম্পেন ফর নিউক্লিয়ার ডিসার্মমেন্টে' অংশগ্রহণ করেন। 

একবিংশ শতাব্দীতেও নানান সময় নিউক্লিয়ার ভীতির মুখোমুখি হতে হয়েছে গোটা বিশ্বকে। বস্তুত, আজকে বিশ্ব রাজনীতি দাঁড়িয়েই আছে এই নিউক্লিয়ার ভীতির উপর। কিন্তু রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন এই ভীতিকেই খানিকটা দ্রুততার সঙ্গে উস্কে দিল। গত রবিবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিউক্লিয়ার অস্ত্রের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের নির্দেশ দেন বিশেভাবে সতর্ক থাকার। পুতিনের নির্দেশের ফলে দেখা দিচ্ছে নানান সম্ভবনা, অনেকেই মনে করছেন এই বার্তার মধ্যে দিয়ে আসলে ভয়কে জিইয়ে রাখতে চাইছেন পুতিন। বার্তা দিতে চাইছেন গোটা বিশ্বকে। তাঁর আগ্রাসনকে প্রকাশ্যে নিন্দাবাদ জানিয়েছেন বোরিস জনসন, ইম্যানুয়েল ম্যাক্রো, এবং জো বাইডেনের মতো রাষ্ট্রনেতারা। নৈতিকভাবে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে রাশিয়াকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ন্যাটো। রাশিয়ার উপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা নামিয়ে এনেছে আমেরিকা। যদিও, মৌখিকভাবে ইউক্রেনকে বিপুল সহমর্মিতা দেখালেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধেক্ষেত্রে তার পাশে এসে দাঁড়ানোর কোনোরকম উদ্যোগ দেখায়নি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এই দেশ। প্রধানত সেই কারণেই ইউক্রেনের প্রতি আমেরিকার  সহমর্মিতার স্বচ্ছতা নিয়ে খানিক প্রশ্ন থেকে যায়।

কোভিডের পর পরিবর্তন এসেছে বিশ্বের বাণিজ্যিক সমীকরণে।  রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে আরও বেশি করে উস্কে দিয়ে,  সর্বোতভাবে সেই পরিস্থিতির বাণিজ্যিক ফায়দাটুকুই কি নিতে চাইছে আমেরিকা? নইলে এত তর্জনগর্জন করেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা আস্ফালনে এত অনীহা কেন তাদের?

পরিস্থিতি যত জটিল হচ্ছে ততই বেড়ে চলেছে অমীমাংসিত প্রশ্নের ভিড়। অনেকেই মনে করেছিলেন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্যে দিয়েই বোধহয় সূত্রপাত ঘটল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। কিন্তু এ সম্ভবনাকে একদল নস্যাৎ করে দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার ঠাণ্ডাযুদ্ধের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করছেন। তবে ইতিহাস ঠিক কোন বিচিত্র বাঁকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, তার উত্তর লুকিয়ে আছে কেবলমাত্র কালের গর্ভে। 

More Articles