গাছের প্রাণ থেকে ছুটি বা কাবুলিওয়ালা, বিশ্বের দরবারে নিবেদন নিবেদিতার

সাক্ষর সেনগুপ্ত: তাঁর আশ্চর্য সুন্দর লেখনী আন্তর্জাতিক স্তরে বৈজ্ঞানিক মহলে পৌঁছে দিয়েছিল সেই অপার বিস্ময়ের তথ্য, গাছেরও প্রাণ আছে। গীতাঞ্জলি পর্বের অনেক আগেই কবির তিনটি ছোট গল্প ইংরাজি ভাষার পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত হয়েছিল তারই হাতের ছোঁয়ায়। উদ্ভিদের প্রাণ বিষয়ক বিজ্ঞানীর লেখা প্রবন্ধ অবশ্য আগে পাঠানো হয়েছিল রয়াল সোসাইটির পত্রিকায়। কিন্তু রহস্যময় কারণে সে লেখাটি প্রকাশিত হয়নি। ১৯০২ সালের ১ মে বন্ধুবর কবিকে একটি চিঠিতে বিজ্ঞানী লেখেন, ".....এই যে Royal Society-তে গত বৎসর মে মাসে Plant Response সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম তাহা Waller and B. Sanderson চক্রান্ত করিয়া Publication বন্ধ করিয়া দিলেন।" এর পরেই জগদীশচন্দ্র সিদ্ধান্ত নেন বিদেশি পত্র-পত্রিকার মুখাপেক্ষী না থেকে নিজের গবেষণা বইয়ের আকারে তিনি নিজেই প্রকাশ করবেন। আর এই পরিকল্পনা থেকেই শুরু হয় Response in the Living and Non living -এর কাজ।

গাছের প্রাণ থেকে ছুটি বা কাবুলিওয়ালা, বিশ্বের দরবারে নিবেদন নিবেদিতার

চিত্রঋণ : Google

পরিকল্পনা তো নিলেন, কিন্ত নানা গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চার অন্যান্য কাজে ব্যস্ত বিজ্ঞানীর জন্য গ্রন্থের সম্পাদনা ও পরিমার্জনার কাজটি কে করবেন? যাবতীয় দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নিজের কাঁধে তুলে নেন মার্গারেট নোবেল। এদেশে অবশ্য ততদিনে তিনি বিশিষ্ট জনেদের মধ্যে যথেষ্ট পরিচিত ভগিনী নিবেদিতা নামে। বিজ্ঞানীর ওই বই প্রকাশের পাশাপাশি তাঁর গবেষণার যন্ত্রপাতি কেনা আর লেখার কাজে সহায়তা করার জন্য নিবেদিতার জীবনযাপনের সমস্ত অর্থের যোগান দিয়েছিলেন সারা বুল। এক ধনী মার্কিন পরিবারের কন্যা মিসেস বুল অবশ্য বিজ্ঞানীর কাাজে অর্থ সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিবেদিতারই অনুরোধে। আমেরিকান এই ভদ্রমহিলাই সেই সময় জগদীশচন্দ্রের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজের ব্যবস্থা করা আবার গবেষণার কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের আয়োজনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। দুই তরফের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য অনুঘটক হিসাবে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি যে বিজ্ঞানীর দ্বিতীয় গ্রন্থ Plant Response as a means of Physiological Investigation -এর কাজ শুরুর সময় সারা বুল নিজেই জগদীশচন্দ্রকে অনুরোধ করেন যে নিবেদিতাকে যেন লিটারারি এগজিকিউটর হিসাবে নিয়োগ করা হয়। ১৯০৫ সালের ১২ জুন বিজ্ঞানীকে একটি চিঠি লেখেন মিসেস বুল, বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীদের কাছে যিনি পরিচিত ছিলেন ধীরামাতা নামে। ওই চিঠিতে তিনি বিজ্ঞানীকে জানান, নিবেদিতা যতই ত্যাগ ও সেবার কাজে আগ্রহী হোন না কেন তাঁর জন্য একটা আর্থিক সংস্থানও থাকা প্রয়োজন।

