টেস্টটিউব বেবির জন্মে বিপ্লব! অপমানে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল এই বাঙালি ডাক্তারকে

কাহিনিটা এমন এক ভিন্ন ধারার যুগান্তকারী ডাক্তারকে নিয়ে যিনি ভারতের মেডিসিনাল বায়োলজির জগৎটাকেই পাল্টে ফেলতে চেয়েছিলেন। ভারতের ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা সোজা কথায় টেস্ট টিউব বেবি পদ্ধতির জনক বলা চলে এই বাঙালি ডাক্তারকে। সন্তানহীনতার প্রসঙ্গে 'বন্ধ্যা' শব্দটিকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভারতে বিজ্ঞানের সবথেকে অবহেলিত শাখাকে অগ্রগতির দিশা দেখিয়েছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী। সত্তরের দশকের সামাজিক ট্যাবুকে চ্যালেঞ্জ করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এই ডাক্তার তথা বিজ্ঞানী। বিশ্বের জীববিদ্যার গবেষণার ক্ষেত্রে এই বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম চিরস্মরণীয়। তাইতো ২০০০ সালে প্রকাশিত ডিকশনারি অফ মেডিকেল বায়োগ্রাফিতে নিজের যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য রোনাল্ড রস এবং উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে এক আসনে বসেছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী। জীবনকালে নিজের আবিষ্কারের জন্য তাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হলেও, বর্তমানে তার সেই আবিষ্কারই উচ্চস্বরে গর্বিত কন্ঠে ঘোষণা করে ১৯ জুন তারিখটি শুধুমাত্র বাংলার এই কৃতী সন্তানের মৃত্যুদিন না, আমাদের পাপস্বীকারেরও দিন।

৬ আগস্ট ১৯৮৬, আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত প্রবেশ করল এমন একটা তালিকায় যেখানে এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র স্থান পেত পশ্চিমের প্রথম বিশ্বের দেশ গুলি। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে জন্ম নিল প্রথম টেস্টটিউব বেবি বা সঠিকভাবে বলতে গেলে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন এর মাধ্যমে তৈরি ভারতের প্রথম সন্তান, হর্ষ শাহ। জয়জয়কার হতে শুরু করলো এই সন্তানের নির্মাতা ডঃ আনন্দ কুমার এর। গাইনোকোলজিস্ট ইন্দিরা হিন্দুজার সঙ্গে মিলে তারা দুজনে তৈরি করলেন ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। এই ঘটনার ১১ বছর পরে, ডঃ আনন্দ কুমার বুঝতে পারলেন ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি তৈরি করার যে তকমা তিনি এতদিন পর্যন্ত বহন করে আসছেন, আসলে সেটা তার না। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে আধুনিক পদ্ধতিতে একটি টেস্টটিউব বেবি তৈরি করে ফেলেছিলেন এই বাঙালি গাইনোকোলজিস্ট সার্জেন। 

বিভিন্ন সাইন্স ম্যাগাজিন এবং সাইন্স কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত হওয়া নানা ধরনের লেখাপত্র পড়ে আনন্দ কুমার বুঝতে পারলেন হর্ষর আগেই ভারতে আগমন ঘটেছে একটি টেস্টটিউব বেবির। সাইন্স কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত হওয়া বেশ কিছু পুরনো তথ্য ঘাটাঘাটি করে আনন্দ কুমার সেই বাঙালি ডাক্তারের নিজের হাতে লেখা বেশ কিছু নথিপত্র খুঁজে পেলেন। ক্রস চেকিং করার পরে আনন্দ কুমার নিশ্চিত হলেন ১৯৭৮ সালের অক্টোবরের ৩ তারিখে জন্ম নেওয়া কানুপ্রিয়া আগারওয়াল, ওরফে দুর্গা ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি এবং তার জন্ম কলকাতায়। আর যে বাঙালি ডাক্তার তাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন তার নাম ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। 

