দশ বিষয়ে স্নাতকোত্তর! চমকে দেবে ভারতের সর্বজ্ঞানী শ্রীকান্তের যাত্রাপথ

যেখানে  একটা বিষয় নিয়ে পড়তে গিয়েই সাধারণ ছাত্ররা হিমশিম সেখানে এমন অনবদ্য কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে শ্রীকান্ত নিজের নাম তুলে ফেলেছেন ভারতের রেকর্ড বুক 'লিমকা বুক অফ রেকর্ড'সের পাতায়।

এই ছোট্ট এক জীবনে আপনি কী কী করতে পারবেন? শিক্ষার দিক থেকে দেখতে গেলে অনেকেই প্রধান ৪ টে অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি থাকেই। কালেভদ্রে জোটে সরকারি চাকরি। আর সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্যে বরাদ্দ হয় বেসরকারি চাকরি। মোদ্দা কথা হল, যদি আমআদমি হন কোথাও না কোথাও গিয়ে আপনার এই পাঠের চক্র একদিন সাঙ্গ হবেই, হয়তো থেকে যাবে শখের পড়া। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। এমনই এক ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন শ্রীকান্ত জিচকার, আভিধানিকরা নিশ্চয়ই নিঃসংশয় হয়ে তাঁকে সর্বজ্ঞানী বলবেন।

শ্রীকান্ত জিচকারের নাম এখনও অনেক মানুষের কাছে বিশেষ পরিচিতি পায়নি। কিন্তু ভারতে যদি কোনও সত্যিকারের জ্ঞানপিপাসু মানুষের তালিকা করা হয় তাহলে আক্ষরিক অর্থে তাঁর নাম উঠে আসবেই। কী নেই তার বিদ্যার ঝুলিতে। ভারতীয় এই নাগরিকের জ্ঞান চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ব্যবসা, প্রশাসন, সাংবাদিকতা ইত্যাদি নানান বিষয়ে। তার ঝোলায় ভরা আছে ৪২ টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রাপ্ত ২০ টি ডিগ্রি আবার তার মধ্যে ১১ টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। যেখানে  একটা বিষয় নিয়ে পড়তে গিয়েই সাধারণ ছাত্ররা হিমশিম সেখানে এমন অনবদ্য কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে শ্রীকান্ত নিজের নাম তুলে ফেলেছেন ভারতের রেকর্ড বুক 'লিমকা বুক অফ রেকর্ড'সের পাতায়। তার দীর্ঘ ৪৯ বছরের জীবনে তিনি ছিলেন আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা, অভিনেতা, চিত্রকর এবং সেই সঙ্গে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ এম. এল. এ.।

ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের নাগপুর জেলার কাটোলের আজামগাঁও গ্রামে মারাঠি পরিবারে ১৯৫৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকান্ত জাচকার। ছোটবেলা থেকেই কৌতূহলী মন তার, আগ্রহ ছিল ছবি আঁকায়, আর ভালবাসতেন ফুটবল, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞান।

শ্রীকান্তের পড়াশোনার বহরে চোখ বোলালে চমকে যেতে হবে। তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরুটা হয়েছিল ডাক্তারি পড়া দিয়ে। এম.বি.বি.এস. করার পর মেডিসিনের ওপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করলেন। বাড়ির লোকেরা ভাবল এবার ছেলে ডাক্তারিতে মন দেবে। কিন্তু কোথায় কী! শ্রীকান্ত এরপর এল. এল. বি. পড়া শুরু করে দিলেন। সেইসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ল'র ওপর স্নাতকোত্তর করলেন। কিন্তু এইসব করেও তার মন ভরেনি। অন্য কিছু করার ইচ্ছায় হাত পাকাতে চাইলেন ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে। শুরু করলেন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এর ওপর ডিপ্লোমা। তারপর এম. বি. এ. ডিগ্রিও স্থান পেল তার ঝোলায়। এরপর শুরু করলেন তার ছোটবেলার প্রিয় বিষয় সাংবাদিকতা নিয়ে। তাতেও স্নাতক করলেন।

এতটুকু পড়ার পরে যদি আপনি মনে করেন শ্রীকান্ত আর কোনও কাণ্ড করেনি তাহলে সেটা আপনার ভুল ধারণা। এরপর তিনি মোট ১০ টি বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। স্নাতকোত্তর এর তালিকাটা একবার চোখ বুলিয়ে নিন -

১. পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন
২. সোশিওলজি
৩. অর্থনীতি
৪. সংস্কৃত (ডি. লিট)
৫. ইতিহাস
৬. ইংরেজি
৭. দর্শন
৮. রাষ্ট্রবিজ্ঞান
৯. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব
১০. সাইকোলজি


উপরোক্ত সবকয়টি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল আকাশচুম্বী। এইসব বিষয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীর সঙ্গে স্নাতকোত্তর। ২৮ টি স্বর্ণপদক পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত গরম নয়তো শীতকালে কোনও না কোনও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে গেছেন। সবসময় যে উত্তীর্ণ হয়েছেন এমনও নয়। তবে হাল ছাড়েননি। এমন সময় এত পড়াশোনার একঘেয়েমি কাটাতে আমি আপনি বাইরে কোথাও চেঞ্জে যাই কিন্তু শ্রীকান্ত বসলেন আই. পি. এস. পরীক্ষায়। আর সেটা পাশও করলেন। ১৯৭৮ সালের কথা এটা। কিন্তু সেই চাকরিও তার পোষালো না, ছেড়ে দিলেন। শুরু করলেন আই. এ. এস. হওয়ার লড়াই। ১৯৮০ সালে তা হয়েও গেলেন। আবার চাকরির ৪ মাসের মধ্যে আই. এ. এস. পদ ছেড়ে দিলেন। এবার তার ইচ্ছে হয়েছে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে লড়বেন। ১৯৮০ সালেই সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তখন তার বয়স ২৫। এরপর জেলার হয়ে অনেক কাজ করেছেন কিন্তু তাতেও তার মন শান্ত হয়নি। জেদ ধরলেন মন্ত্রী হবেন। ১৯৯২ সালে দুটো দফতর নয় মোট ১৪ টি দফতরের মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন শ্রীকান্ত জাচকার।

এই তো গেল তার শিক্ষা জীবনের কথা। তার আরো বহু গুণ ছিল তার মধ্যে রয়েছে - তিনি অসাধারণ ছবি আঁকতে পারতেন। সেই সঙ্গে ছিলেন মঞ্চাভিনেতা, শখের বেতার চালক এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন তিনি। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ এবং ইউনেস্কোতে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেছেন তিনি। ২০০৪ সালে এক পথ দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়।

দেবী সরস্বতী যেন তাঁর এই বরপুত্রকে দু'হাত ভরে দিয়েই গেছেন। তার জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অপরিমিত। তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে প্রায় ৫২ হাজার বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। ১৯৮৩ সালে বিশ্বের সেরা ১০ উদ্যমী তরুণের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। অনেকের মতে, শ্রীকান্তের কৃতিত্ব শুধু ভারতে নয় বিশ্ব মঞ্চেও অদ্বিতীয়। মাত্র ৪৯ বছর বেঁচে থেকে তিনি ভারতকে যে অমূল্য উপহার দিয়ে গেছেন তার প্রতিদান দেওয়া অসম্ভব।  একাগ্রতা, আত্মবিশ্বাস দিয়ে যে কোনও অসাধ্যসাধন করা যায় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন শ্রীকান্ত। অনুপ্রেরণা শব্দটি তাঁর নামের পাশে ব্যবহার হবে না কেন!

More Articles