জগদীশচন্দ্রের ওই গ্রন্থ রচনার কাজে নিবেদিতা কতটা ব্যাস্ত থাকতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর চিঠিপত্রেই। ১৯০৫ সালের ২২ নভেম্বর বন্ধু জোসেফিন ম্যাকলিয়ডকে নিবেদিতা লিখছেন, " We are gradually finishing the gigantic labour of Brain"s book on Botany. We are now working over the conclusion and will hope by his birthday on the 30th to have put in the inevitable extra discoveries and even the Introduction." Brain, হ্যাঁ এই নামে বিজ্ঞানীকে ডাকতেন মার্গরেট নোবেল। কিভাবে এগিয়েছিল বই লেখার কাজ ? নিবেদিতার জীবনীকার লিজেল রেঁম জানিয়েছেন, জগদীশচন্দ্র তাঁর মনের ভাবগুলির খসড়া একটি কাগজে লিখে রেখে যেতেন। আর পরদিন এসে দেখতেন সেগুলি যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। আবার লেখার বিষয়ে তর্কাতর্কিও হত দুজনের মধ্যে। রেঁমর লেখায় আছে ছুটিতে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ অধুনা উত্তরাখণ্ডের মায়াবতীতে গিয়ে শুরু হয় লেখালেখির কাজ। নিবেদিতা চান ভাব আর ভাষার সামঞ্জস্য। কিন্তু বিজ্ঞানী অনেক ক্ষেত্রেই তা বুঝে উঠতে পারেন না। ক্ষুব্ধ জগদীশচন্দ্র বলছেন, "যে অধ্যায়টি লিখেছেন ওটা ছিঁড়ে ফেলব আমি। আমার ভাবনার ধারা ওইরকম নয়।" আর নিবেদিতার জবাব, "সেটা যদি কর তো আমি চললাম। আমি কেবল তোমার চিন্তাগুলি যথা সম্ভব সহজ কথায় বিবৃত করেছি। আর কথাকেই তোমার ভয়।" দুজনের মেজাজ দেখে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন বসুজায়া অবলা দেবী। তাঁদের ঠাণ্ডা করার জন্য নিয়ে আসা হয় চায়ের পেয়ালা। এই গ্রন্থ পরিমার্জনা আর সম্পাদনার কাজ নীরবেই করতে চেয়েছিলেন নিবেদিতা। এজন্য জোসেফিনকে লেখা সেই ২২ নভেম্বরের চিঠিতেই তিনি জানিয়েছিলেন, কোথাও যেন ঘুণাক্ষরে একথা প্রকাশ না পায় যে তিনি বিজ্ঞানীর গ্রন্থের কাজের সঙ্গে যুক্ত। একই কথা তিনি জগদীশচন্দ্রকেও বলেছিলেন। জানালেন নিবেদিতার জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত।

শুধু বিজ্ঞানীই নয় অসাধারণ এই ব্যক্তিত্বময়ীর সহযোগিতা কবিও পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পগুলি অনুবাদ করিয়ে পাশ্চাত্যের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটা উদ্যোগ জগদীশচন্দ্র নিয়েছিলেন। ১৯০০ সালের ২ নভেম্বর বিদেশ থেকে লেখা চিঠিতে বিজ্ঞানী তাঁর প্রিয় কবিকে জানাচ্ছেন. "তোমার গল্পগুলি আমি এদেশে প্রকাশ করিব। লোকে তাহা হইলে কতক বুঝিতে পারিবে। আর ভাবিয়া দেখিও, তুমি সার্ব্বভৌমিক।" কাবুলিওয়ালা, ছুটি আর দেনাপাওনা এই তিনটি গল্প অনুবাদের জন্য বেছে নেন জগদীশচন্দ্র। আর এবারেও তাঁদের এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে কে পাশে থাকবেন ? যথারীতি ভগিনী নিবেদিতা। ওই ১৯০০ সালের ২৯ নভেম্বর সারা বুলকে লেখা চিঠিতে নিবেদিতা জানান, The "Cabuliwalah", and "Leave of Absence" are both Englished now, and I have "Giving and, Giving in Return" ready for the last finish. কেমন হয়েছিল সেই অনুবাদ? গল্পগুলি প্রকাশিত হওয়ার পর বিজ্ঞানী তাঁর কবি বন্ধুকে লিখছেন, "তোমার লেখা তরজমা করিয়া এদেশীয় বন্ধুদিগকে শুনাইয়া থাকি, তাঁহারা অশ্রু সম্বরণ করিতে পারেন না।" হয়তো সেজন্যই তাঁর মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণে জগদীশচন্দ্র বলেথিলেন, "দধীচির মত আত্মবলিদান, উমার মত তপস্যা, যা পুরাণে বা কাব্যে বর্ণনা শুনেছি-- তাঁর জীবনে প্রত্যক্ষ করেছি। ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভারতবর্ষের কল্যাণের জন্য তিনি সর্বতোভাবে নিজেকে নিবেদন করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সঠিক নামকরণ করেছিলেন ---নিবেদিতা।" শুধু মুখের কথা নয়, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে যেন অন্তরের আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন বিজ্ঞানী। জগদীশচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রবেশপথেই রয়েছে জপমালা হাতে এক নারীর রিলিফ মূর্তি। বলে না দিলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না -- সে নারী নিবেদিতাই। আর বিজ্ঞান মন্দিরের ফোয়ারাটির নীচে রাখা রয়েছে তাঁর চিতাভস্ম, বিজ্ঞানীর কাছে যে ব্যক্তিত্বময়ী যেন আত্মবলিদানের প্রতীক।

তথ্যসূত্র- জ্বলিছে ধ্রুবতারা - রন্তিদেব সেনগুপ্ত , নিবেদিতা লোকমাতা -শঙ্করীপ্রসাদ বসু, নিবেদিতা-- ঃলিজেল রেমঁ ( অনুবাদ - নারায়ণী দেবী)

 

More Articles