তালিকা হিসেবে দেখতে গেলে দুর্গা হলো সারা পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবি। ইংল্যান্ডে যখন ১৯৭৮ সালে মেরি লুইস ব্রাউন এর জন্ম হলো, ঠিক তার ৬৭ দিনের মাথায় কলকাতায় জন্ম নিয়েছিল দুর্গা। কিন্তু শুধুমাত্র ৭০ এর দশকের পিছিয়ে পড়া ভারতীয় চিন্তা ধারা এবং তদানীন্তন রাজ্য সরকারের কূটনীতির চাপে পড়ে ভারতীয় মেডিকেল ইতিহাসের পাতায় কোথাও একটা হারিয়ে গেলেন কলকাতার এই পাথ ব্রেকিং ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভারতের অগ্রগতিশীল এবং আবিষ্কারপ্রেমী বিজ্ঞান মঞ্চ তাকে কোনোরকম সম্মানটুকু প্রদর্শন করল না। হয়তো তিনি বাঙালি বলে, অন্য কোন রাজ্যের হলে হয়তো তার নামটা ভারতরত্নের জন্য মনোনীত হত। 

তবে ডঃ আনন্দ কুমার ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তার যোগ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবার চেষ্টায় লেগে পড়লেন। ১৯৯৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, ভারতের রেপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজির উপরে গড়ে তোলা ভারতের তৃতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশনে ভাষণ রাখতে গিয়ে ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর আবিষ্কারকে সকলের সামনে নিয়ে এলেন ডঃ আনন্দ কুমার। তিনি নিজেই আরজি রাখলেন যেন, ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই আবিষ্কারকে সম্মান দেওয়া হয়। এমনকি দু'মাস পরে তিনি একটি সায়েন্স জার্নালে একটি আর্টিকেল লিখলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনী এবং তার কাজকর্মের ব্যাপারে। এরপরে নড়েচড়ে বসল ভারতের বিজ্ঞান এবং মেডিকেল কমিউনিটি। ২০০২ সালে এই বাঙালি বিজ্ঞানী সঠিক সম্মান পেলেন নিজের কাজের। ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি নির্মাতা হিসেবে অঙ্কিত হলো ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর নাম।

১৯৩১ সালের ১৬ জানুয়ারি, বর্তমান ভারতের ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ এলাকায় জন্ম হয়েছিল ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করার পরে গাইনোকোলজি নিয়ে তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। তারপর রিপ্রোডাক্টিভ ফিজিওলজি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করে ব্রিটেনের এডিনবরা ইউনিভার্সিটি থেকে রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে পোস্ট ডক্টরেট অর্জন করলেন ডক্টর মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৭ সালে ভারতে ফিরে ওভিউলেশন এবং স্পার্মাটোজেনেসিস নিয়ে শুরু করলেন গবেষণা। কিছুদিন পরেই তার হাতে এসে গেল এমন একটি সুযোগ যার অপেক্ষা তিনি করছিলেন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে। ফ্যালোপিয়ান টিউবের সমস্যা নিয়ে ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কাছে এলেন একজন মহিলা যার নাম বেলা আগারওয়াল। ক্রায়বায়োলজিস্ট ডক্টর সুনিত মুখার্জি এবং গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর সরোজ কান্তি ভট্টাচার্যকে সাথে নিয়ে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন সম্পন্ন করলেন ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

৩ অক্টোবর ১৯৭৮, ভারতের রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজির জন্য এই দিনটা একটা স্বাধীনতার থেকে কম কিছু না। এই দিনেই কলকাতায় জন্ম হলো ভারতের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি কানুপ্রিয়া আগরওয়ালের। হিন্দু দেবী দুর্গার নাম অনুসারে ওই সন্তানের নাম আরেকটা নাম রাখলেন ডক্টর মুখোপাধ্যায়- দুর্গা, যে নামে আজ একডাকে সেই মেয়েটিকে চেনে। নিজের সময় থেকে প্রায় ২৫ বছর এগিয়ে ছিলেন ডক্টর মুখোপাধ্যায়। 'বন্ধ্যা' এই শব্দটিকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন এই বাঙালি ডাক্তার। হিউম্যান গোনাডোট্রপিক হরমোন ক্ষরণ করে অতিরিক্ত ডিম্বাণু তৈরীর পদ্ধতিও সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন ডক্টর মুখোপাধ্যায়। সারা বিশ্বে যখন একটা পুরনো পদ্ধতিতে টেস্টটিউব বেবি তৈরির কাজ চলছিল সেই সময় ওভারিয়ান স্টিমুলেশন প্রোটোকলের মত অতি আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে দুর্গার জন্ম দিয়েছিলেন এই ডাক্তার। আজকের যুগে দাড়িয়ে যখন এই ওভারিয়ান স্টিমুলেশন প্রটোকলের ব্যবহার সবে সবে শুরু হচ্ছে, সেই একই সিস্টেম ডক্টর মুখোপাধ্যায় ব্যবহার করে ফেলেছিলেন ১৯৭৮ সালে! 

সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর পদ্ধতি ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ডস এবং স্টেপটোর (যারা ইংল্যান্ডে মেরি লুইস ব্রাউনের জন্ম দিয়েছিলেন) থেকেও বেশি আধুনিক ছিল। কিন্তু, তৎকালীন সময়ের সমাজ এবং সরকারের সাহায্য না পাওয়ার কারণে সুভাষের আবিষ্কারের কথা কেউ জানতে পর্যন্ত পারলনা। তবে, জানা যায় নাকি সুভাষের এই আবিষ্কারকে বিচার করা এবং তার আবিষ্কারকে বুঝতে পারার ক্ষমতাও তখনকার দিনের ভারতের সাইন্স কমিউনিটির মধ্যে ছিল না। তাঁরা ভেবেছিলেন, ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিছু ভ্রান্ত দাবি জানাচ্ছেন। ডক্টর মুখোপাধ্যায় হয়তো নিজের দাবি প্রমাণ করতে পারতেন, কিন্তু দুর্গার পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানের পরিচয় বিশ্বের কাছে সেই সময় নিয়ে আসতে চাননি। ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের টিমের আরেক সদস্য সুনীত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ১৯৭৮ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্রাইয়োজেনেটিক্সের একটি লেখায় ডক্টর মুখোপাধ্যায় নিজের আবিষ্কারের কথা লিখেছেন। কিন্তু সেই সমস্ত দাবিও মানতে নারাজ ছিলেন সেই সময়কার বিজ্ঞান কমিউনিটির বড় বড় মাথারা। এমনকী, রাজ্য সরকারের তরফ থেকেও ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের এই দাবিটাকে মানা হয়নি। 

ঘরে-বাইরে নানা জায়গায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় নানান ধরনের সমস্যা, এবং অপমানের শিকার হতে শুরু করলেন। ইন্টারন্যাশনাল সাইন্টিফিক কমিউনিটিতেও তিনি নিজের বক্তব্য পেশ করতে পারলেন না শুধুমাত্র গাইনোকোলজি ডিপার্টমেন্টের অন্যান্যদের সহায়তা না থাকার কারণে। জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটিতে ১৯৭৯ সালে প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টারে তার একটি বক্তৃতা দিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, তদানীন্তন রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তাঁকে ন্যূনতম অনুমতিটুকু দেওয়া হল না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং চিকিৎসক মহলে তার আবিষ্কারের অপমান করা হলো, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা শুরু হলো। ১৯৮১ সালের জুন মাসে তাকে কলকাতার রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ ওপথালমোলজি থেকেও বিতাড়িত করে দেওয়া হল শুধুমাত্র তার সময় থেকে এগিয়ে থাকা আবিষ্কারের জন্য। 

অপমান, লাঞ্ছনা আর সহ্য করতে না পেরে ১৯ জুন ১৯৮১ তারিখে নিজের সাদার্ন এভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করলেন ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়। রেখে গেলেন একটা সুইসাইড নোট, যাতে লেখা - 'আর হার্ট অ্যাটাকের জন্য অপেক্ষা করতে পারলাম না'। কালজয়ী এই বাঙালি ডাক্তারের জীবন-কাহিনী নিয়েই বাংলার জনপ্রিয় ভিন্ন ধারার চিত্র-পরিচালক তপন সিংহ তৈরি করলেন একটি হিন্দি ছবি। নাম দিলেন - 'এক ডক্টর কি মৌত'।

More Articles