আমগাছ

বিকেলের দিঘিতে মুড়ি ভাজার চাল ধোয়া হচ্ছে।  এই চাল তেতে ওঠা মাটির খোলায় পড়লেই চড়বড় করে সাদা সাদা ফুলের মতো  ফুটে ওঠে মুড়ি হয়ে। জলের ধারে বসে এসব দেখলে নিজেকে মনে হয় চোতক্ষ্যাপা। রাঢ় বাংলায় চৈত্রমাসের রোদ গতরে লাগলে মানুষ বেভুল ছবি দ্যাখে চোখের সামনে, উদাস লাগে।

কিন্তু এই আশ্বিন মাসের নীল সন্ধ্যায় বসে বসে মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার সমস্ত উদাস বাতাস আমায় পাগল করে তুলেছে। হাতের মুঠোয় যেন কাঁটা কাঁটা বিষধুতুরোর ফল নিয়ে পথ চলছি।

শান বাঁধানো ঘাট থেকে উঠে কাদামাখা গোরুগাড়ি চলার পথ ধরে হাঁটছি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। একমুঠো চিঁড়ে গামছায় বাঁধা থাকলে বেশ হতো, চলতে চলতে মুখে দিলে মজা হয় বেশ।কাঁচা গুয়ের গন্ধ, গোবর চোনায় এই মেহগনি বাগানখানা থম থম করছে।পঞ্চায়েত থেকে পায়খানা দিয়েছে। চার দেওয়ালের ভিতর। তাও শালোদের হাগা হবে নাকো! পোঙায় দুব্বো ঘাসের সুড়সুড়ি লাগা চাই!

জলে ঢেউ লেগে জলখানা কেমন কাঁপছে থিরথির। ঝরাপাতা উড়ে গেল। সন্ধের দিকপানে কেমন অবশ সব, হাতের তালু দেখা যায়নাকো!

একটা দাঁড়াশ সুরসুর করে গাছপাতাবন পেরিয়ে ইঁদুর আশায় পালাচ্ছে এদিক ওদিক।

এমন এক-একটা ক্ষণে নিজেকে মনে হয় পিঠে নুনের বস্তা চাপানো মুখ মাটিতে ঠেকে যাওয়া উট। পেয়ারাগাছের ডালপালায় লেগে থাকা আঁধার ছাড়া আর কিছু যেন সত্যি নয় কো।

এমন এক নিকষ মনে খালি হাতে তখন দিকবিদিক চষে ফেললে, বৈকাল থেকে সন্ধে যাদের ভালোবাসি সেই গাছেদের পায়ের কাছে বসে সময় কাটালে বাওরের হাওয়া এসে লাগে অন্ধকার মনে।

দিন ফুরিয়ে রাত হওয়াকে এত আশ্চর্য মনে হয়, আকাশের গায়ে গায়ে গলিত সোনার দোকান বসানো,ক্ষমার বুক থেকে জন্ম নিয়েছে কাশবন,ধানখেতগুলি বুক দিয়ে আগলে রেখেছে জল। এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি তারা ফুটছে আকাশে।

রাতের বেলার নিচে দাঁড়িয়ে এক দামড়া পাল খাওয়াচ্ছে। গোরুর পোঁদে তুলে দিচ্ছে ষাঁড়কে।

ষাঁড়ের অন্ধকার শিঙে রহস্য পেঁচিয়ে উঠেছে। গায়ের ঘায়ে কিলবিল করছে পোকা। গোরু পরম মমতায় ভয় ও যুগপৎ মায়ায় গ্রহণ করছে পাকা বাঁশের মতো লিঙ্গ।

ষাঁড়ের মাথায় বরমকুট গোরুর শিংয়ে শোলার কনেমকুট চাপিয়ে দিলে বেশ হত। দু’ছড়া নীলকন্ঠ ফুলের মালা। ওই মালিক লোকটাকে ন্যাংটো করে পানসুপুরি খাইয়ে লুঙ্গি পরিয়ে ঘটক বানাতাম। ভোজের দিন দিঘিজলে জালফেলে কাতলার মাথার ঘিলু ঘিলু সুড়ুৎ সুড়ুৎ। হাতে গড়া চিনি মণ্ডা।

এক নাগাড়ে এসব ভাবলেই চিড়িক দিয়ে ওঠে মাথায়। বুকের কলমখানা দিয়ে দিই এই বনতুলসী ঝোপটাকে। এই রোগা বুকের আমগাছখানা ভারি পছন্দ আমার। দাঁড়াশ সাপটা কি আমার কানের ফুটো দিয়ে ঢুকে দু'পায়ের ভিতর চমকে গিয়ে স্থির হল!

এই আমগাছখানা আমার বউ। কই গো মাথাটা ধরেছে একটু চা দাও দিকিনি। কেমন সরু সরু  শাঁখা-পলার মতো ডালপালা। কই গো কোল দাও! আমার শাদা হাড় তোমার তলায় ক্ষয় হোক। রোদবৃষ্টি  লাগুক। পাকা ফলের মতো পচুক। একটা হাড় মণ্ডলবাড়ির ইঁদুর নিতে এলে তুমি নিতে দিও। ওর গর্তে রাখবে ও। আমার শৈশবের দাঁতও ওখানে রাখা কুড়ানো ধানের সঙ্গে।

বউ গো আমার খোয়াব আসছে। আমার চোখমুখ ভিজে যাচ্ছে গো গোরুর নীলাভ দুধে।

আমার গতরের আশেপাশে পলছাতার জন্ম নিচ্ছে, তুমি তাদের মা গো আমগাছ, আমি হলাম গিয়ে বাবা।

More Articles